কেরাডু মন্দির দর্শন

কেরাডু মন্দির দর্শন

রাজস্থানের মাটিতে লুকিয়ে আছে বহু রহস্য। রাজস্থানের কুলধারা গ্রাম এবং ভানগড় ফোর্ট এমনই একটি রহস্যময় স্থান যা ভূতুড়ে জায়গা নামে পরিচিত। এ ছাড়াও আরও একটি রহস্যময় স্থান রাজস্থানেরই বারমের জেলাতে অবস্থিত। মরুভূমি ঘেঁষা বারমের শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে সিহনি গ্রামে রয়েছে অভিশপ্ত কিরাডু মন্দির Kiradu Mandir  ।

আপনি যদি অ্যাডভেঞ্চার বা রহস্য রোমাঞ্চ পছন্দ করেন, তা হলে আপনাকে যেতেই হবে কিরাডু নামক এই রহস্যময় মন্দিরে৷ এই মন্দির আপনাকে এক অন্য রকম অনুভূতি এনে দেবেই৷ একে মরু-ঘেঁষা এক ভূপ্রকৃতি, তার উপরে শুকনো হাওয়ার দীর্ঘশ্বাস। দিনের বেলাতেই কিরাডু কেমন যেন গা-ছমছমে। মন্দিরে প্রবেশের সদর দরজা জং ধরে অকেজো হয়ে বহুকাল বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে।

মন্দির চত্বরে প্রবেশ করতে গেলে একটা ছোট দরজা ব্যবহার করতে হয়। কিংবদন্তি অনুসারে কিরাডুর আদি নাম ‘কিরাডকোট’ বা ‘কিরাদকোট’। ষষ্ঠ শতকে কিরাদ-বংশীয় রাজপুতরা এখানে রাজত্ব করতেন। তাঁরাই এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কিরাদ বংশের সকলেই ছিলেন শিবভক্ত। তাই মন্দিরের অধিষ্ঠাতা দেবতা হলেন শিব। স্থানীয়দের বিশ্বাসে এই মন্দির যেমন অভিশপ্ত তেমনই রহস্যময়।

খাজুরাহো মন্দিরের সঙ্গে এর মিল থাকায় এই মন্দিরটি ‘রাজস্থানের খাজুরাহো’ নামে পরিচিত৷ এই মন্দিরের ভাস্কর্য প্রেমিক-প্রেমিকাদের বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করবে। এই মন্দিরে নাকি এমন ভাস্কর্যও দেখা যায় যা বৃষ্টির পূর্বাভাস নিখুঁত ভাবে বলে দিতে পারে। এহেন মন্দিরে রাত্রিবাস তো দূরে থাক, সন্ধের পরে মন্দিরের এক কিলোমিটার কাছাকাছিও কেউ আসেন না। সম্পূর্ণ জনশূন্য হয়ে যায় মন্দির চত্বর।     

কেন জানেন? স্থানীয়দের বিশ্বাস, সন্ধের পর যদি কেউ এই মন্দিরে প্রবেশ করেন, হয় তাঁর মৃত্যু হয়, নইলে পরিণত হন পাথরের মূর্তিতে! গ্রামবাসীদের বিশ্বাস রাত নামলেই নাকি মানুষের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ মন্দিরের পাথর ভেদ করে বেরিয়ে আসে৷ অভিশপ্ত ছায়ামূর্তিরা মন্দির চত্বরে ঘুরে বেড়ায়। স্থানীয়দের মনে হঠাৎ এমন বিশ্বাস গড়ে উঠল কেন?

নেপথ্যে রয়েছে একটি কাহিনি। বারো শতকের পারমার রাজবংশে সোমেশ্বর নামে এক রাজা ছিলেন৷ তাঁর আমলেই তুর্কি আক্রমণ ঘটে৷ তুর্কি আক্রমণে যারপরনাই ক্ষতিগ্রস্ত হন রাজা সোমেশ্বর৷ এর পর থেকে অন্য বিদেশি আক্রমণের ভয়ে ভীত হয়ে পড়েন তিনি। এই ক্ষতি ও ভয় থেকে ঘুরে দাঁড়াতে রাজা এক সন্ন্যাসীর শরণাপন্ন হন। সেই সন্ন্যাসী তাঁর শিষ্যদের নিয়ে কিরাডু মন্দিরে আস্তানা করেন। সন্ন্যাসীর আশীর্বাদে পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে বারমের জেলা আবার সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই শিষ্যদের কথা গ্রামবাসীরা আর মনে রাখে না।

একদিন এক শিষ্য গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, কিন্তু গ্রামবাসীরা তাঁকে কোনও ভাবে সাহায্য করেন না।  গ্রামবাসীদের এ হেন আচরণে মারাত্মক রেগে যান সন্ন্যাসী। তিনি অভিশাপ দেন— যে সমস্ত মানুষের হৃদয় পাষাণের মতো, তাদের মানুষের রূপে থাকার কোনও অধিকার নেই! পাথর হয়ে যাওয়া উচিত। সন্ন্যাসীর অভিশাপে সেই দিন সন্ধেবেলাই সমস্ত গ্রামবাসী পাথরে পরিণত হলেন।

গ্রামবাসীদের মধ্যে শুধুমাত্র একজন মহিলা অবশ্য সেই শিষ্যটিকে সাহায্য করেছিলেন! সন্ন্যাসীর তাঁর উপর দয়া হয়। তিনি মহিলাকে বলেন, ওই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে। না হলে সে-ও পাথরের মূর্তিতে পরিণত হবেন। কিন্তু যাওয়ার সময় সে যেন ভুলেও পিছন ফিরে না তাকায়। কিন্তু মহিলাটি সন্ন্যাসীর কথা না শুনে কৌতূহলবশত পেছন ফিরে তাকান এবং মুহূর্তে পাথরের মূর্তি হয়ে যান!

সেই থেকে বারমের জেলার বাসিন্দাদের মনে বিশ্বাস, সন্ধের পর কিরাডু মন্দিরে প্রবেশ করলে মানুষ পাথর হয়ে যায়! এর কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই, কিন্তু আজও মানুষ এই বিশ্বাসকেই মনে আঁকড়ে ধরে রয়েছেন! সন্ন্যাসীর এই অভিশাপ এবং কিরাডুর এই ঘটনার বাস্তব কোনও প্রমাণ না থাকলেও গ্রামবাসীরা সন্ধেবেলা এই মন্দিরকে এড়িয়েই চলেন।