লাটাগুড়ি | উত্তরবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে Lataguri

প্রকৃতি পর্যটনকে ভিত্তি করে উত্তরবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে বর্তমানে অন্যতম গন্তব্যস্থান হিসেবে লাটাগুড়ির নাম বিবেচিত হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত জলপাইগুড়ি জেলার একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ ইতিহাস বিজড়িত জনপদ লাটাগুড়ি (Lataguri)। প্রশাসনিক দিক থেকে লাটাগুড়ি মালবাজার সাবডিভিশনের অন্তর্গত মাল সম্প্রদায় উন্নয়ন ব্লকে অবস্থিত।
গরুমারা অরণ্যের বাইরে নেওড়া নদীর তীরে ৩১ নং জাতীয় সড়কের উপর অবস্থিত এই লাটাগুড়ি থেকেই গরুমারা এবং চাপরামারি অরণ্যে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া যায়। শিলিগুড়ি থেকে সড়কপথে লাটাগুড়ি র দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার। ভৌগলিক দিক থেকে দেখলে ২৬.৭০৬২৮৩° উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.৭৬৬০৮৫° পূর্ব দ্রাঘিমাংশে লাটাগুড়ির অবস্থান।
ভারতের সীমানা পুনর্নির্ধারণ কমিশনের নির্দেশিকা অনুসারে ২০ নং লাটাগুড়ি (মাল) (এসটি) বিধানসভা কেন্দ্রটি মাল পৌরসভা এবং মাল সিডি ব্লক এর অন্তর্গত। মাল (এসটি) বিধানসভা কেন্দ্রটি ৩ নং জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্র(এসসি) র অন্তর্গত। ২০০৬ এবং ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে, সিপিআই (এম) -এর সোমরা লাকরা মাল (এসটি) কেন্দ্র থেকে জয়ী হন তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের তুরি কোল মুন্ডা এবং শ্যাম ভগতকে পরাজিত করেন। অধিকাংশ বছরে প্রতিযোগিতাগুলিতে বিভিন্ন ধরনের কোণঠাসা করে ছিল কিন্তু শুধুমাত্র বিজয়ী ও রানার্সকে উল্লেখ করা হচ্ছে। ১৯৯৬ এবং ১৯৯১ সালে সিপিআই (এম) এর জগন্নাথ ওরাওঁ কংগ্রেসের তুরি কোল মুন্ডা এবং শ্যাম ভগত উভয়ই পরাজিত করেন।
১৯৮৭ সালে সিপিআই (এম) -এর মোহনলাল ওরাওঁ কংগ্রেসের আও কালণ্ডিকে পরাজিত করেন, ১৯৮২ সালে কংগ্রেসের সুমন তিরকে এবং ১৯৭৭ সালে কংগ্রেসের অ্যান্টনি টপ্নোকে পরাজিত করেন। ১৯৫৭-১৯৭২ ১৯৭২ , ১৯৭১ , ১৯৬৯ এবং ১৯৬৭ সালে কংগ্রেসের এন্টনি টপ্নো জয়ী হন কংগ্রেসের বারেন্দ্র কৃষ্ণ ভৌমিক ১৯৬২ সালে জয়ী হন।১৯৫৭ সালে, মাল একটি যৌথ আসন ছিল। সিপিআই'র মাংরু ভগত এবং কংগ্রেসের বন্ধু ভগত জয়লাভ করেন।
১৯৫১ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম নির্বাচনে, কংগ্রেসের প্রদেশের শশধর কর এবং মুন্ডা এন্টনি টপ্নো উভয়ই পশ্চিম ডুয়ার্স আসন লাভ করেন। ২০২১ সালের লাটাগুড়ি (মাল) (এসটি) বিধানসভা কেন্দ্রটি জয়ী হয় তৃণমূল প্রার্থী বুলুচিক বরাইক। প্রাপ্ত ভোট: ৯৮৬৯৭ শতকরা ভোট : ৪৬% বিজেপি প্রার্থী মহেশ বাগে প্রাপ্ত ভোট: ৯৩১০৬ শতকরা ভোট : ৪৩% ও সিপিএম প্রার্থী মনু ওরাওঁ প্রাপ্ত ভোট: ১০৭৯৭ শতকরা ভোট : ৫%।
এর নিকটবর্তী এলাকা বলতে গরুমারা অরণ্যকেই ধরা হয়। লাটাগুড়ি শহরের নামকরণের ইতিহাস বেশ মজার। মনে করা হয়ে থাকে ‘লাঠা’ শব্দটি থেকেই এসেছে এই ‘ লাটাগুড়ি ‘ কথাটি। ‘লাঠা’ শব্দটির অর্থ- ‘কাঠের গুঁড়ি’। একসময় কাঠই ছিল এই জনপদের একমাত্র জীবিকার উৎস। লাটাগুড়ির জুড়েই দেখা যেত ইতস্তত পড়ে থাকা কাঠের গুঁড়ি। কাঠের গুঁড়ির সাথে সাথে ছিল সেই কাঠ কাটার জন্য বহু কাঠ চেরাই কল। কাঠ চেরাইয়ের একঘেয়ে সুর আর লাঠা লরিতে তোলার ক্লান্তি ঘোচাতে শ্রমিকদের গানে ভরে থাকতো গোটা জনপদ।
অতীতে লাটাগুড়ির বুকে প্রায়ই শোনা যেত সুরেলা গান – ‘বোল রে বোল, হেই সা / আউর থোড়া, হেই সা / কাঁধ লাগাও, হেই সা / জোরসে বোল, হেই সা।’ ইতিহাসের ঘ্রাণে ম ম করে এই জনপদের প্রতিটি ধূলিকণা, প্রতি ইঞ্চি জমি কালিকাপুরাণ, স্কন্দপুরাণে উল্লিখিত বিখ্যাত জল্পেশ মন্দিরটি এই লাটাগুড়ি থেকেই মাত্র ঘন্টা-দুয়েকের দূরত্বে রয়েছে। লাটাগুড়ির অনতিদূরেই গরুমারা অরণ্য। জনশ্রুতি আছে যে স্বাধীনতারও আগে লাটাগুড়িতে শোনা যেত বাঘের ডাক। একদিন হাট থেকে ফেরার পথে রাত হয়ে যেতে জঙ্গলের মধ্যে আশ্রয় নেয় হাটুরেরা।
আগুন জ্বলছিল রাতে, নিশ্চিন্ত বিনিদ্র পাহারাও ছিল। কিন্তু তারই মধ্যে গরুর গাড়ির বলদ শিকার করে নিয়ে যায় বাঘ আর সেই থেকেই এই অরণ্যের নাম নাকি গরুমারা। লাটাগুড়ির কাছেই রয়েছে মেটেলী গ্রামের এয়ারফিল্ডে, মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত স্মৃতি নিয়ে আজও এই স্থান অক্ষত আছে। মেটেলী ছিল ১৯৭১ সালের আগে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প। শোনা যায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা বহু উদ্বাস্তু মানুষের মধ্যে যুবক সম্প্রদায়কে নিয়ে এখানে গড়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধা সৈন্যবাহিনী। তখন সেনাপ্রধান ছিলেন নবকৃষ্ণ রায়। সেই যুবক মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীর নয় জনের এক একটি দল ভারতীয় সেনাদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনাদের অতর্কিতে আক্রমণ করতো।
লাটাগুড়ি থেকে সড়ক পথে দেড় ঘণ্টার দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে আজও ডালিমকোট.দুর্গ। প্রকৃত নাম ডালিম টার। লোকমুখে এই ডালিমকোট এখন ডালিম ফোর্ট। ভুটানি সৈন্যরা এখান থেকেই ইংরেজদের উপর গুপ্ত আক্রমণ করতো, ঐতিহাসিক সিঞ্চুলা চুক্তির এই দুর্গেই হয়েছিল। ডুয়ার্সে ইংরেজ আর ভুটানিদের সংঘাতের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এই দূর্গ আজও দাঁড়িয়ে আছে।
ফলে লাটাগুড়ি যেন ইতিহাসের খনি। একসময় বঙ্গদেশের পুণ্ড্রবর্ধনের অন্তর্গত ছিল জলপাইগুড়ির কিছু অংশ, সেখানে রাজত্ব করে গেছেন গুপ্ত রাজারাও। লাটাগুড়িতেও সেই শাসন চলত কিনা তা অবশ্য স্পষ্টভাবে জানা যায়নি। ১৮৬৯ সালে জলপাইগুড়ি একটি স্বাধীন জেলা হিসেবে গড়ে ওঠে আর তারপর থেকেই আমূল বদলে যায় জেলার বিভাগগুলি, তৈরি হয় নতুন নতুন জনপদ। অধুনা জনপ্রিয় ভ্রমণকাহিনি লেখক গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য জন্মেছেন এই লাটাগুড়িতেই, এখানেই তাঁর বড় হওয়া। বর্তমানে উত্তরবঙ্গের আদিবাসী জনজাতিদের সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাবেই উত্তরবঙ্গে কবি কৃষ্ণপ্রিয় ভট্টাচার্যের একটি কবিতায় লাটাগুড়ির উল্লেখের কাকতালীয় ঘটনা। ‘লাটাগুড়ি ২০৩০’ কবিতায় তিনি লিখেছিলেন – “দু’হাজার তিরিশের লাটাগুড়ি বিদ্রোহে / আম-জাম-আতা স্নিগ্ধ ব্যালেরিনারা কেউ নেই / যুদ্ধ হবে স্পেনের আমন ধান আর বার্সিলোনা…।” লাটাগুড়িতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলতে প্রধানত তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুইটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় আর একটি মাত্র উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে লাটাগুড়ি উচ্চ বিদ্যালয় এবং লাটাগুড়ি গার্লস হাই স্কুলই বিখ্যাত। লাটাগুড়িতে ২০১১ সালের আদমসুমারির সমীক্ষা অনুযায়ী স্বাক্ষর মানুষের সংখ্যা ৩৫২২ জন।
সমগ্র জলপাইগুড়ি জেলা জুড়েই ধামগান বা পাঁচাল বা পালাটিয়া লোকনাটকের চল রয়েছে। এই লোকনাটকের বিষয় ছিল নানাপ্রকার ধর্মকাহিনি। এই ধাম গান আবার তিনি ধরনের হয়ে থাকে – মান পাঁচাল, খাস পাঁচাল আর রঙ পাঁচাল। পুরাণ বা ঐতিহাসিক কাহিনি দিয়ে তৈরি হয় মান পাঁচাল, যেমন – হরিদাস ঠাকুরের পালা, মীরাবাঈ, গৌড়ীয়া কন্যার কাহিনী, ফাঁকতাল। লৌকিক কাহিনি নিয়ে গড়ে ওঠে খাস পাঁচাল, যেমন – চিন্তাসরী পালা, মেনকাশ্বরী পালা, জবেদা মার্ডার, বিহাই বিহাইন আর রঙ পাঁচাল হল কল্পকাহিনি নিয়ে তৈরি। রঙ পাঁচালের উদাহরণ হল – সংসার-গোপীর পালা, হালুয়া-হালুয়ানী, চোর-চুরনী, পুষ্পমালা-কাঞ্চনমালা ইত্যাদি।
এছাড়া জলপাইগুড়ির মহিলারা কাত্যায়নী ব্রত, বিষহরি পুজো, মাতুয়া পুজো ইত্যাদি পালন করে থাকে। এর মধ্যে জলপাইগুড়িতে মেচ সম্প্রদায়ের মানুষরা পালন করে থাকেন তিস্তাবুড়ী পুজো বা মেচেনী খেলা। লাটাগুড়ির মানুষের মধ্যেও এগুলির প্রচলন থাকবে এটাই স্বাভাবিক। লাটাগুড়ি এলে চা-বাগান না দেখে আর চা না খেয়ে ফিরে যাওয়া নীরস শুষ্কতা। ছাওয়াফুলি টি এস্টেটের চা প্রস্তুতির প্রক্রিয়াকরণ দেখে এক কাপ চা খেয়ে মন ভালো করে নেওয়াই যায়। শুধু লাটাগুড়ি নয় উত্তরবঙ্গের যে কোনো জায়গায় দুপুরে খাবার পাতে বোরোলী মাছ না থাকলে ঠিক বড়াই করা যাবে না। উত্তরবঙ্গের মাছের রাজা বলে কথা! আর সবশেষে রয়েছে পেল্লাই সাইজের চমচম।
চমচমের ওজন ৫০০ গ্রাম বা ১ কেজি শুনে যে কেউ চমকে যাবে নিশ্চিত। লাটাগুড়ির বিখ্যাত রাধেশ্যাম ঘোষের মিষ্টির দোকান থেকে মচমচ করে খেয়ে নেওয়া যায় চমচম। সারাদিনের ঘোরার ক্লান্তি তখন কম-কম। লাটাগুড়িতে দেখার জিনিসের অভাব নেই। ৩১ নং জাতীয় সড়কের ডানদিকে রয়েছে গরুমারা অভয়ারণ্য আর বামদিকে রয়েছে লাটাগুড়ি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। গরুমারার ভিতরে যাত্রাপ্রসাদ নজরমিনার, চন্দ্রচূড় নজরমিনার উল্লেখযোগ্য। এর পশ্চিমে নেওড়া নদী নিজস্ব গতিতে কুলুকুলু বয়ে চলেছে।
এই নেওড়া নদীর উপর দিয়েই কুয়াশামুক্ত আকাশে দেখা মেলে কাঞ্চনজঙ্ঘার। লাটাগুড়ির আশেপাশে দর্শনীয় স্থান বলতে নেওড়া রেল ব্রিজ, নেওড়া চা বাগান, সরস্বতী বন বস্তি, মহামায়া কালীবাড়ি, বনবিভাগের কালী ও হরি মন্দির, জমিদারের ভগ্নপ্রায় পুরোনো বাড়ি রয়েছে। আর শনি ও বুধবারের লাটাগুড়ির হাটও দেখার মতো। এছাড়া একটু দূরের পথে পাড়ি দিলে আশেপাশে দেড়-দুই ঘন্টার দূরত্বে অবশ্যই ঘুরে আসা যাবে লালঝামেলা, তিন বিঘা করিডোর, ভুটান সীমান্তে জয়গাঁ, ফুন্টসলিংয়ে কিংবা রিশপ ভ্যালি, মূর্তি নদী, সামসিং সবই অভূতপূর্ব মন ভালো করা জায়গা।
পর্যটকদের কাছে এই লাটাগুড়ির আশেপাশে ঘোরার জায়গার তালিকা যেন শেষই হয় না। অন্যান্য দেখার জিনিসের মধ্যে কাছে-পিঠে রয়েছে বামনিঝোরা মহাকাল, ভ্রামরী শক্তিপীঠ, জল্পেশ ও জটিলেশ্বর মন্দির। উত্তরবঙ্গের একটি বিখ্যাত জনপদ হিসেবে লাটাগুড়িতে বিশ্বায়নের আঁচড় লেগেছে। জঙ্গল ধ্বংস হচ্ছে। আদ্যিকালের কাঠের বাংলোগুলি মৃতপ্রায়, কংক্রিটের জঙ্গল বাড়ছে ক্রমশ। জঙ্গলের মানুষ বাস্তুহারা হচ্ছে, প্রাণীরা খাবারের খোঁজে ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। আজও তুলনায় অনুন্নত উপজাতিদের মধ্যে শিক্ষার হার অনেক কম, দারিদ্র চরম। তবু পাহাড় ভালো থাকে, পাহাড় ভালো রাখে। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য নিয়ে লাটাগুড়ি অপেক্ষায় থাকে পিপাসু পর্যটকের।