কল্যাণী | রুজভেল্ট নগরের স্মৃতির শহরে বেড়ে উঠা কল্যাণী

কল্যাণী |  রুজভেল্ট নগরের স্মৃতির শহরে বেড়ে উঠা কল্যাণী

১৯৫০ সালে কলকাতা থেকে ৫০ কিমি দূরের নদিয়া জেলার একটি জায়গায় তৈরি করলেন শহর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গঙ্গার ধারে জায়গাটি ছিল মার্কিন সেনাদের ছোটোখাটো উপনিবেশ, নাম ছিল ‘রুজভেল্ট নগর’। পরবর্তী সময় সেখানেই বিধানচন্দ্র তৈরি করলেন ‘কল্যাণী’। নামটা কি খুব কাকতালীয়? অনেকের মতে, প্রিয়তমা কল্যাণীর সঙ্গে অপূর্ণ পরিণয়ের স্মৃতি থেকেই এই নামটি বেছেছিলেন বিধান রায়। আজ কল্যাণী রীতিমতো একটি স্মার্ট সিটি। আধুনিকতার আড়ালে কি লুকিয়ে আছে এমন কিংবদন্তি প্রেমকথা? 

১৯৪৪ সালের মে মাসে বিশ্বযুদ্ধে হার মেনে জার্মানি মিত্র শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে। পরমাণু বোমার আঘাত সহ্য করতে না পেরে জাপানও পরাজয় বরণ করে। বিশ্বযুদ্ধ থামলে আমেরিকান সেনা বাহিনীর রুজভেল্ট নগরের প্রয়োজন মিটে যায়। তাই শেষমেশ মার্কিন সেনারাও এই এলাকা ছেড়ে চলে যায়। জনমানবহীন সামরিক শহর এক সময়ে পরিত্যক্ত জনপদের চেহারা নেয়। যুদ্ধের বহু নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল শহর জুড়ে। কিন্তু ইতিহাসের চিহ্ন বুকে নিয়ে রুজভেল্ট নগর তখন ক্রমে জঙ্গলে ঢাকছিল।

শহরের যে পরিবর্তনই হোক না কেন, সে দিনের বহু অভিজ্ঞতা আজও ভোলেননি শহরের প্রবীন নাগরিকেরা।  তাঁদের কেউ কেউ জানালেন, এক সময়ে এই শহরের বেশির ভাগটাই ছিল ফাঁকা জলা-জঙ্গল। মাত্র চল্লিশ ভাগ অংশে বসবাস ছিল। বাকি সব প্লট ছিল ফাঁকা। পুরভবনের বিপরীত দিকের ট্র্যাক্টর গ্যারাজ থেকে মেন স্টেশন পর্যন্ত রাস্তা ছিল সুনসান। রাস্তায় পর্যাপ্ত আলোও ছিল না।বাল্বের টিমটিমে হলুদ আলো সে ভাবে মাটি পর্যন্ত পৌঁছতই না।  সন্ধে ৭টার পরে রাস্তায় কাউকে দেখা যেত না। সারা দিনে হয় তো একটা সাইকেল রাস্তায় দেখা গেলেও যেতে পারে, এমনই দশা। এক সময়ে এখানে মাত্র দু’জন ডাক্তার ছিলেন। তাঁদের একজনের ফিজ ছিল দু’টাকা। অন্য জনের ফিজ ছিল চার টাকা। ওষুধের দোকান বলতে কাঁচরাপাড়ার একটি মাত্র দোকান ছিল ভরসা।

কল্যাণী পশ্চিমবঙ্গের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্র। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজ্য প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (MAKAUT) ও বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় , কল্যাণী গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, জে আই এস কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং, আইডিয়াল কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং, গয়েশপুর গভঃ পলিটেকনিক কলেজ, কলেজ অফ মেডিসিন অ্যান্ড জে.এন.এম হসপিটাল, কল্যাণী মহাবিদ্যালয় (কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত একটি স্নাতক কলেজ), স্নেহাংশুকান্ত আচার্য আইন কলেজ, একটি ডেয়ারি রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ন্যাশনাল হোমিওপ্যাথি ইনস্টিটিউট, ইন্ডিয়ান সায়েন্স, রিসার্চ ইন্সটিটিউট, একটি কারিগরী শিক্ষাকেন্দ্র (ITI) মোট ৩ টি বিশ্ববিদ্যালয় সহ মোট ১১ টি কলেজ এবং ১ টি মেডিকেল কলেজ ও ৩ টি গবেষণা কেন্দ্র, এছাড়াও অসংখ্য সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত বেসরকারী স্কুল কল্যাণীকে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের একটি বিশিষ্ট শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত করেছে।

 এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে কল্যাণী'তে ২০১৫ সালে কল্যাণী শহরে এইমস নির্মানের ঘোষণা করে কেন্দ্র সরকার।২০১৬ সাল থেকে কল্যাণীতে এইমস নির্মান শুরু হয়েছে। ২০১৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এইমস কল্যাণীর নির্মান শেষ হওয়ার কথা ছিল।কল্যাণী শহরের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে কল্যাণী স্টেডিয়াম। এই স্টেডিয়ামে আই-লিগের বেশ কিছু ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্টেডিয়ামটি মোহন বাগান, ইস্ট বেঙ্গল ফুটবল দল তারা তাদের অনুশীলনের জন্য ব্যবহার করে। পশ্চিমবঙ্গ ফুটবল দলের অনেক ম্যাচ এই স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়। প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মধু দণ্ডবতের আমলে কল্যাণী শহরে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ২৭ নম্বর রুটে দু’একটা বাস চলত সারা দিনে। রাস্তায় অন্য গাড়ি ছিল না বললেই চলে। সাপখোপ, শিয়াল, পাখির ডেরা ছিল নানা জায়গায়। এমনকী, বুনো শুয়োরেরও উত্‌পাত ছিল।

শোনা যায়, একবার লেক হোস্টেলের ছাত্ররা একটা  চিতা বাঘকে মেরেছিল। পরে সেটি সাইকেলে তুলে গোটা এলাকায় ঘোরানো হয়েছিল।লেখক দীপঙ্কর চক্রবর্তী জানালেন, কল্যাণীর উন্নয়নের ক্ষেত্রে ১৯৭৯ সাল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বছর। সে বছরের ৭ এপ্রিল রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর উপস্থিতিতে তত্‌কালীন রেলমন্ত্রী মধু দণ্ডবতে কল্যাণী মেন স্টেশন থেকে কল্যাণী সীমান্ত পর্যন্ত রেলপথের উদ্বোধন করেন। সেই থেকে শিয়ালদহ-কল্যাণীগামী ‘কল্যাণী লোকাল’ হল ‘কল্যাণী সীমান্ত লোকাল’। কল্যাণী থেকে সরাসরি হুগলি, বর্ধমান, হাওড়ার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য তৈরি হল ঈশ্বরগুপ্ত সেতু। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন যার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।১৯৮৯ সালের ৬ অক্টোবর এটির উদ্বোধন করেন তত্‌কালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। ১৯৫৭ সালে তৈরি হয় কল্যাণী থানা।  ১৯৮৩ সালের ১ জানুয়ারি কল্যাণী, চাকদহ এবং হরিণঘাটা থানা নিয়ে গঠিত হয় কল্যাণী মহকুমা। রবীন গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন প্রথম মহকুমাশাসক। 

নদিয়া জেলার কল্যাণী মহকুমার প্রশাসনিক কেন্দ্রও। রাজধানী কলকাতা থেকে দূরত্ব ৫০ কিমি। কলকাতার পরে এটি একটি উল্লেখযোগ্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের পরিকল্পনা ছিল কল্যাণী'কে দ্বিতীয় কলকাতা তৈরি করা।  ভারতের সীমানা পুনর্নির্ধারণ কমিশনের নির্দেশিকা অনুসারে, কল্যাণী (তফসিলি জাতি) বিধানসভা কেন্দ্রটি কল্যাণী পুরসভা, গয়েশপুর পুরসভা, চান্দুরিয়া-২, কাঁচরাপাড়া, মদনপুর-১, মদনপুর-২, সগুণা, সারাতি ও শিমুরালি গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি চাকদহ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের অন্তর্গত। কল্যাণী (তফসিলি জাতি) বিধানসভা কেন্দ্রটি ১৪ নম্বর বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের (তফসিলি জাতি) অন্তর্গত। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী ডঃ রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস জয়ী হয়েছিলেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিএমের অলোকেশ দাসকে ২৬,০৯৫ ভোটে পরাজিত করেছিলেন। ডঃ রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৯৫,৭৯৫৷ দ্বিতীয় স্থানে সিপিএম প্রার্থী অলোকেশ দাসের প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা ছিল ৬৯,৭০০৷ ২০১১ সালের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের ডা. রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিআইএমের জ্যোৎস্না শিকদারকে পরাজিত করেছিলেন।