কমলা হ্যারিসঃ আমেরিকার প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভাইস প্রেসিডেন্ট

কমলা হ্যারিসঃ আমেরিকার প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভাইস প্রেসিডেন্ট

আমেরিকার প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস  Kamala Harris । তাঁর ধমনীতে মিশেছে তিন মহাদেশ— আফ্রিকা, আমেরিকা এবং এশিয়া। অতিমারির সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশে ঘটে যাওয়া নির্বাচনে এ-ও এক নীরব বিপ্লব। জো বাইডেনের রানিং মেট হিসেবে জোড়া রেকর্ড গড়েছেন তিনি। আমেরিকায় ইতিহাসে প্রথম মহিলার পাশাপাশি হতে চলেছেন প্রথম অ-শ্বেতাঙ্গ ভাইস প্রেসিডেন্টও। কমলা হ্যারিস অবশ্য মনে করেন, তাঁর এই জয়েই আমেরিকার মহিলাদের রাজনৈতিক সাফল্য সীমাবদ্ধ থাকবে না।  এই আলোচিত মহিলার তার জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই রেখেছেন সফলতার অবদান। ভেঙেছেন রেকর্ড।  

জন্ম ও পরিবার ও শিক্ষা:

কমলার বাবার জন্ম জ্যামাইকায় এবং মা ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইন্ডিয়ান আমেরিকান। অর্থনীতিবিদ বাবা ও জীববিজ্ঞানী মায়ের সন্তান কমলার রয়েছে মায়া নামের এক বোন। কমলার জন্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওকল্যান্ডে। কৃষ্ণাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠ পাড়ায় দীর্ঘদিন থাকার পাশাপাশি তামিল মা ও জ্যামাইকান বাবার মিশ্র ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়েই বেড়ে ওঠা তার। কমলার বর্তমান বয়স ৫৬ বছর।বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক লম্বা, রোগা এবং কালো পিএইচডি ছাত্রের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে ভারতীয় এক ছাত্রীর। দু’জনেই আসছেন দু’টি ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে। পুরুষটি জামাইকার বাসিন্দা এবং মহিলাটি ভারতীয়। ঔপনিবেশিকতার সূত্র গেঁথে দিল দু’জনের ধ্যানধারণা-ভাবনাকে। জামাইকার বাসিন্দা ডোনাল্ড হ্যারিস বক্তৃতা করতেন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে।

বোঝাতেন, ঔপনিবেশিক শক্তি কী ভাবে বিভাজন তৈরি করে এবং শাসন করে। সমাজে চরম বৈষম্যকে ঢাকা দিতে তারা কী ভাবে ‘নেটিভ অভিজাত সম্প্রদায়’ তৈরি করে আর্থ-সামাজিক বিভাজন তীব্র করে দেয় সেই কৌশল তখনই ধরতে পেরে গিয়েছিলেন হ্যারিস। বক্তৃতায় সে কথা বলতেনও। তাঁর কথা শুনতে ভালবাসতেন সেই ভারতীয় তরুণী, নাম শ্যামলা গোপালন।ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে পড়াশোনার জন্য ব্রিটেনে পাড়ি দেওয়াই এক সময় রেওয়াজ হয়ে উঠেছিল পড়ুয়াদের মধ্যে। কিন্তু হ্যারিস এবং শ্যামলা দু’জনের ক্ষেত্রেই সেই প্রথা ভাঙার সমাপতন ঘটেছিল। কম বয়েসে আমেরিকার নৌঘাঁটি গুয়ান্তানামো থেকে সম্প্রচারিত জ্যাজ মিউজিকের ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন হ্যারিস। টেনেসির ন্যাশভিল থেকে সম্প্রচারিত ব্লুজ-ও টানত তাঁকে।

ফলে শিক্ষা, সংস্কৃতি, আন্দোলন এ সবের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র আমেরিকার প্রতি বরাবরই টান ছিল হ্যারিসের। জামাইকা থেকে স্কলারশিপ পাওয়ার পর, পড়তে যাওয়ার জন্য তাই হ্যারিসের প্রথম পছন্দ ছিল আমেরিকা। সে দিনের কথা এখনও মনে আছে হ্যারিসের। স্মৃতিতে টান দিয়েই তিনি বলছেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্পর্কে আরও খোঁজখবর নেওয়ার পর আমি নিশ্চিত হই যে ওখানেই আমি যাব।’’৮ হাজার মাইল দূরে থাকা শ্যামলাও সে দিন সেই একই কথা ভেবেছিলেন। তামিল ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান শ্যামলা। লেডি আরউইন কলেজের ছাত্রী ছিলেন তিনি। তাঁর ইচ্ছা ছিল বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে পড়াশোনা করার। কিন্তু হোম সায়েন্স নিয়ে পড়তে বাধ্য হন তিনি। সেই শ্যামলাও পা বাড়িয়েছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে।বিয়ে করলেন হ্যারিস এবং শ্যামলা।

১৯৬৪ সালে জন্ম নেন তাঁদের প্রথম সন্তান কমলা। তাঁর বোন মায়া লক্ষ্মী।হ্যারিস এবং শ্যামলার বিয়ে শেষ পর্যন্ত অবশ্য ভেঙে গিয়েছিল। কমলার বয়স যখন ৭ তখন বিচ্ছেদ হয়ে যায় দু’জনের। তত দিনে হ্যারিস অর্থনীতির অধ্যাপক। অন্য দিকে পুষ্টিবিদ্যা এবং এন্ডোক্রিনোলজি নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করে ফেলেছেন শ্যামলা। বার্কলে ডিপার্টমেন্ট অব জুওলজিতে স্তন ক্যানসার নিয়ে গবেষণাও করছেন। কিন্তু প্রথম প্রেম ভেঙে যাওয়ার ক্ষত সারাজীবনেও সারিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। মধুর প্রেম বদলে গিয়েছিল তিক্ততায়। আমেরিকা যখন সিভিল রাইটস আন্দোলনে উত্তাল, তখনই ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠেন কমলা। বাবা-মা সেই ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে হাঁটতেন মিছিলে, জড়ো হতেন বিভিন্ন জমায়েতে। মা শ্যামলা জানিয়েছিলেন তার বড় মেয়েটি অর্থাৎ কমলার মুখে যখন সবে বুলি ফুটেছে, তখন সে মাঝেমাঝেই কান্নাকাটি করত আর কি চাই জিজ্ঞাসা করলে ঠোঁট ফুলিয়ে আধো আধো গলায় বলত, ‘ফিদম’।

ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলের কৃষ্ণাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় বাস করলেও কমলা পড়তেন অভিজাত থাউজেন্ড ওকস স্কুলে। সেই স্কুলে এক সময় ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ছিল শ্বেতাঙ্গ। বর্ণভিত্তিক পৃথকীকরণের নীতি রদ হবার পর এই চিত্র বদলে যায়। কমলা যখন সেই স্কুলে ভর্তি হন, তখন সেখানে মোট শিক্ষার্থীর ৪০ শতাংশ ছিল কৃষ্ণাঙ্গ।কমলা হ্যারিস হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে স্নাতক হবার সময়ে নানা ধরনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতেন। ১৯৮৬ সালে স্নাতক হবার পর আইনে স্নাতকোত্তর করেন তিনি।

পরিবার 

২০১৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার আইনজীবী ডগলাস এমহফকে বিয়ে করেন কমলা। ডগলাসের আগের পক্ষের দুই সন্তান রয়েছে, কোল ও এলা, যাদের কমলা হ্যারিসের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশেও দেখা যায়। কমলা হ্যারিস রোজ সকালে ব্যায়াম করেন। ২০১৬-র একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘রোজকার রুটিনে দুটি জিনিস আমাকে রাখতেই হবে।এক, ওয়ার্ক আউট। দুই, ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া।’ প্রথমটির মতো দ্বিতীয় বিষয়টি নিয়েও খুবই উৎসাহী কমলা। নিজে রান্না করতে ভালোবাসেন। প্রায়ই সেই সব রান্নাবান্নায় তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন স্বামী ডাগ এমহফ। যখন খুবই চাপে থাকেন তখন রিলাক্স করার জন্য বিভিন্ন রেসিপির বই পড়েন কমলা।

২০০৩ সালে প্রথম নারী ও কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি হিসাবে ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিযুক্ত হন তিনি। তখন থেকেই ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা বাড়তে থাকে। পরে ২০১৭ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার জুনিয়ার সিনেটর পদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন ও জয়ী হন। সিনেটর হিসেবে তার ধারালো প্রশ্ন করার ক্ষমতা বারবার আলোচিত হয়েছে সংবাদমাধ্যম ও সোশাল মিডিয়ায়।

টানা দুই টার্ম ধরে সফল অ্যাটর্নি জেনারেল হিসাবে তার কাজও আলোচিত হয়েছে এতদিন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন টেলিভিশন অনুষ্ঠানে নিজের মিশ্র ঐতিহ্য বিষয়ে সাবলীল আলাপ তাকে জনসাধারণের কাছে আরও জনপ্রিয় করে তোলে।এছাড়া, সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার তার প্রতি সমর্থনও সাহায্য করেছে বলে মনে করেন অনেকে। সিনেটর পদে নির্বাচিত হবার পর কমলা বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সোচ্চার হন। সমকামীদের বিবাহের অধিকারের পক্ষে, মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে থাকার পাশাপাশি কমলা বিভিন্ন সময়ে পুলিশ নীতিতে বদলের দাবি তুলেন।  

যে কারণে আলোচিত: 

 কমলা  প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী এবং প্রথম এশিয়ান আমেরিকান, যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট। প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ও প্রথম এশিয়ান আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি গড়লেন রেকর্ড।  কমলা হ্যারিসের হোয়াইট হাউসের উদ্দেশ্যে যাত্রাকে অনেকেই দেখছেন মার্কিন রাজনীতিতে একটি ঐতিহাসিক মোড় হিসেবে।২০১২-এ ডেমোক্র্যাটদের ন্যাশনাল কনভেনশনে প্রাইম টাইম বক্তা ছিলেন কমলা। সেই প্রথম পুরো বিশ্ব নড়েচড়ে বসে, জানতে চায় কে এই নারী। পরের বছর প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কমলাকে ‘ব্রিলিয়ান্ট’, ‘ডেডিকেটেড’ এবং ‘টাফ’ বলার পাশাপাশি একটু লঘু চালে এমনই একটি কথা বলে বসেন যার জন্য পরে তাকে ক্ষমাও চাইতে হয়েছিল। কমলার সম্পর্কে ওবামার সেই মন্তব্যটি ছিল, ‘বাই ফার, দ্য বেস্ট লুকিং অ্যাটর্নি জেনারেল ইন দ্য কান্ট্রি’।