কুষ্টিয়া জেলা

কুষ্টিয়া জেলা

বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাই একে অন্যের থেকে যেমন ভূমিরূপে আলাদা, তেমনি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও স্বতন্ত্র। প্রতিটি জেলার এই নিজস্বতাই আজ বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করেছে। সেরকমই একটি জেলা হল কুষ্টিয়া জেলা Kushtia District। শিলাইদহের জমিদারি সামলাতে প্রায়ই কুষ্টিয়া য় আসতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর সেই শিলাইদহের কুঠিবাড়িটি এই জেলার অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান।

এই বাড়িতে বসেই লেখা হয়েছিল সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালি ইত্যাদি বিখ্যাত সব কাব্যগ্রন্থ। তাছাড়া লালন শাহ, কাঙাল হরিনাথ, বাঘা যতীন এবং রাধাবিনোদ পালের জন্মস্থান হিসেবেও এই জেলা বিখ্যাত হয়ে আছে।   বাংলাদেশের একটি অন্যতম জেলা হল কুষ্টিয়া । উত্তরে রাজশাহী, নাটোর ও পাবনা, দক্ষিণে চুয়াডাঙা ও ঝিনাইদহ জেলা, পূর্বে রাজবাড়ি জেলা এবং পশ্চিমে মেহেরপুর জেলা ঘিরে রয়েছে কুষ্টিয়া জেলাকে। এছাড়া এই জেলার পশ্চিম সীমান্তেই রয়েছে ভারতের নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলা।

কুষ্টিয়ার সঙ্গে ভারতের ৪৬.৬৯ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা রয়েছে। এই জেলার উপর দিয়েই বয়ে গেছে পদ্মা, গড়াই, মাথাভাঙা, কালীগঙ্গা ও কুমার নদী। এগুলি ছাড়াও এই জেলার মধ্যে আরও কিছু খাল-বিল রয়েছে। তালবাড়িয়া খাল, মোসা খাল, জিয়া খাল, বৌদাঙ্গী ও বরিশাল খাল এর মধ্যে উল্লেখ্য এবং বামন্দী, আড়ুয়া, পুঁটিমারা, বোয়ালিয়া, তালবাড়ীয়া, সমসপুর, কাদিরপুর, সোনাপাতিল ইত্যাদি বিলে ভরে আছে কুষ্টিয়া জেলা। আয়তনের বিচারে কুষ্টিয়া জেলা সমগ্র বাংলাদেশে ৪২তম বৃহত্তম জেলা। এই জেলার আয়তন ১৬০১ বর্গ কিলোমিটার।

২০১১ সালের পরিসংখ্যার বিচারে সমগ্র বাংলাদেশে কুষ্টিয়া জেলা ৩৪তম জনবহুল জেলা। এই জেলার মোট জনসংখ্যা ১৯ লক্ষ ১১ হাজার জন। এর মধ্যে ৫০.৮৬ শতাংশ পুরুষ এবং ৪৯.১৪ শতাংশ আছেন মহিলা। এই জেলার মোট সাক্ষরতার হার ৪৬.৩৩ শতাংশ। কুষ্টিয়া জেলার নামকরণ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে প্রচুর। হ্যামিলটনের গেজেটিয়ার থেকে জানতে পারা যায় যে, এককালে এই জেলায় প্রচুর পাট উৎপাদিত হতো। স্থানীয় ভাষায় পাটকে বলা হত ‘কোষ্টা’ বা ‘কুষ্ঠি’। সেই থেকেই সম্ভবত এই জেলার নাম হয়েছে কুষ্টিয়া।

আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, ফারসি শব্দ ‘কুশতহ্‌’ থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয়েছে কুষ্টিয়া। ‘কুশতহ্‌’ শব্দের অর্থ হল ছাই দ্বীপ। দেশ বিভাগের আগে প্রায় শতাধিক বছর কুষ্টিয়া জেলা পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরপরে নানা সময় এই জেলা পাবনা, যশোর, রাজশাহীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মোটামুটিভাবে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে টলেমির মানচিত্রে গঙ্গার অববাহিকা জুড়ে যে ক্ষুদ্র দ্বীপপুঞ্জ দেখা যায়, তাকেই কুষ্টিয়া বলে মনে করা হয়। কখনো সমতট, কখনো আবার গৌড়ের অংশ হিসেবে থেকেছে কুষ্টিয়া।

অনেকে মনে করেন এই অঞ্চলটিও শশাঙ্কের রাজ্যসীমার মধ্যেই ছিল। ৭৫০ সালে পাল রাজবংশের সময় কুষ্টিয়াতে পাল রাজাদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়া এখানে কিছুদিন চন্দ্রবংশীয় রাজারাও শাসন করে গেছেন। ভারতকোষ গ্রন্থে রয়েছে, এই অঞ্চলে এককালে সেন রাজাদের প্রবল প্রভাব ছিল। পরে বখতিয়ার খিলজি বাংলা আক্রমণ করে নদীয়া অধিকার করলে কুষ্টিয়াতে ইসলামি শাসন শুরু হয়। মুঘলদের শাসনের চিহ্নও ছড়িয়ে রয়েছে এই জেলার বুক জুড়ে। কুষ্টিয়ার শাহী মসজিদ সেই মুঘল শাসনকালেরই প্রকৃষ্ট নিদর্শন।

বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে কুষ্টিয়া ও যশোরে রাজা সীতারাম রায় মুঘলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। সময়টা তখন ১৭১১ সাল। মুর্শিদকুলি খাঁর শাসনের শেষ পর্যায়ে কুষ্টিয়ায় মোট তিনটি বৃহৎ জমিদারি ছিল যার মধ্যে রানি ভবানী ছিলেন সবথেকে বড় ও প্রভাবশালী জমিদার। তবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে এই জেলাতেই আবার অনেক ছোটোখাটো জমিদারি তৈরি হয়ে যায়।

১৮৬০ সালে সমগ্র বাংলা জুড়ে নীলবিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছিল। এই জেলার শালঘর মধুয়ার নেতৃত্বে অসংখ্য কৃষক একজোট হয়ে আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। নীলচাষিরা সকলেই ইংরেজ সরকারকে কর দিতে অস্বীকার করে। এর ফলশ্রুতিতেই নীল কমিশনের রিপোর্টে বলপূর্বক কৃষকদের দিয়ে নীল চাষ করানো নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং নীলকর সাহেবদের অত্যাচার কমে আসে, আন্দোলনও স্তিমিত হয়ে পড়ে। তারও আগে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের আমলে কুষ্টিয়াতেই একটি নদীবন্দর গড়ে ওঠে। ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিই সর্বাধিক হারে এই বন্দরটিকে ব্যবহার করত।

১৮৬০ সালেই ব্রিটিশরা কলকাতার সঙ্গে এই জেলাকে একটি রেলপথের সাহায্যে সংযুক্ত করেছিল। এর ফলে যোগাযোগের সুবিধে বেড়ে যাওয়ায় ১৮৯৬ সালে জ্ঞানেশ্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস, ১৯০৪ সালে রেনউইক অ্যাণ্ড কোম্পানি এবং ১৯১৯ সালে মোহিনী মিল স্থাপিত হয় এই জেলায়। ১৮৬৯ সালে প্রথম কুষ্টিয়া পৌরসভা গড়ে ওঠে। দেশভাগকালে কুষ্টিয়া সদর, চুয়াডাঙা এবং মেহেরপুর মহকুমা নিয়ে কুষ্টিয়া জেলা হিসেবে পৃথকভাবে তৈরি হয়।

১৯৫৪ সালে এখানে গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের মাধ্যমে বৃহদাকারে পৃষ্ঠ-সেচ প্রকল্প তৈরি হয় যার ফলে চাষের অনেক উন্নতি হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও এই জেলার মানুষদের বিশেষ অবদান ছিল। মূলত বঙ্গালি উপভাষাই প্রচলিত রয়েছে এই জেলায়। তবে কুষ্টিয়ার মানুষদের কথ্য ভাষার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা বাংলাদেশের অন্যত্র দেখা যায় না।      

  মূলত ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষই সংখ্যাগরিষ্ঠ এই জেলায়। জনসংখ্যার হিসেবে ৯৬.৬৭ শতাংশ মানুষ এখানে মুসলিম। বাকিদের মধ্যে কয়েক ঘর হিন্দু পরিবার এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু ধর্মের মানুষও রয়েছেন। ৩৫৮৭টি মসজিদ, ১৮৫টি মন্দির এবং ৩২টি গির্জা রয়েছে এই জেলায়। সমগ্র জেলায় মোট ৬টি উপজেলা রয়েছে। যথা – দৌলতপুর, ভেড়ামারা, মীরপুর, কুষ্টিয়া সদর, কুমারখালী ও খোকসা।

এই জেলায় মোট পাঁচটি মিউনিসিপ্যালিটি রয়েছে। ধান, তামাক, আখ, পাট, গম, ভুট্টা, সরিষা, ডাল ইত্যাদি কুষ্টিয়া জেলার প্রধান ফসল। কুষ্টিয়া জেলার উল্লেখযোগ্য ভ্রমণ স্থানের তালিকা অপূর্ণই থেকে যাবে যদি তালিকার শুরুতেই শিলাইদহ কুঠিবাড়ি, টেগোর লজ, মীর মোশারফ হোসেনের বাস্তুভিটা, লালন শাহের মাজার এবং লালন শাহ সেতুর নাম উল্লেখ না করা হয়।

এছাড়া রয়েছে ঝাউদিয়ার শাহী মসজিদ, গোপীনাথ জিউর মন্দির, মোহিনী মিল, পরিমল থিয়েটার ইত্যাদি। কুমারখালি উপজেলাতেই রয়েছে বিখ্যাত রবীন্দ্র-স্মৃতি বিজড়িত শিলাইদহ কুঠিবাড়ি। তিনতলা সেই কুঠির তৃতীয় তলার ঘরেই ছিল কবির লেখার জায়গা। ১৮০৭ সালে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এই অঞ্চলের জমিদারি লাভ করেন। পরে ১৮৮৯ সাল থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত নানা সময় রবীন্দ্রনাথ এখানে জমিদারি পরিদর্শনে আসতেন। এই কুঠিবাড়ি, পদ্মা নদীর উপরে বোটে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকেই বহু ছোটোগল্প লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ।

সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী, গীতাঞ্জলি ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থগুলি সবই এই শিলাইদহে বসে লিখেছেন কবি। এই কুঠিবাড়িতে বর্তমানে একটি জাদুঘর তৈরি হয়েছে যেখানে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত নানা সামগ্রী সযত্নে সুরক্ষিত আছে। চঞ্চলা ও চপলা নামের দুটি স্পিডবোট, বড়ো পালকি, কাঠের চেয়ার, চায়ের টেবিল, পালঙ্ক ইত্যাদি সবই রয়েছে এই জাদুঘরে। ১৮৯৫ সালে কোনো এক ব্যবসায়িক কাজে কুষ্টিয়ায় এসে রবীন্দেনাথ নির্মাণ করেছিলেন যে বাড়িটি সেটি বর্তমানে কুষ্টিয়ার মিলপাড়ায় ‘টেগোর লজ’ নামে বিখ্যাত।

এই বাড়িতেও অসংখ্য কবিতা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ যা পরে তাঁর ‘ক্ষণিকা’ এবং ‘কথা কাহিনী’ কাব্যগ্রন্থে স্থান পায়। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক এবং নাটককার মীর মোশারফ হোসেনের বাস্তুভিটা রয়েছে কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়া গ্রামে। এখানেই ১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর জন্ম হয় মীর মোশারফ হোসেনের। এছাড়া এই জেলাতেই রয়েছে বিখ্যাত লালন শাহের মাজার। দোল পূর্ণিমা এবং কার্তিক মাসের প্রথম দিনে এখানে বিরাট সমারোহে লালন মেলা বসে।

সারা দেশ থেকে বাউল-ফকির-পীর-দরবেশদের সমাগম ঘটে এবং বাউল গানের উৎসব জমে ওঠে। সাধক লালন শাহের নামেই এখানে একটি সেতু রয়েছে পদ্মা নদীর উপর যা কুষ্টিয়া ও পাবনা জেলাকে সংযুক্ত করেছে। এই সেতুটি পাকশি সেতু নামেও পরিচিত যা বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম সড়ক সেতু। মীর মোশারফ হোসেন, বাঘা যতীন, ফকির লালন শাহ এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদধূলি ধন্য এই কুষ্টিয়া জেলা। এই জেলার অন্যান্য কৃতী মানুষদের মধ্যে আছেন রাধাবিনোদ পাল, মোহিনী মিলসের প্রতিষ্ঠাতা মোহিনী মোহন, কাঙাল হরিনাথ প্রমুখ।