কঙ্কালীতলা মন্দির

কঙ্কালীতলা মন্দির

শান্তিনিকেতনে বেড়াতে গেলে কঙ্কালীতলা মন্দিরে যাননি বা পুজো দেননি, এমন মানুষ খুব কম মিলবে। পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় তো বটেই, এই শক্তিপীঠ স্থানীয়দের কাছেও অত্যন্ত প্রসিদ্ধ।  বীরভূম জেলার বোলপুর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে কোপাই নদীর তীরে শক্তিপীঠ কঙ্কালীতলা। তন্ত্রচূড়ামতির মতে, এটি ২৮ নং সতীপীঠ। বক্রেশ্বরে দেবী মহিষমর্দিনী মন্দির , লাভপুরে দেবী ফুল্লরা, নলহাটীতে নলাটেশ্বরী, সাঁইথিয়ায় দেবী নন্দিকেশ্বরী এবং বোলপুরের কাছে কঙ্কালীতলা মন্দির। তারাপীঠকেও সতীপীঠ ধরা হলে সংখ্যাটা ছয়।

সাধারণ পর্যটকদের পাশাপাশি কঙ্কালীতলা মন্দির তন্ত্রসাধনার জন্যও বিখ্যাত। এই মন্দির নিয়ে বিভিন্ন কাহিনী প্রচলিত আছে। অনেকের মতে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে কঙ্কালীতলার সাথে কাশীর মণিকর্ণিকা ঘাটের সরাসরি যোগাযোগ আছে। আবার অন্য একটি প্রচলিত জনশ্রুতি বলে কঙ্কালীতলা মন্দিরে রাত্রিনিবাস করা কারোর পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে নাকি নানা বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে থাকে।

কঙ্কালীতলা মন্দির পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় অবস্থিত। শান্তিনিকেতনের খুব কাছেই, বোলপুর শহর থেকে মাত্র নয় কিলোমিটার দূরে বোলপুর-লাভপুর রোডের উপর এই মন্দিরটি রয়েছে। মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কোপাই নদী। পাশেই রয়েছে শ্মশান। বলা হয় একান্ন সতীপীঠের শেষ পীঠ কঙ্কালীতলা সতীপীঠ। তবে এই মন্দির সতীপীঠ না উপপীঠ এই নিয়ে অনেক মত রয়েছে।

পীঠ নির্ণয়তন্ত্র অনুসারে কঙ্কালীতলা মন্দিরে সতীর কঙ্কাল পড়েছিল, সেই কারণেই এই পীঠের নাম হয় কঙ্কালীতলা। আবার ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যগ্রন্থ অনুসারে এখানে সতীর কোমরের অংশ পড়েছিল। তবে মন্দিরের সেবাইত ও স্থানীয় তন্ত্রসাধকেরা সতীর কোমরের অংশ পড়ার তত্ত্বকেই সমর্থন করেন। পবিত্র কুণ্ড যেখানে সতীর দেহাংশ নিমজ্জিত আছে বলা হয়।

 আগে এখানে কোনও মন্দির ছিল না। শুধুমাত্র একটি কুণ্ড ছিল। খোলা বেদীতে দেবীর পূজা করা হত। পরে মন্দির তৈরি হয়। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে কয়েকশো বছর আগে এক সাধু এই পীঠের অস্তিত্ব অনুভব করেছিলেন। পরবর্তীকালে  আরেকজন মায়ের সাধককে মা স্বপ্নাদেশ দিয়ে জানান তিনি ওই কুণ্ডের জলে নিমজ্জিত আছেন। স্বপ্নাদেশে সেই সাধক মায়ের পুজোর ব্যবস্থা করার আজ্ঞা পান।

এই কুণ্ডের জলে কিছু পাথর নিমজ্জিত রয়েছে, যেগুলোকে ভক্তেরা দেবীর দেহাংশ বলে মনে করেন। বলা হয় এই পাথর খণ্ডগুলি কুড়ি বছর অন্তর কুণ্ড থেকে তোলা হয়। পূজা শেষে সেগুলিকে পুনরায় কুন্ডের জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয় গরমকালে বীরভূমের অনেক জায়গার জলাশয় শুকিয়ে গেলেও এই কুণ্ডের জল নাকি শোকায় না। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাংলার ইতিহাস’ নামক বইতে উল্লেখ আছে প্রথম মহীপালের রাজত্বের সময়কালে রাজা ছিলেন কাঞ্চিরাজ রাজেন্দ্রচোল।

তিনি সেই সময় অনেক রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। বলা হয় অনেক বছর আগে বীরভূমের এই জায়গাটি কাঞ্চিরাজের অধীনে ছিল। কাঞ্চিরাজা ছিলেন শিবভক্ত। তিনি কোপাই নদীর তীরে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই থেকে এখানের শিবলিঙ্গ  রাজার নামানুসারে কাঞ্চীশ্বর শিবলিঙ্গ নামেও পরিচিত। এই শিবমন্দিরের পাশে রয়েছে মহাশ্মশান ও পঞ্চবটিবন। মন্দিরে মায়ের ছবি পূজা করা হয়।  মন্দিরের ডান দিকে রয়েছে কুণ্ডের জলেই নিমজ্জিত আছে মা সতীর কঙ্কালটি।

প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে শিব যখন সতীর দেহ নিয়ে নৃত্য শুরু করেছিলেন তখন তার চৈতন্য ছিল না। বিষ্ণুর চক্রে সতীর দেহ খন্ড খন্ড হবার পর মহাদেবের চৈতন্য ফেরে। সতীর কঙ্কাল সর্বশেষ পৃথিবীর বুকে খসে পরে। তাই এই পীঠকে একান্নপীঠের সর্বশেষ পীঠ বলা হয়। সতীর কঙ্কাল পৃথিবীর বুকে পড়ে যাবার পরেই মহাদেবের চৈতন্য আসে। সেই কারণে এই পীঠ চৈতন্যপীঠ নামেও পরিচিত। এখানে দেবীর কোনো মূর্তি নেই। এখানে রয়েছে শ্মশানকালীর বড় বাঁধানো একটি ছবি। ছবিতেই দেবীর পূজা করা হয়।

প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকে। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী দেবগর্ভা এবং ভৈরব হলেন রুরু। আবার অন্য আরেকটি মতে দেবীর নাম রত্নাগর্ভি, যদিও সেই মতে ভৈরবের নাম একই অর্থাৎ রুরু। এখানে আসবার সবথেকে ভালো উপায় হল শান্তিনিকেতন থেকেই সকালে ঘুরতে আসা। তবে ট্রেনে আসতে চাইলে বোলপুর স্টেশন থেকে মন্দিরের দুরত্ব প্রায় ৯ কিলোমিটার এবং প্রান্তিক স্টেশন থেকে দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার।

২০২০ সালের কোভিড পরিস্থিতির পর পাওয়া তথ্য অনুযায়ী হাওড়া থেকে বোলপুরের কয়েকটি ট্রেনের বিস্তারিত তুলে ধরা হল। এছাড়াও অনেক ট্রেন আছে। শিয়ালদহ থেকেও ট্রেন আছে। ট্রেন নাম্বার ট্রেনের নাম কখন ছাড়বে বোলপুর কখন পৌঁছবে ০৩০১৭ গণদেবতা কোভিড - ১৯ স্পেশাল সকাল ৬টা ৫ মিনিট সকাল ৮টা ৪২ মিনিট ০২৩৩৭ শান্তিনিকেতন কোভিড - ১৯ স্পেশাল সকাল ১০টা ১০ মিনিট বেলা ১২টা ২৫ মিনিট ০২৩৪৭ শহীদ (ইন্টারসিটি) স্পেশাল বেলা ১১টা ৫৫ মিনিট দুপুর ২টো ৩ মিনিট এখানে বেশ কয়েকটি থাকার জায়গা আছে।

তবে সংখ্যায় খুব কম।তাই সবথেকে ভালো হয় শান্তিনিকেতনে থাকা। অনেক বেশি হোটেল, রিসর্ট বা হোম স্টে পাওয়া যাবে। মন্দিরে সকাল সকাল এসে পুজো দিতে পারেন। চৈত্র সংক্রান্তির দিন মন্দিরে বিশেষ পুজোর ব্যবস্থা করা হয়। তিনদিন ধরে মন্দিরে উৎসব চলে। চৈত্র সংক্রান্তির দিন কুণ্ডের চারদিকে বসে পুজো করা হয় ও ছাগল বলি দেওয়া হয়। এখানে কালী পূজাতেও বেশ ভিড় হয়। এখানে ভোগ প্রসাদের ব্যবস্থা আছে। দর্শনার্থীরা কুপন কেটে প্রসাদ পেতে পারেন। তবে কুণ্ডের জলে নামবেন না।

বিশ্বাস করা হয় কেউ এই জলে নামলে তার ক্ষতি হবে। যদি আপনি বিশ্বাস নাও করেন, তাও এখানে আসা ভক্তদের বিশ্বাসকে সম্মান রেখেই কুণ্ডে না নামাই উচিত। কাছাকাছি ঘোরার মধ্যে অবশ্যই শান্তিনিকেতন। এছাড়াও বল্লভপুর অভয়ারণ্য ডিয়ার পার্ক, সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মস্থান, তারাপীঠ প্রভৃতি স্থানও ঘোরা যায়। সারা বছর ধরেই আসা যায়। তবে গ্রীষ্মকালে বেশ গরম থাকায় সেই সময় নাই আসতে পারেন। চৈত্র সংক্রান্তির বিশেষ পূজায় আসতে চাইলে আগে থেকে হোটেল বুক করে রাখবেন।

ট্রিপ টিপস কিভাবে যাবেন – এখানে আসবার সবথেকে ভালো উপায় হল শান্তিনিকেতন থেকেই সকালে ঘুরতে আসা। তবে ট্রেনে আসতে চাইলে বোলপুর স্টেশন থেকে মন্দিরের দুরত্ব প্রায় ৯ কিলোমিটার এবং প্রান্তিক স্টেশন থেকে দুরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। কোথায় থাকবেন – থাকার জন্য অল্পসংখ্যক হোটেল রয়েছে। সবথেকে ভালো হয় শান্তিনিকেতনে থাকা।

কি দেখবেন – কঙ্কালীতলা মন্দির এবং মন্দিরে অবস্থিত পবিত্র কুণ্ড। কাছাকাছি ঘোরার মধ্যে শান্তিনিকেতন, বল্লভপুর অভয়ারণ্য ডিয়ার পার্ক, সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মস্থান, তারাপীঠ প্রভৃতি স্থানও ঘোরা যায়। কখন যাবেন –  গ্রীষ্মকাল বাদে সারা বছরই যাওয়া যায়। তবে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস সবথেকে উপযুক্ত সময়।

সতর্কতা –  কুণ্ডের জলে নামবেন না। বিশ্বাস করা হয় কেউ এই জলে নামলে তার ক্ষতি হবে। যদি আপনি বিশ্বাস নাও করেন, তাও এখানে আসা ভক্তদের বিশ্বাসকে সম্মান রেখেই কুণ্ডে না নামাই উচিত। চৈত্র সংক্রান্তির বিশেষ পূজায় আসতে চাইলে আগে থেকে হোটেল বুক করে রাখবেন। বিশেষ পরামর্শ – দর্শনার্থীরা কুপন কেটে প্রসাদ পেতে পারেন। উল্লেখ্য, কঙ্কালীতলা গুপ্ত তন্ত্রসাধনার জন্য খুবই বিখ্যাত। সাধকদের পাশাপাশি এখানে সারা বছর সাধারণ পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে।