কালনা | দেবী অম্বিকার নাম অনুসারেই হয়েছে শহরের নামকরন

পূর্ব বর্ধমান জেলার একটি পৌর অঞ্চল কালনা , যা জেলাসদর বর্ধমান শহরের থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই শহরটি অম্বিকা কালনা নামেও বেশ জনপ্রিয়। জানা যায় স্থানীয় দেবী অম্বিকার নামানুসারেই শহরের এই নামকরণ।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই অঞ্চলের গড় উচ্চতা ১১ মিটার বা ৩৬ ফুট। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, কালনার জনসংখ্যা ৫৬,৭২২। এর মধ্যে পুরুষ ৫১% ও মহিলা ৪৯%। কালনার সার্বিক সাক্ষরতার হার ৭৭% । পুরুষ সাক্ষরতার হার ৮২% ও মহিলা সাক্ষরতা ৭২%। কালনার জনসংখ্যার ৯%-এর বয়স ৬ বছরের নিচে।
কালনা ও শান্তিপুর সুদূর অতীতকাল থেকেই হস্তচালিত তাঁত-ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। কালনার খ্যাতি টাঙ্গাইল ও জামদানি শাড়ির জন্য। কালনা ,সমুদ্রগড়, শান্তিপুর, ফুলিয়া, ধাত্রীগ্রাম আজও অপূর্ব নকশা ও রঙের সূক্ষ্ম মসৃণ টেক্সটাইল ও শাড়ি উৎপাদিত হয় , যা সমবায় ও বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে বাজারে পাঠানো হয়।একপ্রকার কুটির শিল্প রক্ষাবন্ধনী ও বিন্দি কালনায় উৎপাদিত হয়। যা এলাকার অনেক মানুষ, বিশেষত মহিলাদের জীবিকা নির্বাহে অনেক সাহায্য করে।
রেল ও সড়কপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার দিক থেকেও কালনা বেশ উন্নত। রেলপথে হাওড়া থেকে কাটোয়া পর্যন্ত প্রসারিত একটি লুপ লাইনের দ্বারা কালনা সংযুক্ত। হাওড়া থেকে ৮১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত অম্বিকা কালনা স্টেশনটি এই শহরের প্রধান রেলওয়ে স্টেশন। শহরটি। হাওড়া এবং শিয়ালদহ থেকে অনেক লোকাল ট্রেন এবং কয়েকটি এক্সপ্রেস এবং যাত্রীবাহী ট্রেন যায় কালনার উপর দিয়ে । এছাড়াও কালনা শহরের উত্তর অংশও বাঘনপাড়ার দিয়েও খুব সহজে পৌঁছান যায় কালনায়। ব্যান্ডেল -কাটোয়া লাইনের ব্যান্ডেল থেকে ৪২ কিমি দূরে অবস্থিত কালনা
সড়ক পথেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শহরের সঙ্গে যুক্ত কালনা। এসবিএসটিসি দ্বারা পরিচালিত একটি সরকারি বাস ডিপো রয়েছে যা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহর যেমন দুর্গাপুর, আসানসোল,বর্ধমান, দীঘা, মালদা,বাঁকুড়া, বালুরঘাট ইত্যাদি সংযোগকারী দূরপাল্লার এক্সপ্রেস বাসের পরিষেবা দেয়। ভাগীরথী নদীর তীরে কালনা ঘাট বাসস্ট্যান্ড থেকে কৃষ্ণনগর, তারকেশ্বর, শান্তিপুর, ফুলিয়া এবং রানাঘাটের জন্য বাস পরিষেবা পাওয়া যায়। এছাড়া সড়ক পথে ব্যান্ডেল, পাণ্ডুয়া, বৈঁচি, মেমারি ও বর্ধমান থেকে সড়কপথে এই শহরে যাওয়া যায়।
শিক্ষাগত ক্ষেত্রেও বেশ উন্নত করেছে বর্ধমান জেলার এই মফঃস্বল শহরটি। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত কালনা কলেজ কালনা শহরের একটি পুরাতন কলেজ যা ন্যাক-এর বিচারে বি++ কলেজের মর্যাদাপ্রাপ্ত। এছাড়াও কালনা শহরে রয়েছে সরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুল।
দর্শনীয় স্থান
নদিয়া ও হুগলি জেলার সীমানার খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে অম্বিকা কালনা । নবদ্বীপ ও মায়াপুর কালনার খুব কাছেই অবস্থিত। এছাড়া কালনা শহরেও বিখ্যাত কিছু দর্শনীয় জায়গা। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ১০৮ শিবমন্দির , প্রতাপেশ্বর মন্দির, কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দির, কালনার রাজবাড়ি, লালজি মন্দির।
১০৮ শিবমন্দির : কালনা শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ হল ১০৮ শিবমন্দির। ১৮০৯ সালে মহারাজ তেজচন্দ্র বাহাদুর এই ইঁটের তৈরি আটচালা মন্দিরগুলি নির্মাণ করেন। মন্দিরগুলি দুটি বৃত্তের আকারে বিন্যস্ত। একটি বৃত্তে ৭৪টি ও অপর বৃত্তে ৩৪টি মন্দির অবস্থান করছে। প্রথমোক্ত বৃত্তের মন্দিরগুলিতে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গগুলি শ্বেত অথবা কষ্টিপাথরে কিন্তু শেষোক্ত বৃত্তের মন্দিরগুলিতে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গগুলি কেবলমাত্র শ্বেত পাথরেই নির্মিত।
কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দির : ২৫টি চূড়বিশিষ্ট কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দির কালনার অপর জনপ্রিয় দ্রষ্টব্য। যা ১৭৫১-৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত ।মন্দিরের বিগ্রহ নিত্য পূজিত হন। সকালে মাখন ও মিছরি ভোগ, তারপর পূজা, মধ্যাহ্নে ভোগ ও শয়ন, বৈকালে উত্থান এবং সন্ধ্যায় সন্ধ্যারতি ও ভোগ নিবেদন করা হয় এই মন্দিরের বিগ্রহকে।এই মন্দিরের গা অলঙ্কৃত মহাকাব্য ও পুরাণের বিভিন্ন দৃশ্যসম্বলিত পোড়ামাটির ফলকে সমৃদ্ধ।বর্ধমানরাজ ত্রিলোকচন্দ্রের মাতা লক্ষ্মীকুমারী এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বিষয়বস্তুর বৈচিত্র, সুন্দর সুন্দর টেরাকোটা মূর্তি ও ফুলের নকশা এই মন্দিরে রয়েছে যা খুবই উচ্চমানের। ধর্মীয় ও সামাজিক দৃশ্যের ফলকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, নৌকাবিলাশ, অশ্বমেধ যজ্ঞ, ন্দুকধারী ফিরিঙ্গি সৈন্য, যুদ্ধ চিত্র, বকাসুর বধ, শিকারের দৃশ্যর মতো অনেক ধর্মীয় ও সামাজিক দৃশ্য ফুটে উঠেছে এই মন্দিরের গায়ে।
প্রতাপেশ্বর মন্দির : ১৮৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত রেখ দেউলের নিদর্শন প্রতাপেশ্বর মন্দিরও উল্লেখযোগ্য।উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত, পূর্বমুখী, উড়িষ্যারীতির শিখর দেউলের প্রাচীন রীতির পরিবর্তিত ও সরলীকৃত রূপ এটি। গর্ভগৃহে একটি মাত্র দরজা, পূর্ব দিকে। বাকি তিনদিকে আছে ভরাট করা দরজা।মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। মন্দিরে প্রবেশ পথের মাথায় রয়েছে রামসীতার অভিষেক। উত্তর দিকের কৃত্রিম দ্বারের মাথায় আছে লঙ্কাযুদ্ধ। যুদ্ধে সিংহবাহিনী দুর্গার আবির্ভাব। অন্য দিকে বানর সৈন্য। নিচে রণবাদ্য। দক্ষিণ দিকে রয়েছে রাধাকৃষ্ণ ও ললিতা-বিশাখা। পশ্চিম দিকে কৃত্রিম দ্বারের মাথায় রয়েছে কীর্তনদলসহ 'গৌড়-নিতাই' মূর্তি। এছাড়াও টেরাকোটা কাজের নিদর্শন রয়েছে এই মন্দিরে।
লালজি মন্দির : কালনা শরেরে মন্দির গুলির মধ্যে অন্যতম মন্দির হল লালজি মন্দির।যা ১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত। মন্দিরের সামনে রয়েছে একটি নাটমণ্ডপ এবং আর একটি পর্বতাকৃতি মন্দির যা গিরিগোবর্ধন নামে পরিচিত। মূল মন্দিরটি পোড়ামাটির অলঙ্করণে মণ্ডিত। ২০২০ তে ভারতীয় ডাকবিভাগ ওডিশা, ছত্তিশগড়, উত্তরপ্রদেশ ও বাঁকুড়ার সেরা সাতটি টেরাকোটা মন্দির বেছে নিয়েছিল, যার মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিল এই লালজি মন্দিরও।
এছাড়াও কালনার অনান্য মন্দির গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দেবী ভবানীর মন্দির। বৈশাখ মাসের শেষ শনিবারে এই মন্দিরে বিশেষ পূজা আয়োজিত হয়। এই প্রথাটিকে জনপ্রিয়তা দিয়েছিলেন ভবা পাগলা নামক জনৈক সাধু। দেবী ভবানী মন্দিরের কাছেই শ্রীগৌরাঙ্গ মন্দির। সেখানে রক্ষিত আছে চৈতন্যদেবের পাণ্ডুলিপি ও ব্যবহৃত সামগ্রী।
কালনার অন্য আর একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরে হল শ্যামচাঁদ রাধারানি মন্দির , যা তিনশো বছরেরও বেশি পুরনো। আজও রথযাত্রা, ঝুলন পূর্ণিমা, দোল পূর্ণিমা, অন্নকূট ও রাস উৎসব পালিত হয় এখানে। এখানে জাতি , বর্ণ, ধর্ম, নির্বিশেষে সকলে প্রবেশ করতে পারেন। কালনার আর দর্শনীয় স্থান হল সিদ্ধেশ্বরী মন্দির। এটিই দেবী অম্বিকার মন্দির, যাঁর নামে কালনা শহর অম্বিকা কালনা নামে পরিচিত।