কার্শিয়াং

দার্জিলিং জেলার মনোরম সৌন্দর্যস্নাত একটি শৈলশহর কার্শিয়াং (Kurseong)। এই শহর কার্শিয়াং সাবডিভিশনের প্রধান দপ্তর। সমুদ্রতল থেকে প্রায় ৪৮৬৪ ফুট উচ্চতায় দার্জিলিং শহর থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে ২৬°৫২′৪০″ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮°১৬′৩৮″ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত কার্শিয়াং। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে দ্বারা ৩৪ কিলোমিটার দূরে শিলিগুড়ির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এই শহর।
এই শৈলশহরের নিকটবর্তী বিমানবন্দর হল বাগডোগরা আর নিকটবর্তী রেলস্টেশন হল নিউ জলপাইগুড়ি। শুভ্র অর্কিডের মায়াবী আহ্বানে বহুকাল ধরে পর্যটকদের মন কেড়েছে এই শহর। এই শহরের আদি বাসিন্দা লেপচারা। শোনা যায়, তাদের ভাষায় ‘কার্শন-রিপ্’ নামক অর্কিডের নাম থেকেই এই শহরের নাম হয়েছে কার্শিয়াং। লেপচা ভাষায় ‘কার্শিয়াং’ শব্দের অর্থ – ছোট্ট অর্কিড।
কার্শন-রিপ্ নামক ছোট্ট সাদা অর্কিডের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে এই শৈলশহরের নামকরণের ইতিহাস। সমস্ত শহর জুড়ে চাঁদের আলোর মতো শ্বেত-শুভ্র অর্কিড ফুটে থাকে, স্থানীয় লেপচারা একে বলে ‘খর্সন’ আর অনেকে বলেন সেই জন্যে এই পাহাড়ের অংশের নামও তারা দিয়েছিল ‘খর্সং’ যার অন্য একটি অর্থ আছে – ভোরের তারা।
সকালের ফুল ফোটার সঙ্গে আকাশের তারাদের সৌন্দর্যের তুলনা করে এমন উপমামণ্ডিত নাম দিয়েছিল লেপচারা। ফলে খর্সং থেকে নাম হল কার্শিয়াং। এমন একটি ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়। ব্রিটিশরা ভারতে আসার আগে থেকেই এই শহর সিকিমের রাজত্বের অধীনে ছিল। আনুমানিক ১৭৮০ সাল নাগাদ নেপালিরা কার্শিয়াং এবং তার আশেপাশের বেশ কয়েকটি এলাকা দখল করে নেয়।
এরপরে গোর্খা যুদ্ধের সময় নেপালিরা হেরে যায় গোর্খাদের কাছে আর ১৮১৭ সালে টিটালিয়ার চুক্তিতে কার্শিয়াং পুনরায় সিকিমের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়। ব্রিটিশদের কাছে গ্রীষ্মকালে এখানকার শীতল-শুষ্ক আবহাওয়া খুবই উপভোগ্য মনে হয়েছিল যদিও সমতল থেকে পাহাড় ডিঙিয়ে এতখানি উচ্চতায় উঠে আসা সেসময় দুরূহ ছিল। টিটালিয়ার থেকে কার্শিয়াং হয়ে দার্জিলিং যাবার একটা পথ তৈরি হয় প্রথম ১৭৭০-৮০ সাল নাগাদ। এরপরে মিলিটারি রোড এবং তারও পরে ১৮৬১ সালে নির্মিত হয় হিলকার্ট রোড।
১৮৩৫ সালে ব্রিটিশরা এই দার্জিলিংয়ে একটি আরোগ্যভবন বা স্বাস্থ্যনিবাস (Sanatorium) গড়ে তোলে। একইসঙ্গে তৈরি হয় মিলিটারিদের সপরিবারে গরমকালের অবকাশ যাপনের স্থান। সিকিমের ছোগিয়াল অর্থাৎ রাজা তুষুপুড় নামগ্যলের কাছ থেকে দার্জিলিংয়ের বুকে এক চিলতে জমি পেয়ে যান ব্রিটিশরা এই কার্শিয়াংয়ে, তাও আবার বার্ষিক সামান্য কিছু মূল্যের বিনিময়ে।
দার্জিলিং যাওয়ার পথে অন্যতম শৈলশহর হিসেবেই কার্শিয়াং ধীরে ধীরে উন্নত হয়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের সবথেকে প্রাচীন মিউনিসিপ্যালিটি রয়েছে এই শহরে। দার্জিলিং জেলা গড়ে ওঠার পর থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত কার্শিয়াং কোনো সাব-ডিভিশন ছিল না, সেই সময়েই ১৮৭৯ সাল পর্যন্ত কার্শিয়াং-এ একটি স্বাধীন মিউনিসিপ্যালিটি গড়ে উঠেছিল।
বাংলা প্রেসিডেন্সির রাজশাহি ডিভিশনে প্রথমে কার্শিয়াংকে যুক্ত করেন ব্রিটিশরা, পরে ১৯০৮ সালে তা যুক্ত হয় ভাগলপুর ডিভিশনে। স্বাধীনতার আগে কার্শিয়াংয়ে ১২ জন ওয়ার্ড কমিশনার ছিলেন এবং আশ্চর্যের বিষয় এই যে ১৯৩৯ সাল থেকে এখানে মিউনিসিপ্যালিটির নিজস্ব উদ্যোগে পৌরপ্রধান নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলতো। ফলে বোঝাই যাচ্ছে কার্শিয়াংয়ের ইতিহাস সুপ্রাচীন এবং স্বাধীনতার আগে থেকেই এই শৈলশহর বিবর্তিত হতে হতে আজকের রূপ নিয়েছে।
ব্রিটিশরা কেন এই কার্শিয়াং কে স্বাস্থ্যোদ্ধার স্থান হিসেবে অপরিহার্য মনে করেছিল এই প্রশ্নের উত্তরে জানা যায় সমতল থেকে কাজ করার জন্য শ্রমিকদেরকে নিয়ে যাওয়া হত দার্জিলিংয়ে। কিন্তু তিতালিয়া থেকে পাঙ্খাবাড়ি হয়ে দার্জিলিংয়ের পথে একটাও বিশ্রামের জায়গা নেই, তাই ৪৭৮৩ ফুট উঁচুতে এই কার্শিয়াং শহর আবিষ্কার করে ফেলে ব্রিটিশরা। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যাবে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ভগিনী নিবেদিতা এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বিখ্যাত স্বনামধন্য মানুষের পদচিহ্ন রয়েছে এই শৈলশহরের বুকে।
বিখ্যাত ইংরেজ কবি মার্ক টোয়েনও এসেছিলেন কার্শিয়াং য়ে ১৮৮৫ সাল নাগাদ। কার্শিয়াং থেকে ৪ কিমি দূরে গিদ্দা পাহাড়ে ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ সরকারের কাছে কিছুদিন বন্দী ছিলেন নেতাজি। রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের জন্মস্থল এই কার্শিয়াং। এই শৈলশহর অনুপ্রাণিত করেছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অতুলপ্রসাদ সেনকেও। কার্শিয়াংয়- এর পর্যটনের পাশাপাশি শিক্ষাও বেশ উন্নত এবং এই শৈলশহরের অন্যতম স্তম্ভস্বরূপ রয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। বহু স্কুল-কলেজ-গড়ে উঠেছে এখানে সুপ্রাচীনকাল থেকে।
এত বেশি স্কুল থাকায় এই শহরকে অনেকে ‘স্কুল টাউন’ বলে থাকেন। স্কুলগুলির মধ্যে কিছু রয়েছে ইংরাজি মাধ্যম স্কুল আর বাকিগুলি নেপালি মাধ্যম স্কুল। আইসিএসই বোর্ডের অধীনে এই সব ইংরাজি মাধ্যম স্কুলগুলির মধ্যে সেন্ট অ্যান্টনি’স স্কুল, কেমব্রিজ হাই স্কুল, ডাওহিল স্কুল, গ্লেনহিল পাবলিক স্কুল, জ্ঞানেশ্বর মেমোরিয়াল একাডেমি ইত্যাদি বিখ্যাত। পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অধীনের নেপালি মাধ্যমের যে স্কুলগুলি রয়েছে এখানে তাদের মধ্যে পুষ্পরাণী রায় মেমোরিয়াল স্কুল, সেন্ট আলফান্সো’স স্কুল, সেন্ট জোসেফ’স গার্লস হাই স্কুল বিখ্যাত।
কার্শিয়াংয়ে একমাত্র গডউইন মর্ডান স্কুলেই সিবিএসই পাঠ্যক্রম রয়েছে। এছাড়া এখানে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কার্শিয়াং কলেজ এবং দার্জিলিং পলিটেকনিক কলেজ রয়েছে। কার্শিয়াংয়েই একমাত্র ধর্মতত্ত্ব শিক্ষার জন্য পৃথক একটি কলেজ রয়েছে যার বর্তমান নাম বিদ্যাজ্যোতি কলেজ অফ থিওলজি। গোর্খাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির উন্নতির প্রতীক হয়ে ১৯১৩ সাল থেকে আজও এখানে ‘গোর্খা জন পুস্তকালয়’ চলছে যা কিনা ভারতে প্রথম নেপালি গ্রন্থাগার প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত।
এছাড়া এখানে রয়েছে ব্লুমফিল্ড গ্রন্থাগার। গোর্খাদের তিহার আর দেশাই এখানকার প্রধান উৎসব। নেপালি হিন্দুরাও এই উৎসবে সামিল হয়। হিন্দুদের দুর্গাপূজায় যে বিজয়া দশমী হয় সেটিই গোর্খাদের মধ্যে দেশাই নামে খ্যাত আর তিহার হল দীপাবলি। যদিও গোর্খাদের তিহার বিশেষ স্বাতন্ত্র্য সম্পন্ন। দেশাই-এর দিন পনেরো পরে তিহার অনুষ্ঠিত হয় তিনদিন ব্যাপী যার প্রথম দিনকে বলা হয় কাক তিহার, দ্বিতীয় দিনে কুকুর তিহার আর তৃতীয় দিনটি গাই তিহার নামে পরিচিত।
এক এক দিনে কাক, কুকুর এবং গরুকে পূজা করা হয় কারণ গোর্খাদের লোকবিশ্বাসে কাক দুঃখ-বেদনার প্রতীক, কুকুর মৃত্যুদূতের প্রতীক আর গরু সমৃদ্ধি-প্রতিপত্তির প্রতীক। এছাড়া শীতকালের মাঝামাঝি এখানে মকর সংক্রান্তি পালিত হয় বেশ ধুমধাম করে। মকর সংক্রান্তিকে গোর্খাদের ভাষায় বলা হয় মাঘে সংক্রান্তি। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে স্থানীয় তিব্বতিরা পালন করে লোশার উৎসব। এটি আসলে তিব্বতি নববর্ষ। এই উৎসব উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী চমরী গাইয়ের নাচ হয়। কার্শিয়াংয়ে গড়ে উঠেছে একটি মিশ্র সংস্কৃতি। নেপালি, তিব্বতি, গোর্খা, হিন্দু, বৌদ্ধ সব মিলে মিশে একাকার এখানকার পার্বত্যভূমিতে। নেপালি হিন্দুদের মধ্যে লোক-ঐতিহ্য বলতে ‘মারুনি নাচ’ বিখ্যাত।
চৌদ্দ বছর বনবাসের পরে অযোধ্যায় ফেরার সময় রামকে স্বাগত জানানোর ঐতিহ্যে এই নাচ অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও নতুন ফসলকে স্বাগত জানাতে ‘ধান নাচ’ হয়ে থাকে। মাঘে সংক্রান্তি উপলক্ষে মহিলারা রঙ-বেরঙের কাপড় পরে নাচ করেন বসন্তকে অভ্যর্থনা জানাতে। কার্শিয়াংয়ে দর্শনীয় স্থানের মধ্যে প্রথম সারিতে থাকবে ঈগল’স ক্রেগ, হাসেল খোলা, রক গার্ডেন আর নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস মিউজিয়াম।
হাসেল খোলার আরেক নাম হুইসল খোলা। নেপালি ভাষায় ‘খোলা’ মানে হল ঝর্না বা সরু নদী। সেই সরু নদীর কোনো এক বাঁকের ধার ঘেঁষে আদ্যিকালে টয় ট্রেন হুইসল বাজিয়ে ছুটে যেত বলে এর নাম হয়ে যায় হুইসল খোলা আর তার থেকে হাসেল খোলা। এছাড়াও ওল্ড মিলিটারি রোডের একজায়গায় ‘অরণ্য সরণি’তে দীর্ঘ সাদা অর্কিডের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
আর এখানকার আধ্যাত্মিক স্থানগুলির মধ্যে আম্বুটিয়া শিব মন্দির, গিদ্দা পাহাড়ের রাম সীতা মন্দির আর দূর্গা মাতা মন্দির স্থানীয় হিন্দুদের কাছে আরাধ্য। এছাড়া রয়েছে আপার নয়া বস্তিতে কুনসাং কয়েলিং মনাস্ট্রি, সেন্ট মেরি’স হিল-এ ক্যাথলিক চার্চ আর রয়েছে হিলকার্ট রোডে সেন্ট পলস চার্চ। ডাও হিল স্কুলের পার্শ্ববর্তী ডাও হিল থেকে ফরেস্ট অফিস রাস্তাটি স্থানীয়দের কাছে ডেথ রোড বা মৃত্যু রাস্তা নামে কুখ্যাত। জনশ্রুতি এই রাস্তায় চলাচলের সময় বহু কাঠুরে জঙ্গলের ধারের এই রাস্তাতেই ভূতুড়ে অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন।
কার্শিয়াংয়ে যেন বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। সবশেষে নিকটবর্তী মকাইবাড়ি চা বাগানের কথা না বললে কার্শিয়াংয়ের একটা আস্ত সৌন্দর্য্যই বাদ পড়ে যাবে। চায়ের কথাই যখন উঠল তখন কার্শিয়াং সাবডিভিশনের অন্তর্গত ‘কমলা গ্রাম’ নামে খ্যাত সিটং এর কথা না বললেই নয়। দার্জিলিং কমলালেবু যা দার্জিলিংয়ের চায়ের পর সব থেকে বিখ্যাত পণ্য দার্জিলিংয়ের তার সিংহভাগ কিন্তু এই গ্রামেই উৎপন্ন হয়।
পাহাড়ি কিশোরীর মতো দার্জিলিঙের কোলে মনোরম পরিবেশে পর্যটকদের নিবিড় শান্তি দেয় কার্শিয়াং । গোর্খা যুদ্ধ থেমে গেছে, তবু আগুন জ্বলছে ধিকিধিকি। গোর্খাদের পৃথক রাজ্য নিয়ে সংঘাত এখন স্তিমিত। পাহাড়ে শীতল শান্তি। কার্শিয়াংয়ের হিলকার্ট রোডে এখনো হয়তো সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিনেমার মতো কোনো নেপালি কিশোর ছড়িয়ে দিয়ে যায় সুরেলা গানের দমকা বাতাস।
আরো পড়ুন জীবনী মন্দির দর্শন ইতিহাস ধর্ম জেলা শহর শেয়ার বাজার কালীপূজা যোগ ব্যায়াম আজকের রাশিফল পুজা পাঠ দুর্গাপুজো ব্রত কথা মিউচুয়াল ফান্ড বিনিয়োগ জ্যোতিষশাস্ত্র টোটকা লক্ষ্মী পূজা ভ্রমণ বার্ষিক রাশিফল মাসিক রাশিফল সাপ্তাহিক রাশিফল আজ বিশেষ রান্নাঘর প্রাপ্তবয়স্ক বাংলা পঞ্জিকা