খাশাবা দাদাসাহেব যাদব এর জীবনী

খাশাবা দাদাসাহেব যাদব এর জীবনী

অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় স্বাধীন ভারতের হয়ে প্রথম ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করে ভারতের ক্রীড়া-ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছেন ভারতীয় কুস্তিগীর খাশাবা দাদাসাহেব যাদব (Khasaba Dadasaheb Jadav)। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি অলিম্পিকে এককভাবে পদকজয় করেছেন। কুস্তি খেলাকে সর্বভারতীয় স্তর পেরিয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছিলেন খাশাবা দাদাসাহেব যাদব এবং তিনিই ছিলেন একমাত্র অলিম্পিকজয়ী যিনি পদ্ম পুরস্কারে ভূষিত হননি।

মহারাষ্ট্রের খাশাবা দাদাসাহেব যাদবকেই আধুনিক ভারতীয় কুস্তির জনক বলা চলে। ১৯২৬ সালের ১৫ জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলায় করদ তালুকের গোলেশ্বর গ্রামে এক ক্রীড়ামোদী পরিবারে খাশাবা দাদাসাহেব যাদবের জন্ম হয়। তাঁর বাবা দাদাসাহেব যাদব তৎকালীন সময়ের এক বিখ্যাত কুস্তিগীর ছিলেন এবং তাঁর পাঁচটি সন্তানের মধ্যে খাশাবা যাদব ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। খাশাবার বাবা নিজে হাতে কুস্তি শিখিয়েছিলেন খাশাবাকে।

ছোটো থেকেই খাশাবা কুস্তি দেখতে ভালোবাসতেন। মাত্র চার বছর বয়স থেকেই তাঁর বাবার সঙ্গে খাশাবা বিভিন্ন আখড়ায় কুস্তি দেখতে যেতেন। দশ বছর বয়স হওয়া মাত্র বাবার উৎসাহে ও উদ্যোগে খাশাবা একটি কুস্তির আখড়ায় ভর্তি হন। ধীরে ধীরে কুস্তিতে তাঁর দক্ষতার কথা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ঐ বয়সেই তাঁর থেকে বড়ো বড়ো চেহারার পালোয়ানকে কীভাবে তিনি অনায়াসে ধরাশায়ী করতেন তা দেখতে বহু লোকের ভিড় হতো আখড়ায়।

কুস্তি ছাড়াও খাশাবার কবাডি, দৌড়, সাঁতার, জিমন্যাস্টিকে উৎসাহ ছিল এবং এই সব খেলায় বিভিন্ন সময় তিনি অংশগ্রহণ করতেন। ১৯৪০ সালে করদের তিলক হাই স্কুলে খাশাবার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করে কোলাপুরের রাজারাম কলেজে ভর্তি হন খাশাবা। এই কলেজে পড়াকালীনই কুস্তিতে আরো বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েন তিনি। বিভিন্ন রাজ্যস্তরের ও দেশীয় স্তরের কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করেন তিনি।

খাশাবার সাধারণ মানের ছিপছিপে চেহারা দেখে কলেজের ক্রীড়া-প্রশিক্ষক তাঁকে কুস্তি প্রতিযোগিতায় মনোনীত করতে চাননি। শেষে কলেজের অধ্যক্ষের কাছে আবেদন করে কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন তিনি এবং তাঁর থেকে ভারী চেহারার সব প্রতিযোগীদের অনায়াসে কুস্তিতে পরাজিত করে তিনি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

এই কলেজেই কুস্তিগীর বাবুরাও বালাওয়াডে এবং বেলাপুরি গুরুজির কাছে কুস্তির প্রশিক্ষণ শুরু করেন খাশাবা এবং ১৯৪৮ সালে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে প্রতিদ্বন্দ্বী নিরঞ্জন দাসকে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। এরপরেই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় অলিম্পিকে যোগদানের ঘটনা। বলা যায় সেটাই তাঁর ক্রীড়াজীবনের সাফল্যের সূত্রপাত।

কোলাপুরের মহারাজ খাশাবার এই অলিম্পিকে অংশগ্রহণের সমস্ত খরচ বহন করেছিলেন সেই বছর। ১৯৪৮ সালের লণ্ডন অলিম্পিকে যোগ দিয়ে খাশাবা বুঝতে পারেন যে ভারতের এবং আন্তর্জাতিক স্তরের কুস্তিখেলার নিয়ম এক নয়। ভারতে অন্যান্য সকল কুস্তিগীরের মতো তিনিও শক্ত মাটিতে কুস্তি খেলে অভ্যস্ত। কিন্তু অলিম্পিকে কুস্তি হত ম্যাটের ওপর। ম্যাটের উপর কুস্তি করতে অনভ্যস্ত খাশাবা প্রথমবার জয়লাভে অসমর্থ হন। তারপরেও দর্শকদের মন জয় করে ফ্রি-স্টাইল কুস্তিতে তিনি বিয়াল্লিশ জন প্রতিযোগীর মধ্যে ষষ্ঠ স্থান অর্জন করেন।

প্রতিযোগিতা চলাকালীন তাঁর প্রশিক্ষক ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিস গার্ডনার। অলিম্পিকে ষষ্ঠ স্থান অর্জন করলেও অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত কুস্তিগীর বার্ট হ্যারিস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিলি জার্নিগ্যান প্রমুখকে অনায়াসে পরাজিত করে দর্শকদের মন জয় করেন খাশাবা। শেষে ইরানের কুস্তিগীর মনসুর রেইসির কাছে তিনি পরাজিত হন। ১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কিতে আয়োজিত অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় এরপর আবার অংশ গ্রহণ করেন খাশাবা দাদাসাহেব যাদব।

সেই সময়ে অলিম্পিকে যোগদানের, যাতায়াত এবং থাকা-খাওয়ার খরচ নিজেকেই যোগাড় করতে হতো যা খাশাবার কাছে দুঃসাধ্য ছিল। তৎকালীন বম্বের মুখ্যমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের কাছে চিঠি লিখেও সরকারের তরফে কোনোপ্রকার সাহায্য পাননি। শেষ পর্যন্ত রাজারাম কলেজের অধ্যক্ষ তাঁর নিজের বাড়িটি বন্ধক রেখে খাশাবার জন্য সাত হাজার টাকা সংগ্রহ করেন। এরপরেও অতিরিক্ত আরো বারো হাজার টাকা সংগ্রহের প্রয়োজন ছিল। খাশাবার প্রশিক্ষক গোবিন্দ পুরন্দরে মহারাষ্ট্র গ্রামীণ সমবায় ব্যাঙ্ক থেকে তিন হাজার টাকা ধার করেছিলেন বলে জানা যায়।

এছাড়াও তাঁর গ্রামের বহু লোক সেসময় তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। এই সাহায্যের জোরে খাশাবা অলিম্পিকে যোগ দিতে পারলেও তাঁর সামনে সবথেকে বড়ো চ্যালেঞ্জ ছিল এবারে ম্যাটের উপরে কুস্তি লড়ে জিতে আসা। এই সুযোগ তিনি আর হারাতে চাননি। প্রথম পাঁচটি খেলায় যথাক্রমে কানাডার অ্যাড্রিয়েন পলিকিন, মেক্সিকোর লিওনার্দো বাসুর্তো এবং জার্মানির ফার্দিনান্দ স্মিৎজকে পরাজিত করে তিনি পরপর অনায়াসে জয়লাভ করেন যেখানে প্রতিটি ম্যাচ মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই শেষ করেছিলেন খাশাবা।

কিন্তু এরপরে ষষ্ঠ খেলায় জাপানের প্রতিযোগী সোহাচি ইশিকে মাত্র এক পয়েন্টের জন্য পরাজিত করতে ব্যর্থ হন তিনি। পনেরো মিনিট ধরে কুস্তি চলেছিল উভয়ের। এরপরেই ঘটে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। নিয়মমাফিক প্রতিটি কুস্তিখেলার পরে আধ ঘন্টার একটি বিরতি পাওয়ার কথা খাশাবার। কিন্তু জাপানের কুস্তিগীরের সঙ্গে লড়ার পরই সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে বলা হয় রাশিয়ান কুস্তিগীর রশিদ মামাবেয়োভের সঙ্গে কুস্তি লড়তে। কোনো বিরতি পাননি খাশাবা। এমনকি তাঁর পক্ষে কথা বলার মতো কোনো ভারতীয় প্রশাসনিক অধিকর্তা খেলায় উপস্থিত ছিলেন না। ফলে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত শরীরে কুস্তি লড়ে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হন খাশাবা।

মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে প্রথম ভারতীয় হিসেবে ব্রোঞ্জ পদক জয় করেন খাশাবা দাদাসাহেব যাদব। অধ্যাপক সঞ্জয় দুধানের লেখা ‘অলিম্পিকবীর খাশাবা যাদব’ গ্রন্থ অনুসারে জানা যায় যে, তৎকালীন পাতিয়ালার মহারাজা এবং একইসঙ্গে ভারতীয় অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি যাদবেন্দ্র সিংকে খাশাবা একটি প্রতিবাদপত্র বা অভিযোগপত্র লিখেছিলেন যাতে ১৯৫২ সালের মাদ্রাজে আয়োজিত জাতীয় খেলায় কীভাবে অনৈতিকভাবে তাঁকে স্বর্ণপদক থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল তার বর্ণনা রয়েছে এবং এই বিষয়ে সুবিচার প্রার্থনা করে চিঠি লিখেছিলেন খাশাবা।

তাঁর এই সুবিচার প্রার্থনাই ভারতীয় অলিম্পিক দলে তাঁর যোগদানের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। খাশাবার পাশাপাশি পাঞ্জাবেরও কিছু কুস্তিগীর সেই জাতীয় প্রতিযোগিতা কর্তৃপক্ষের পক্ষপাতিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলায় অবশেষে ১৯৫২ সালে কলকাতায় একটি নির্বাচনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় যাতে খাশাবার জয় হেলসিঙ্কিতে অলিম্পিকে যোগদানের পিছনে সহায়তা করেছিল। হেলিসিঙ্কি থেকে দেশে ফেরার পরে সমগ্র দেশবাসী তাঁকে সাদরে অভ্যর্থনা জানায়। গোলেশ্বর গ্রামে তাঁর জন্য দেড়শো গরুর গাড়ির আয়োজন করা হয়েছিল।

কিন্তু তাঁর এই জয়ের সংবাদে দেশে কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়নি, কোনো সংবাদপত্রেই সেভাবে তাঁর ব্রোঞ্জ পদক জয়ের বিষয়ে লেখেনি। ১৯৫৬ সালের অলিম্পিকে আঘাতের কারণে যোগ দিতে পারেননি খাশাবা। ১৯৫৩ সালে বম্বে পুলিশ বিভাগে সাব-ইন্সপেক্টর পদে যোগ দিয়ে দীর্ঘ তিরিশ বছর কাজ করে ১৯৮৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন খাশাবা। অবসর গ্রহণের সময় তিনি মহারাষ্ট্রের সহকারী পুলিশ কমিশনার পদে উন্নীত হয়েছিলেন।

সমগ্র জীবনে অলিম্পিক পদক ছাড়া বিশেষ কোনো পুরস্কার বা সম্মান পাননি খাশাবা। তার পরিবর্তে অবসর গ্রহণের পরে সাতারাতেই বাড়ি তৈরির জন্য তাঁকে স্ত্রীয়ের গয়নাও বিক্রি করতে হয়েছিল। ১৯৯২ সালে মহারাষ্ট্র সরকার তাঁকে মরণোত্তর ছত্রপতি পুরস্কার প্রদান করেন। ২০০১ সালে তাঁকে মরণোত্তর অর্জুন পুরস্কার দেওয়া হয়।

২০১০ সালে ভারত সরকার দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী স্পোর্টস কমপ্লেক্সের নাম বদলে খাশাবা দাদাসাহেবের স্মৃতিতে কে. ডি যাদব স্টেডিয়াম রাখে। আন্তর্জাতিক কুস্তিগীর এবং বর্তমানে প্রযোজক সংগ্রাম সিং খাশাবা যাদবের জীবন নিয়ে একটি চলচ্চিত্র বানাতে উদ্যোগী হয়েছেন এবং সেইজন্যে খাশাবার পুত্র রঞ্জিত যাদবের থেকে তিনি অনুমতিও নিয়েছেন। এই চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে ভারতীয় ক্রীড়ার ইতিহাসে বিস্মৃতপ্রায় খাশাবা যাদবকে শ্রদ্ধা জানাতে চান সংগ্রাম সিং। ১৯৮৪ সালের ১৪ আগস্ট একটি সড়ক দুর্ঘটনায় খাশাবা দাদাসাহেব যাদবের মৃত্যু হয়।