কাটোয়া | প্রাচীন ঐতিহাসিক শহর Katwa

পূর্ব বর্ধমান Purba Bardhaman জেলার একটি পৌরসভা এলাকা ও মহকুমা শহর হল কাটোয়া Katwa। ভাগীরথী নদী ও অজয় নদের তীরবর্তী একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক স্থান কাটোয়া ।কাটোয়ার ইতিহাসে নিমাইয়ের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা কাটোয়া Katwa। এখানেই তিনি কেশব ভারতীর কাছে দীক্ষা নেন। নাম হয় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যগিরি, আমাদের শ্রীচৈতন্য। তাই Katwa কাটোয়ার মাহাত্ম্য বৈষ্ণবতীর্থ হিসাবে। নিমাইয়ের সেই দীক্ষাস্থল আজকের গৌরাঙ্গবাড়ি।
স্টেশন রোড থেকে কাছারি রোডে এসে মহাপ্রভুপাড়ার বাজার। সেখান থেকে সংকীর্ণ পথে পৌঁছে যাওয়া যায় গৌরাঙ্গবাড়ি। ফটক দিয়ে ঢুকতেই বাঁ দিকে নিমাইয়ের মস্তক মুণ্ডনের স্থান, পাশেই সন্ন্যাসগ্রহণ ও নাম প্রকাশের স্থান। এর পরেই কেশব ভারতীর সমাধি এবং শ্বেত মর্মরে কেশব-চৈতন্যের পায়ের ছাপ। ফটকের ডান দিকে রয়েছে গৌরাঙ্গের অন্যতম পার্ষদ দাস গদাধর ও মধু পরামাণিকের সমাধি। মন্দিরে রয়েছে গৌর-নিতাইয়ের বিগ্রহ। ১২টা থেকে ৪টে পর্যন্ত মন্দির বন্ধ।
সমূদ্র সমতল থেকে এই শহরের গড় উচ্চতা হল ২১ মি। ২০১১ সালের জন গননা অনুযায়ী কাটোয়ার জনসংখ্যা ৮১, ৬১৫ , ও এই শহরের জনঘনত্ব ৯,৬০০/বর্গকিমি।এর মধ্যে পুরুষ ৪১,৩৫০ (৫১%) এবং নারী ৪০,২৬৫ (৪৯%)। এখানে সাক্ষরতার হার ৮৭.১৩%। পুরুষদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৯০.২৫% এবং নারীদের মধ্যে এই হার ৮৩.৯৪%। এই শহরের জনসংখ্যার ৮.৩৩% হল ৬ বছর বা তার কম বয়সী। এই শহরের মোট আয়তন ৮.৫৩ বর্গকিমি ।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে এবং বিখ্যাত ধর্মপ্রচারক উইলিয়াম কেরির পুত্র উইলিয়াম কেরি জুনিয়রের মতো ধর্মপ্রচারকদের উৎসাহে, কাটোয়া একটি শহুরে এলাকায় পরিণত হয়। খ্রিস্টাব্দ ১৮৫০ সালে '10th Act of Municipal Rules' অনুযায়ী কাটোয়া একটি তেহসিল শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৮ চৈত্র ১২৭৫ বঙ্গাব্দ (১ এপ্রিল ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দ) কাটোয়া পৌরসভা সেই শহরের শাসন সত্তা হিসেবে স্থাপিত হয়। জানা যায় বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খান, তাঁর রাজত্বকালে (১১২৩-১১৩৩ বঙ্গাব্দ) প্রথম কাটোয়াতে একটি চৌকি প্রতিষ্ঠা করেন।
বাংলার নবাব আলীবর্দী খানের আমলে (রাজত্বকাল: ১১৪৭ – ১১৬২ বঙ্গাব্দ) নাগপুরের মারাঠা রাজা প্রথম রঘুজী ভোঁসলের মারাঠা সৈন্যরা এ অঞ্চলে লুটপাট শুরু করে। তারা কাটোয়ায় ঘাঁটি তৈরি করেছিল। কাটোয়া ভাগীরথী নদী ও অজয় নদের তীরবর্তী একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক স্থান। পৌষ ৯১৬ বঙ্গাব্দে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু এখানে কেশব ভারতীর কাছে দীক্ষা নেন। নাম হয় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যগিরি,তাই কাটোয়ার মাহাত্ম্য বৈষ্ণবতীর্থ হিসাবেও।
তাঁর সেই দীক্ষাস্থলের নাম এখন গৌরাঙ্গবাড়ি। কাটোয়ার গঙ্গা নদী ঘাটের কাছে রয়েছে কিছু ঐতিহাসিক মসজিদ , এখানে একটি সুড়ঙ্গ রয়েছে যা মুর্শিদাবাদের কাঠগোলা বাগানবাড়ি র সাথে সংযোগ রয়েছে।এই পথেই নবাবের সেনারা চলাচল করত। যদিও বর্তমানে বন্ধ রয়েছে সেই পথ। বৈষ্ণবতীর্থ কাটোয়ার আরেক আকর্ষণ মাধাইতলা।
নিমাইকে কলসির কানা ছুড়ে বিখ্যাত হওয়া মাণিকজোড়ের অন্যতম মাধাই। তাঁরই নামে মাধাইতলা। নিমাই ভাগীরথী পেরিয়ে কাটোয়া আসার পথে যে মাধবীকুঞ্জের নীচে বিশ্রাম করেছিলেন সেখানেই আজ মাধাইতলা। এখানেই শেষ জীবনে সাধনভজন করে কাটিয়েছিলেন মাধাই। দীর্ঘকাল জায়গাটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল। ১০৩৭ বঙ্গাব্দে এখানে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন বৃন্দাবনের গোপীনাথ দাস বাবাজি। এখানে গৌর-নিতাই, রাধাগোবিন্দ, গোপীনাথ রয়েছেন নিজেদের মন্দিরে। রয়েছে মাধাইয়ের সমাধিমন্দির।
সড়কপথে ও রেলপথে কাটোয়ার নেটওয়ার্ক বেশ বিস্তৃত কাটোয়া পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মহাসড়ক ৬ দ্বারা সিউড়ি ও শিবপুরের সঙ্গে সংযুক্ত, এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মহাসড়ক ১৪ দ্বারা বোলপুর ও পলাশীর সাথে সংযুক্ত। হুগলি নদী অতিক্রম করার সবচেয়ে নিকটবর্তী সেতু হচ্ছে ৪১ কি.মি. দক্ষিণে অবস্থিথ নবদ্বীপ-মায়াপুরের গৌরাঙ্গ সেতু। হাওড়া - আজিমগঞ্জ ও হাওড়া - কাটোয়া লাইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে স্টেশন হল কাটোয়া জংশন রেলওয়ে স্টেশন কাটোয়া লোকাল Katwa Local।
হাওড়া হতে উত্তরবঙ্গের রেলপথে গুরুত্বপূর্ণ জংশন হল কাটোয়া । এখানে কিছুকাল আগে পর্যন্ত কাটোয়া - আহমেদপুর ও কাটোয়া - বর্ধমান ঐতিহ্যবাহী ন্যারো গেজ রেল চলাচল করতো। বর্তমানে ন্যারো গেজের বদলে কাটোয়া-আহমাদপুর লাইন এবং কাটোয়া-বর্ধমান লাইন ব্রড গেজে উন্নতীকরণ হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের একটি অন্যতম শিক্ষাকেন্দ্র হল কাটোয়া । এখানে গড়ে উঠেছে সরকারি , বেসরকারি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।প্রায় ১১০ টির মতো উচ্চবিদ্যালয় আছে সমগ্র কাটোয়া মহকুমায়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কাটোয়া কাশীরাম দাস বিদ্যায়তন কাটোয়া জানকীলাল শিক্ষাসদন , কাটোয়া বালিকা বিদ্যালয়, কাটোয়া শ্রীরামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠ , কাটোয়া কাশীশ্বরী বালিকা বিদ্যালয় ,
কাটোয়া ভারতী ভবন উচ্চ বিদ্যালয় ,কাটোয়া আদর্শপল্লি উচ্চ বিদ্যালয় , কাটোয়া আদর্শপল্লি উচ্চ বিদ্যালয়। রয়েছে বেশ কিছু কলেজ।তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাটোয়া মহাবিদ্যালয় , কাটোয়া বেঙ্গল ইনস্টিটিউট অব্ টেকনোলজি , চন্দ্রপুর কলেজ সহ আরও বেশ কিছু কলেজ। এছাড়াও রয়েছে বেশ কিছু প্রশিক্ষণ কেন্দ্র , যেমন কাটোয়া সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান , বঙ্গ প্রৌদ্যোগিকী সংস্থান, কাটোয়া।কাটোয়া লিটল ম্যাগাজিন আর্কাইভ ও কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগার নামে দুটি গ্রন্থাগারও রয়েছে কাটোয়া শহরেই।
মূলত কৃষি ও ব্যবসার উপর নির্ভরশীল কাটোয়া ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষজন।অঞ্চলের কৃষি পণ্য বিপণনের জন্য এবং পার্শ্ববর্তী জনগোষ্ঠীর খুচরা ও ভোক্তা সেবা প্রদানের জন্য কাটোয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। আর শিল্প বলতে কুটিরশিল্প এবং চালকল বা পাটকল ইত্যাদি নানান ব্যবসার উপর নির্ভরশীল এই এলাকার মানুষজন।
শহুরে এলাকার মধ্যে, 0.৮১% শ্রমিক কৃষি খাতে নিযুক্ত, ৫.৯৬% শ্রমিক উৎপাদন খাতে নিযুক্ত, এবং ৯৩.৭০% শ্রমিক সেবা খাতে নিযুক্ত। কাটোয়া থেকে ৮ কি.মি. দূরে শ্রীখণ্ড গ্রামে সুপার থার্মাল পাওয়ার স্টেশন একটি সুপার-ক্রিটিকাল ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে , যা জাতীয় তাপবিদ্যুৎ নিগম লিমিটেডের আন্ডারে নির্মাণাধীন।
কাটোয়া শহরে রয়েছে বেশকিছু মন্দির ও মসজিদ। যা পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়।তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মাধাইতলা আশ্রম : শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর দুই বিখ্যাত শিষ্য, জগাই ও মাধাই পরিদর্শিত এই আশ্রম মাধাইতলা আশ্রম বলে পরিচিত। এবং বর্তমানে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
শ্রী শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর গুরু কেশব ভারতীর নিকট সন্নাস্যব্রতে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন শ্রী গৌরঙ্গ বারি মন্দিরে।যা কাটোয়ার দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে অন্যতম।এছাড়াও রয়েছে কাটোয়া কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির, কাটোয়া রূপেশ্বর মন্দির।এছাড়াও রয়েছে নবাব মুর্শিদকুলী খান দ্বারা নির্মিত, অষ্টদশ শতকের একটি প্ৰত্নতাত্ত্বিক নির্মাণ শাহ আলমের দরগাহ।রয়েছে কাটোয়া শাহি মসজিদ ।
এবং উইলিয়াম কেরি জুনিয়রের সমাধিও রয়েছে কাটোয়া শহরে। এছাড়াও কাটোয়া যার জন্য বিশেষ প্রসিদ্ধ তা হল কাটোয়ার কার্তিক লড়াই katwa kartik lorai । বৃহত্তর কাটোয়া এলাকায়, ২৫০-এর বেশি সমিতি কার্তিক পুজো সংগঠন করে এবং একে অপরে প্যান্ডেলের অলঙ্করণ বা দেবতার ভাস্কর্যের উপর প্রতিযোগিতা করে।যা কার্তিক লড়াই নামে পরিচিত।এছাড়াও পহেলা বৈশাখ , রথযাত্রা , দুর্গা পুজো , জগদ্ধাত্রী পুজো , কালী পুজো , কার্তিক লড়াই , সরস্বতী পুজো , গৌড়-পূর্ণিমা, চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মদিন , দোল উৎসব কাটোয়ার জনপ্রিয় উৎসব।