লালা লাজপত রাই এর জীবনী

ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনে এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন লালা লাজপত রাই (Lala Lajpat Rai)। ‘পাঞ্জাব কেশরী’ নামে পরিচিত ছিলেন তিনি। বিখ্যাত ত্রয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামী ‘লাল-বাল-পাল’ এর মধ্যে লালা লাজপত রাই ‘লাল’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৮৯৪ সালে প্রাথমিক পর্যায়ে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক এবং লক্ষ্মী ইনসিওরেন্স কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে আয়োজিত প্রতিবাদ মিছিলে সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পুলিশের লাঠির আঘাতে গুরুতর আহত হন এবং তার কিছুদিন পরেই মারা যান তিনি।
১৮৬৫ সালের ২৮ জানুয়ারি পাঞ্জাব প্রদেশের লুধিয়ানা জেলার দুধিকে অঞ্চলে আগরওয়াল জৈন পরিবারে লালা লাজপত রাইয়ের জন্ম হয়। তাঁর বাবা মুন্সি রাধাকৃষ্ণ আগরওয়াল পেশায় একজন উর্দু ও পার্শি সরকারী স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল গুলাব দেবী। জাগরাওনেই তাঁর কৈশোরের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন তিনি। আজও জাগরাওনে তাঁর বাড়িটি অক্ষত আছে এবং সেখানে একটি গ্রন্থাগার ও একটি জাদুঘর স্থাপিত হয়েছে। পরবর্তীকালে জাগরাওনেই লাজপত রাই প্রথম একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন আর. কে. হাই স্কুল নামে।
১৮৭০ সালের শেষ দিকে রেওয়ারিতে তাঁর বাবার বদলি হয়ে যায়। সেখানেই একটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে লালা লাজপত রাইয়ের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়। এই স্কুলেই উর্দু শিক্ষক ছিলেন তাঁর বাবা। ১৮৮০ সালে লাহোরের গভর্নমেন্ট কলেজে আইন পড়তে ভর্তি হন লাজপত রাই। এই কলেজেই বেশ কয়েকজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ও দেশপ্রেমিকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তাঁর। লালা হংসরাজ এবং পণ্ডিত গুরু দত্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। লাহোরে পড়ার সময়েই স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী পরিচালিত হিন্দু পুনর্জাগরণ আন্দোলনের সংস্পর্শে আসেন তিনি।
লাহোরের আর্য সমাজের সদস্যপদও গ্রহণ করেন লাজপত রাই। তাছাড়া লাহোর-কেন্দ্রিক ‘আর্য গেজেট’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবেও কাজে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৮৮৪ সালে রোটাকে তাঁর বাবার বদলি হয়ে যায় এবং লাজপত রাই লাহোরে পড়া সম্পূর্ণ করে বাবার সঙ্গে রোটাকে চলে আসেন। ১৮৮৬ সালে পুনরায় তাঁর বাবার বদলি হয় হিজারে আর সেখানেই লাজপত রাই প্রথম আইন অভ্যাস করতে শুরু করেন। ক্রমে বাবু চূড়ামণির সঙ্গে একত্রে তিনি হিজারের বার কাউন্সিলের সদস্যপদ অর্জন করেন।
ঐ বছরই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের হিজার জেলার শাখায় যোগ দেন তিনি। এছাড়া সংস্কারপন্থী আর্য সমাজের সদস্যপদও গ্রহণ করেন তিনি। আর্য সমাজে তাঁর সঙ্গেই যোগ দিয়েছিলেন বাবু চূড়ামণি, চান্দু লাল তয়াল, হরিলাল তয়াল, বালমোকান্দ তয়াল, ড. রামজি লাল হুডা, ড. ধনি রাম, পণ্ডিত মুরারী লাল প্রমুখ। ১৮৮৮ এবং ১৮৮৯ সালে এলাহাবাদে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে হিজার জেলা থেকে মোট চারজন নির্বাচিত সভ্যের মধ্যে অন্যতম হিসেবে নির্বাচিত হন লালা লাজপত রাই। ১৮৯২ সালে লাহোর উচ্চ আদালতে কাজ করার জন্য লাহোরে চলে আসেন লাজপত রাই।
ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি ঠিক করার জন্য সাংবাদিকতা অভ্যাস করতে শুরু করেন তিনি এবং ‘দ্য ট্রিবিউন’-এর মতো উল্লেখযোগ্য কিছু সংবাদপত্রে নিয়মিত লেখালিখি করতে থাকেন তিনি। ১৮৮৬ সালে মহাত্মা হংসরাজের সঙ্গে লাহোরের জাতীয়তাবাদী দয়ানন্দ অ্যাংলো-বৈদিক স্কুল স্থাপন করেন। ১৯১৪ সালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে পূর্ণসময়ের জন্য নিয়োজিত হওয়ার কারণে আইন অভ্যাস ছেড়ে দেন তিনি। প্রথমে ব্রিটেনে এবং পরে ১৯১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান লালা লাজপত রাই।
১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে নিউ ইয়র্কে ‘ইণ্ডিয়ান হোম রুল লিগ অফ আমেরিকা’ স্থাপন করেন তিনি। ১৯১৭ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। যদিও তাঁর স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাথমিকপর্বে আর্য সমাজের প্রভাবে সাম্প্রদায়িকতার ছোঁয়া ছিল। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের হয়ে পাঞ্জাবে রাজনৈতিক বিবাদে জড়িয়ে পড়ায় লাজপত রাইকে মান্দালয়ে নির্বাসিত করা হয়। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সুরাটে কংগ্রেসের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তিনি জিততে পারেননি।
লাহোরে ব্রিটিশ শিক্ষাপদ্ধতির অনুকরণে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ব্র্যাডলাফ হল। এই কাজে তাঁকে সহায়তা করেছিলেন বিখ্যাত বিপ্লবী ভগৎ সিং। ১৯২০ সালের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতা বিশেষ অধিবেশনে লাজপত রাই কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯২১ সালে লাহোরের একটি অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘সার্ভেন্টস অফ দ্য পিপলস সোসাইটি’তে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। দেশভাগের পরে এই সংগঠনটি দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়। তাঁর মতে হিন্দু সমাজের নারীর অবস্থান, নারীর শিক্ষা, জাতপাত তথা বর্ণবৈষম্য এবং অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের জন্য কাজ করতে থাকেন তিনি।
হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে বেদের এক বিরাট গুরুত্ব রয়েছে, কিন্তু নিম্নবর্ণের মানুষদের বেদপাঠে অধিকার ছিল না। লালা লাজপত রাই এই প্রথার বিরোধিতা করে নিম্নবর্ণের মানুষদের বেদপাঠে অধিকারে স্বীকৃতি দেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে প্রত্যেকটি মানুষের বেদপাঠের অধিকার রয়েছে এবং প্রত্যেকেই বেদ থেকে শিক্ষালাভ করতে পারেন। ১৯১৭ সালে লাজপত রাই যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান, সেই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। পশ্চিমের সমুদ্র উপকূল অঞ্চলে শিখ সম্প্রদায়ের সঙ্গে দেখা করেন তিনি এবং আলাবামার তাস্কিগি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্রমণ করেন।
পরে ফিলিপাইনের শ্রমিকদের সঙ্গেও দেখা করেন তিনি। ১৯১৬ সালে প্রকাশ পায় তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত ‘দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা’ যেখানে তিনি তাঁর মার্কিন প্রদেশ সফরের বিস্তারিত বিবরণ দেন, আফ্রিকান ও আমেরিকান বহু বুদ্ধিজীবির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের বিবরণও পাওয়া যায় এই বইতে। এই বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ডব্লিউ. ই. বি. ডু বইস এবং ফ্রেডারিখ ডগলাস। মার্কিন প্রদেশে থাকার সময় নিউ ইয়র্ক শহরে হোমরুল লিগ স্থাপন করেছিলেন। এই সময় তিনি দুটি মাসিক পত্রিকাও প্রকাশ করতে শুরু করেন যার নাম ‘ইয়ং ইণ্ডিয়া’ এবং ‘হিন্দুস্তান ইনফর্মেশন সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন’।
ভারতে ব্রিটিশ অপশাসনের বিষয়ে ‘ইউনাইটেড স্টেটস হাউজ কমিটি অন ফরেইন অ্যাফেয়ার্স’-এর কাছে একটি প্রতিবাদপত্র জমা দেন তিনি। মোট ৩২ পৃষ্ঠার এই প্রতিবাদপত্রটি তৎপরতার সঙ্গে প্রস্তুত করেছিলেন লাজপত রাই এবং ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে এই প্রতিবাদপত্রটি নিয়ে মার্কিন সেনেটে আলোচনা করা হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় লাজপত রাই মার্কিন প্রদেশেই থাকতেন কিন্তু ১৯১৯ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। এর পরের বছরই অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করেন তিনি। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ১৯২১ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত তিনি কারাবন্দী ছিলেন। মুক্তি পাওয়ার পর আইনসভায় নির্বাচিত হন লালা লাজপত রাই ।
১৯২৮ সালে ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা বিচার করার জন্য স্যার জন সাইমনের নেতৃত্বে ইউনাইটেড কিংডম ‘সাইমন কমিশন’ গঠন করে। ভারতের সকল রাজনৈতিক দল এই কমিশনের বিরোধিতা করেছিল। এতে কোনো ভারতীয় সদস্যকে নেওয়া হয়নি বলেই সমগ্র দেশবাসী এর বিরোধিতা করতে থাকে। ১৯২৮ সালের ৩০ অক্টোবর সাইমন কমিশন লাহোর সফরে এলে লাহোরে তার বিরোধিতা করে এক বিরাট প্রতিবাদ মিছিল আয়োজিত হয়। কিন্তু মিছিলটি ছিল একেবারে অহিংস, সকলেই ‘সাইমন গো ব্যাক’ শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠেছিল।
বেশিরভাগ বিক্ষোভকারী কালো পতাকা নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। লাহোরের পুলিশ সুপার জেমস. এ. স্কট এই মিছিলের উপর নির্বিচারে লাঠিচার্জ করার নির্দেশ দেন। একেবারে সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় পুলিশের লাঠির আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে পড়েন লালা লাজপত রাই। আঘাত প্রাপ্ত হয়েও লাজপত রায় সেই সময় বলেছিলেন যে তাঁর উপর এই আঘাত আসলে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের কফিনে শেষ পেরেক।
তাঁর লেখা বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বই হল ‘দ্য স্টোরি অফ মাই ডিপোর্টেশন’ (১৯০৮), ‘আর্য সমাজ’ (১৯১৫), ‘আনহ্যাপি ইণ্ডিয়া’ (১৯২৮), ‘ইংল্যাণ্ডস ডেট টু ইণ্ডিয়া’ (১৯১৭) ইত্যাদি। বিখ্যাত ত্রয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামী ‘লাল-বাল-পাল’ এর মধ্যে লালা লাজপত রাই ‘লাল’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৮৯৪ সালে প্রাথমিক পর্যায়ে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক এবং লক্ষ্মী ইনসিওরেন্স কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯২৮ সালের ১৭ নভেম্বর ৬৩ বছর বয়সে লালা লাজপত রাইয়ের মৃত্যু হয়। ১৯২৯ সালে হোমি মাস্টারের পরিচালনায় ‘পাঞ্জাব কেশরী’ নামে একটি নির্বাক চলচ্চিত্র মুক্তি পায় যার কাহিনির কেন্দ্রে ছিল লালা লাজপত রাইয়ের জীবন।
আরো পড়ুন জীবনী মন্দির দর্শন ইতিহাস ধর্ম জেলা শহর শেয়ার বাজার কালীপূজা যোগ ব্যায়াম আজকের রাশিফল পুজা পাঠ দুর্গাপুজো ব্রত কথা মিউচুয়াল ফান্ড বিনিয়োগ জ্যোতিষশাস্ত্র টোটকা লক্ষ্মী পূজা ভ্রমণ বার্ষিক রাশিফল মাসিক রাশিফল সাপ্তাহিক রাশিফল আজ বিশেষ রান্নাঘর প্রাপ্তবয়স্ক বাংলা পঞ্জিকা