এম এ ওয়াজেদ মিয়া এর জীবনী

এম এ ওয়াজেদ মিয়া এর জীবনী

বাংলাদেশের অন্যতম বিখ্যাত একজন পরমাণুবিজ্ঞানী হলেন এম এ ওয়াজেদ মিয়া (M. A. Wazed Miah)। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী হিসেবেও তিনি সমধিক পরিচিত। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। একইসঙ্গে ওয়াজেদ মিয়া ছিলেন একজন রাজনৈতিক লেখক ও নিবন্ধকার।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের উপরেও অনেক বই লিখেছেন তিনি। ক্ষমতার বিপরীতে এক নির্মোহ জীবনাদর্শে বিশ্বাসী এম এ ওয়াজেদ মিয়া বাংলাদেশের এক বরেণ্য দেশপ্রেমিক হিসেবে আজও স্মরণীয়। ১৯৪২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের রংপুর জেলার পীরগঞ্জের ফতেহ্‌পুরে এম এ ওয়াজেদ মিয়ার জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম আবদুল কাদের মিয়া এবং মায়ের নাম ময়জুন্নেসা। তাঁদের চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ওয়াজেদ মিয়াই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। শৈশবে তাঁর ডাকনাম ছিল সুধা মিয়া।

পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এম এ ওয়াজেদ মিয়ার বিবাহ হয়। ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালীন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যখন শেখ মুজিবর রহমান বন্দি ছিলেন, সেই সময়েই শেখ হাসিনা আর এম এ ওয়াজেদ মিয়ার বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। বিবাহ উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ওয়াজেদকে একটি রোলেক্স ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন। তাঁদের এক পুত্র ও এক কন্যা – সাজিব ওয়াজেদ জয় এবং সাইমা ওয়াজেদ পুতুল।     

  চককরিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক পড়াশোনা সম্পন্ন করেন এম এ ওয়াজেদ মিয়া । উন্নতমানের শিক্ষা দেওয়ার জন্য তাঁর বাবা ওয়াজেদ মিয়াকে রংপুর জেলা স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। এই স্কুল থেকেই ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় ডিস্টিংশান নিয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপরে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হন তিনি। ১৯৫৮ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন উচ্চতর শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে। ১৯৬১ সালে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক উত্তীর্ণ হন তিনি এবং ১৯৬২ সালে তিনি বিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রিও অর্জন করেন।

১৯৬৩-৬৪ সালে লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন এম এ ওয়াজেদ মিয়া। তারপর ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ডের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডক্টর অফ ফিলোজফি’ ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। তাত্ত্বিক কণা পদার্থবিদ্যার অন্তর্গত ‘বুটস্ট্র্যাপ হাইপোথিসিস’ বিষয়ে গবেষণা করেছিলেন তিনি। এই গবেষণায় তাঁর তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অধ্যাপক ই জে স্কোয়ারস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ১৯৬১ থেকে ১৯৬২ সাল নাগাদ পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্র লীগের ফজলুল হক মুসলিম হল ইউনিটের সভাপতি নির্বাচিত হন ওয়াজেদ মিয়া।

শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য তিনি গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৬২ সালে কারাবন্দি হন। শেখ হাসিনার সঙ্গে বিবাহের পরে আর কখনও তিনি আওয়ামী লীগে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেননি। ১৯৬২ সালের ২ ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর নিজের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ওয়াজেদ মিয়া। সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন আজম খান এবং তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সমস্ত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া জেনারেল আইয়ুব খানের বিরোধিতা করে আন্দোলনে সামিল হওয়ার কারণেও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ওয়াজেদ মিয়া।

কারাগারে বন্দি থাকার এগারো দিন পরে বন্ধু শেখ আঞ্জুমান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। এই সময় ওয়াজেদের পরিবারের সঙ্গেও বঙ্গবন্ধুর পরিচয় হয়। ১৯৬৩ সালের ১ এপ্রিল পাকিস্তানের পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রে চাকরিতে যোগ দেন এম এ ওয়াজেদ মিয়া । প্রাথমিকপর্বে তিনি করাচির পারমাণবিক শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৯ সালে ইতালির ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স সংস্থায় সহযোগী অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন।

ঐ একই বছর পাকিস্তানে ফিরে এসে পুনরায় পারমাণবিক শক্তি গবেষণা কেন্দ্রে যোগ দেন ওয়াজেদ মিয়া। করাচির নিউক্লীয় শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রের প্রধান বিজ্ঞানী ছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর নিরাপত্তার বিষয়টি নাকচ করা হলে তাঁর সঙ্গে সমস্ত চুক্তির অবসান ঘটে এবং বাংলাদেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন তিনি। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ভারতের পরমাণু কমিশনের নয়া দিল্লির গবেষণাগারে গবেষক হিসেবে নিযুক্ত হন এম এ ওয়াজেদ মিয়া। ১৯৭৫ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের পরে শেখ মুজিবর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলে পরবর্তী দীর্ঘ সাত বছর নির্বাসিত ছিলেন তিনি।

পরে পুনরায় তিনি বাংলাদেশ শক্তি কমিশনে ফিরে আসেন এবং ১৯৯৯ সালে অবসর নেওয়ার আগে পর্যন্ত এই সংস্থাতেই কর্মরত ছিলেন তিনি। ১৯৬৯, ১৯৭৩ এবং ১৯৮৩ সালে প্রতি বছর ছয় মাস যাবৎ ওয়াজেদ মিয়া ইতালির ট্রিয়েস্টের ‘আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা গবেষণা কেন্দ্র’-এ গবেষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ওয়াজেদ মিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি-তে ড্যারেসবেরি নিউক্লিয়ার ল্যাবরেটরিতে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণায় নিযুক্ত ছিলেন।

ইতালির গবেষণা প্রকল্প সমাপ্ত করে ১৯৭৪ সালের ১ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন এম এ ওয়াজেদ মিয়া। ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট পশ্চিম জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী কর্তৃক নিমন্ত্রিত হয়ে সপরিবারে জার্মানির রাজধানী বনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন তিনি। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে ‘বাংলাদেশ আণবিক শক্তি বিজ্ঞানী সংঘ’-এর সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হন এম এ ওয়াজেদ মিয়া এবং পরে ১৯৮৩, ১৯৮৪ এবং ১৯৮৫ সালে পরপর তিনবার এই সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।

১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে দীর্ঘ চার বছর ‘বাংলাদেশ পদার্থবিজ্ঞান সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের পদে আসীন ছিলেন তিনি। বিজ্ঞানের গবেষণার জগতে তাঁর লেখা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুটি বই হল ‘ফান্ডামেন্টালস অফ থার্মোডায়নামিক্স’ (১৯৮৮) এবং ‘ফান্ডামেন্টালস অফ ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক্স’ (১৯৮২)। এছাড়া তাঁর রাজনীতি সচেতনতার ছাপ পাওয়া যায় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ এবং ‘বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকারের চালচিত্র’ নামে দুটি স্মৃতিকথায়।

তাঁর স্মরণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ভবনগুলির একটি বর্তমানে ‘ড. এম  ওয়াজেদ মিয়া বিদ্যায়তনিক ভবন’ নামে পরিচিত হয়। তাছাড়া ‘শাহজালাল ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স  অ্যাণ্ড টেকনোলজি’-র তথ্য ও প্রযুক্তি ভবনের নামও পরিবর্তন করে এম ওয়াজেদ মিয়ার নামেই রাখা হয়েছে। হাজী মহম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর স্মৃতিতে একটি নতুন বিজ্ঞান ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।    ২০০৯ সালের ৯ মে দীর্ঘদিন যাবৎ উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি ও হৃদ্‌যন্ত্রের গোলযোগ, ডায়াবেটিস এবং অ্যাজমায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে এম এ ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যু হয়।  

আরো পড়ুন      জীবনী  মন্দির দর্শন  ইতিহাস  ধর্ম  জেলা শহর   শেয়ার বাজার  কালীপূজা  যোগ ব্যায়াম  আজকের রাশিফল  পুজা পাঠ  দুর্গাপুজো ব্রত কথা   মিউচুয়াল ফান্ড  বিনিয়োগ  জ্যোতিষশাস্ত্র  টোটকা  লক্ষ্মী পূজা  ভ্রমণ  বার্ষিক রাশিফল  মাসিক রাশিফল  সাপ্তাহিক রাশিফল  আজ বিশেষ  রান্নাঘর  প্রাপ্তবয়স্ক  বাংলা পঞ্জিকা