মালদার ঐতিহ্যবাহী জহরা কালী মন্দির

মালদার ঐতিহ্যবাহী জহরা কালী মন্দির

মালদা শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে ইংরেজবাজার থানার রায়পুর গ্রামে আমবাগানের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী Zahra Kali জহরা কালীমন্দির। সময়টা ছিল, ১০৮৩ বঙ্গাব্দ। প্রায় ৩০০ বছর আগের কথা। ঘন জঙ্গলের মধ্যে আমবাগানে ঘেরা ছোট্ট একটা সুন্দর গ্রাম, পাশ দিয়ে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী মহানন্দা নদী। ঠিক এই গ্রামেই প্রথম শক্তি দেবীর আরাধনা শুরু করেন, মিথিলার দরিদ্র ব্রাহ্মণ ছল্ব তেওয়ারি। স্থানীয়ভাবে প্রচলিত রয়েছে, তিনি এই দুর্গম জোহরা তলা গ্রামে পুজো করার জন্য একদিন স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। স্বপ্নে পাওয়া নির্দেশমতো প্রথমে মাটির মন্দির গড়ে শুরু হয়েছিল দেবীর আরাধনা। এখানে মাতৃরূপ প্রথাগত মা কালীর মত নয়।

স্বপ্নে পাওয়া প্রাচীন রীতি মেনে এখানে মা পূজিতা হন মুখোশ রুপি চন্ডী রূপে। জাগ্রত এই কালীমন্দির সম্পর্কে কথিত আছে প্রায় ৩০০ বছর আগে উত্তরপ্রদেশের  সাধক স্বপ্নাদেশ পেয়ে দেবী মা জহরার পুজো শুরু করেন। সেই সময় এপার বাংলা ও ওপার বাংলার ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা এই পুজোতে অংশ নিতেন। এমনকী, সেই সময় গভীর জঙ্গল থাকায় ডাকাতেরাও এই দেবীকে পুজো করে ডাকাতি করতে যেত বলে কথিত আছে। সারা বছর এখানে পুজো চললেও বৈশাখ মাসের মঙ্গল ও শনিবার থাকে বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়।

তখন ভক্ত সমাগম অনেক বেশি হয়। গ্রামীণ এই মন্দিরে পুজোর সময়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও বিহার, ঝাড়খণ্ড থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ সমবেত হন। বৈশাখ মাসে খুব বড় মেলা বসে এখানে। অন্যান্য কালীমন্দিরের মতো রাত্রিবেলা কোনও পুজো এখানে হয় না। সব পুজোই হয় দিনের আলো থাকাকালীন। কেবলমাত্র শনি আর মঙ্গলবারেই হয় পুজো। কালীর এক রূপ দেবীচণ্ডী। তাঁরই আরাধনা হয় এখানে। জহরা কালীর পুজো এখানে কীভাবে শুরু হল? এই নিয়ে রয়েছে অনেক মত। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, সেন যুগের রাজা বল্লাল সেন এই অঞ্চলে অনেকগুলি মন্দির স্থাপন করেছিলেন। সেগুলির মধ্যে একটি হল এই মন্দির।

আবার মন্দিরের গায়ে যে পাথরের ফলক আছে, তা থেকে অনুমান করা যায়, মোটামুটি ৩০০ বছর আগে উত্তরপ্রদেশের এক সাধক এখানে গড়ের ওপর দেবী জহরা চণ্ডীর বেদি স্থাপন করেছিলেন। তিনি নাকি এই কাজ করেছিলেন স্বপ্নাদেশ পেয়ে। পরবর্তীকালে হীরারাম তিওয়ারি নামের এক সাধক দিব্যদর্শনে দেবীর রূপ প্রত্যক্ষ করেন। সেই অনুযায়ী তিনি মূর্তির রূপলেখা তৈরি করেন বৈশাখ মাসে। তা কিন্তু প্রচলিত মূর্তিগুলির মতো নয়। লাল রঙের ঢিবির ওপর রয়েছে এক মুখোশ। ঢিবির দু’পাশে আরও দু’টি মুখোশ দেখা যায়।

এছাড়া গর্ভগৃহে আছে শিব আর গণেশের মূর্তি। বৈশাখ মাসে দেবী জহরার পুজো এভাবেই প্রচলিত হয়। অবশ্য কেউ কেউ মনে করেন, অনেক আগে দেবী জহরার পূর্ণাবয়ব বিগ্রহ ছিল এখানে। বিধর্মীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পুরোহিতরা সেই মূর্তিকে মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছিলেন। অনেক অনেক বছর আগে খুব ঘন জঙ্গল ছিল এই অঞ্চলে। বহু মানুষ বিশ্বাস করেন, এই দেবী এক সময়ে ছিলেন ডাকাতদের আরাধ্যা।

এখানে দেবী চণ্ডীর পুজো করে ডাকাতরা যেত ডাকাতি করতে। ডাকাতি করে প্রচুর ধনরত্ন আনত তারা, তারপর সেগুলোকে এখানেই মাটির তলায় রাখত। সেই ধনরত্নের ওপরই দেবীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ধনরত্নকে হিন্দিতে বলে ‘জওহর’। দেবীমূর্তির নিচে প্রচুর ধনরত্ন রাখা থাকত বলেই এখানে দেবী চণ্ডী ‘জহরা’ বা ‘জহুরা’ নামে প্রসিদ্ধ হয়েছেন। এছাড়া জহুরার প্রতিষ্ঠা মাস উপলক্ষে বড় মেলা বসে বৈশাখ মাসে।

মূল মন্দির লালচে গেরুয়া রঙের পঞ্চরত্ন ধাঁচের, যদিও সেই পঞ্চরত্নের ধরন আমাদের প্রচলিত ধরন থেকে একটু আলাদা। চারপাশের গাছ গাছালির মধ্যে সাদা আর লাল রঙের চারপাশে প্রশস্ত বারান্দা ঘেরা এই মন্দিরের পরিবেশ কিন্তু ভারী সুন্দর। বর্তমানে মন্দিরের পরিবেশ সুন্দর হলেও একটা সময় ঘন জঙ্গলের মধ্যে এই মন্দিরটি অবস্থিত ছিল। সাধারণ মানুষ হয় পায়ে হেটে না হয় ঘোড়ার গাড়ি চেপে এই মন্দিরে পূজা দিতে যেতেন। এখনও মালদা শহর থেকে একাধিক ঘোড়া গাড়ি এই মন্দিরে ভক্তদের নিয়ে আসে।

এই মন্দির চত্বরে এসে দেখা যায় ঘোড়াগাড়ি রমরমা। বর্তমানে এই ঘোড়াগাড়ি স্থান নিয়ে নিচ্ছে টোটোগাড়ি। বর্তমানে এই মন্দিরের পুজোর দেখাশোনা করেন স্থানীয় তেওয়ারি পরিবার। এই পরিবারের পুরোহিত রমেশ তেওয়ারি বলেন, “প্রতি বছর বৈশাখ মাসে মঙ্গল ও শনিবার এখানে ধুমধাম সহকারে জহুরা কালীর পুজো হয়। মালদা জেলা-সহ গোটা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের অগণিত ভক্তের সমাগম হয়। এই জোহরা কালী অত্যন্ত জাগ্রত মায়ের কাছে কোন ভক্ত এসে কোনও মানত করলে তা অবশ্যই কিছুদিনের মধ্যেই পূরণ হয়।”