কোণার্ক সূর্য মন্দিরঃ অলৌকিক রহস্যে ঘেরা উড়িষ্যার কোণার্ক সূর্য মন্দির

পুরী থেকে ৩৫ কি.মি এবং ভুবনেশ্বর থেকে ৬৫ কি.মি দূরে অবস্থিত উড়িষ্যার বিশ্ববিখ্যাত কোণার্কের সূর্য মন্দির।ঐতিহাসিকদের মতে ১২৫৫ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব গঙ্গ রাজবংশের রাজা প্রথম নরসিংহদেব,নিজের বাংলা জয়ের স্মৃতিতে চন্দ্রভাগা নদীর তীরে প্রাচীন মৈত্রিয়ারণে( আজকের কোণার্ক)এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। আবার অনেকে বলেন,এই মন্দির একসময়ে সমুদ্রের কাছেই ছিল।কিংবদন্তি অনুসারে কৃষ্ণপুত্র শাম্ব এই স্থানে সূর্যদেবের উপাসনা করেন,কঠিণ কুষ্ঠ রোগ থেকে মুক্তি পেতে।তাই এখানে সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয় সূর্যমন্দির।
গ্রিক উপকথার সূর্যদেবতা হিলিয়াসের মতো ভারতীয় উপমহাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজনীয় সুরিয়া (এ লেখায় সূর্য দেবতাকে সুরিয়া নামেই সম্বোধন করা হয়েছে) দেবতারও রয়েছে একটি দর্শনীয় রথ, যাতে চড়ে তিনি আকাশে ঘুরে বেড়ান। তাই দেবতার সম্মানে কোনার্কের সম্পূর্ণ সূর্য মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছে একটি অতিকায় রথের মতো করে। সাতটি তেজী ঘোড়া টগবগিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ১২ জোড়া চাকার উপর অবস্থিত একটি অতিকায় রথকে, যেটি আসলে মূল মন্দির। আর এর পুরোটাই পাথরে খোদাই করা ভারী কারুকাজে পরিপূর্ণ।
প্রাচীন সমস্ত সভ্যতাতেই সূর্য উপাসনার প্রমাণ মেলে।তবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির সমস্ত সূর্যমন্দিরের মধ্যে প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় সূর্যমন্দির এই কোণার্কেই অবস্থিত। সংস্কৃত শব্দ কোনা বা কোণ এবং আর্ক বা সূর্য শব্দের সমন্বয়ে এই কোণার্ক নামকরণ।মনে করা হয়,এই মন্দিরে আগে সূর্যদেবতার মূর্তি ছিল,যেটি নরশিমা দেব পুরীর মন্দিরে নিয়ে গিয়ে স্থাপন করেন। কালের গ্রাসে এই মন্দিরের অনেকটাই নিশ্চিহ্ন।
কামদ ভাস্কর্যের জন্য কোনার্কের সূর্য মন্দিরের জুড়ি মেলা ভার। মানব জীবনের আদিম প্রবৃত্তিকে পাথরের মাঝে এমন সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তোলায় এ মন্দিরটি শুধু উড়িষ্যার নয়, পুরো ভারতেরই সবচেয়ে সুন্দর মন্দিরগুলোর একটি। বাস্তবতা আর আধ্যাত্মিকতা এর প্রতিটি দেয়ালে মিলেমিশে দুইয়ের মধ্যে এক কাব্যিক মেলবন্ধন গড়ে তুলেছে। কিন্তু কালে কালে ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ায় এর প্রকৃত সৌন্দর্য থেকে যে আমরা বঞ্চিত হয়েছি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মাটি থেকে দু'শতাধিক ফুট উপরে অবস্থিত মন্দিরটির দেবতার মূর্তির জন্য পবিত্র বেদীটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। প্রবেশপথের নত মন্দিরেরও যে অংশটুকু দেখা যায় তা এক-তৃতীয়াংশেরও কম। তথাপি যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তাতেই এ মন্দিরটি অন্যগুলোর চেয়ে অনন্য।
মন্দিরের দেয়াল ও বেদীর ভাস্কর্য এবং খোদাই করা পাথুরে কাজগুলোকে দু'ভাগে ভাগ করা সম্ভব। একটি উপরের অংশ, অন্যটি নীচের। স্পষ্টত উপরের কাজগুলো নীচেরগুলোর চেয়ে অধিক নিপুণ এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত। উপরের অংশে মূলত বিভিন্ন পৌরাণিক পশুপাখি ও দেব-দেবীর ছবি রয়েছে। মা দূর্গার মহিষাসুরকে হত্যার ছবি, নিবিষ্টচিত্ত বিষ্ণু আর শিবলিঙ্গই এদের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয়। তবে কৃষ্ণ, সরস্বতী আর গণেশের ভাস্কর্যও ছিল, যেগুলো ব্রিটিশ শাসনামলে লুণ্ঠিত হয়েছে। এরকম কিছু অত্যন্ত চমৎকার ভাস্কর্য বর্তমানে শোভা পাচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জাদুঘরে।
ইতিহাস ঘাটলেও এই মন্দিরের ওপর আক্রমণের কাহিনীও পাওয়া যায়।১৫০৮ সালে কালাপাহাড় এই মন্দির আক্রমণ করেন।তারপর দ্বিতীয় নরসিংহবর্মন এবং তারও পর নরশিমাদেব কোণার্ক মন্দির থেকে বহু কারুকাজ,স্তম্ভ,নবগ্রহশিলা নিয়ে পুরীতে স্থাপন করেন।মারাঠা শাসনকালেও এই মন্দিরের ওপর আঘাত আসে।পর্তুগীজ জলদস্যুদের ক্রমাগত আক্রমণ চলে কোণার্কের ওপর।তারা মন্দিরের মাথায় অবস্থিত শক্তিশালী চুম্বককে নষ্ট করে।একসময় এই মন্দির জলদস্যুও ডাকাতদের আস্তানায় পরিণত হয়।
মন্দিরের বহু অংশ বালির তলায় চাপা পড়ে যায়। স্বজাতি,বিদেশিদের আক্রমণে জর্জরিত এই মন্দির পুনরুদ্ধার হয় ১৯০৪ সালে লর্ড কার্জনের শাসনকালে।এখন কোণার্ক মন্দির বলতে যা দেখে আমরা মোহিত হই, ওটা আসলে জগমোহন। তার ঠিক পিছনের বিশালাকার অংশটিকে দেউল বলে, যেটির অস্তিত্ব এখন আর নেই। ওড়িশায় টেম্পল আর্কিচেটারের সাধারণত চারটি মেন পার্ট।
কোনার্ক সূর্য মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছিল চন্দ্রভাগা নদীর তীরে। কিন্তু কালের বিবর্তনে নদীটির গতিপথ বেঁকে যায়। ফলে মন্দির থেকে নদীটির দূরত্ব বর্তমানে কয়েক কিলোমিটারের মতো। এটি নির্মাণ করা হয় কলিঙ্গ স্থাপত্যশৈলী অনুসরণ করে। পূর্বদিকে মুখ করে রাখা হয়েছে এর প্রবেশদ্বার এবং দেবতার আসন (বেদী)। ফলে প্রতিদিন ভোরবেলায় সূর্যের প্রথম আভা সরাসরি দেবতাকে ছুঁয়ে যায়। ভারতবর্ষের বাইরে থেকে আনা খন্দালাইত পাথরে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয় এর। অন্যদিকে, পুরো মন্দিরে রয়েছে ১২ জোড়া নিখুঁত সূর্যঘড়ি, যেগুলো দিয়ে মিনিট পর্যন্ত সঠিকভাবে হিসাব করা যায়। ১২ জোড়া সংখ্যাটা চেনা চেনা লাগছে না? হ্যাঁ, কোনার্ক সূর্য মন্দিরের ১২ জোড়া রথের চাকার প্রতিটিই একেকটি সূর্যঘড়ি!
আজও প্রতিদিন প্রভাতের প্রথম রবিকিরণ মন্দিরের প্রাঙ্গণকে ছুঁয়ে যায়।পুরো মন্দিরটি একটা রথের আকৃতির।যা সাতটি ঘোড়া দ্বারা বাহিত,যে সাতটি ঘোড়া সূর্যের আলোর সাত রঙের প্রতীক।সূর্যের আলো যে সাতরঙের মিশ্রণ,এই বৈজ্ঞানিক সত্য নিউটনের জন্মের ৪০০ বছর আগে,কোণার্ক মন্দির নির্মাণের সময় তার কারিগররা জানতেন! রথাকৃতি এই মন্দিরের ১২ জোড়া চাকা,এই ১২ জোড়া বা ২৪টি চাকা আসলে এক একটি সূর্যঘড়ি।যেগুলির মধ্যে দুটি দিয়ে এখনো নির্ভুল সময় মাপা সম্ভব।
এই ১২ জোড়া চাকা হল ১২ মাস বা ২৪ পক্ষ।প্রত্যেকটি চাকায় ৮ টি করে স্পোক,দিনের অষ্টপ্রহরকে চিহ্নিত করে।প্রতিটি চাকার একপাশে ১২টি মাস আর অপর পাশে ১২টি রাশির প্রতীকী চিত্র অঙ্কিত। মূল প্রবেশদ্বারের হাতিকে পরাস্ত করা সিংহদ্বয়ের মূর্তিকে অনেকে বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্মের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করেন।তবে এই মন্দিরের ভাস্কর্য বিস্ময়কর। শুধু ধর্মীয় নয়,মানুষের জীবনগাথা জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই মন্দিরগাত্রে পাথরে খোদাই হয়ে।বাস্তবতা আর আধ্যাত্মিকতার মেলবন্ধন এই মন্দিরকে অনন্যতা দান করেছে। জ্যামিতিক প্যাটার্নের ফুল,নক্সার সাথে দেবতা ও মানুষের প্রেম,বিরহ,রতিক্রীড়ার মতো জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতিও এই মন্দিরগাত্রের কারুকার্যের উপজীব্য।
তাই একদা রবিঠাকুর বলেছিলেন-“এখানে পাথরের ভাষা মানুষের ভাষাকে হার মানিয়েছে”। এই মন্দিরকে পতুর্গীজ নাবিকরা একসময় ব্ল্যাক প্যাগোডা আর পুরীর জগন্নাথ মন্দিরকে হোয়াইট প্যাগোডা বলতো। শুধু রথের আকৃতির নাটমন্দির নয়,এই মন্দিরের আরোও কয়েকটি আকর্ষণ হল নৃত্যপ্রাঙ্গন,ছায়া মন্দির,মায়ামন্দির,ভোগমন্ডপ প্রভৃতি। এই মন্দিরের সাথে ওড়িশি নৃত্যশৈলীর প্রাচীন যোগ রয়েছে।মন্দিরগাত্রে ওড়িশি নৃত্যশৈলীর বিভিন্ন ভঙ্গিমা খোদিত আছে।এখনো প্রতি ডিসেম্বরে মন্দির প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয় নৃত্য উৎসব।যাতে যোগ দিতে আসেন,দেশ বিদেশের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পীগণ। কালের এবং মানুষের আঘাত সহ্য করেও এই মন্দির আজও লাখো দর্শনার্থীর কাছে অপার বিস্ময়ের প্রতিভূ।১৯৮৪ সালে UNESCO এই মন্দিরকে বিশ্বঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।