মণিশংকর মুখোপাধ্যায় | জনপ্রিয় বাঙালি লেখক শংকর

মণিশংকর মুখোপাধ্যায়  | জনপ্রিয় বাঙালি লেখক  শংকর

ওরা বলে- এসপ্ল্যানেড। আমরা বলি- চৌরঙ্গী। সেই চৌরঙ্গীরই কার্জন পার্ক। সারা দিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত শরীরটা যখন আর নড়তে চাইছিল না, তখনই ওইখানেই আশ্রয় মিলল। ইতিহাসের মহামান্য কার্জন সাহেব বাংলাদেশের অনেক অভিশাপ কুড়িয়েছিলেন। সুজলা-সুফলা এই দেশটাকে কেটে দুভাগ করার বুদ্ধি যেদিন তাঁর মাথায় এসেছিল, আমাদের দুর্ভাগ্যের ইতিহাস নাকি সেই দিন থেকেই শুরু হয়েছিল। এভাবেই শুরু হয়েছে শংকরের জনপ্রিয় উপন্যাস 'চৌরঙ্গী'।

বাংলা সাহিত্যের একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক মণিশংকর মুখোপাধ্যায় (Manishankar Mukhopadhyay)। তিনি কলকাতার শেরিফও ছিলেন। তাঁর রচিত উপন্যাস ‘সীমাবদ্ধ’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘একাদশ অশ্বারোহী’ বাংলা সাহিত্য জগতে মাইলফলক হয়ে রয়েছে। পুরো নাম তাঁর মণিশংকর মুখোপাধ্যায়। কিন্তু চৌরঙ্গী, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কথামন্থনসহ বহু জনপ্রিয় উপন্যাসের স্রষ্টা এই লেখক পাঠকমহলে কেবল শংকর নামেই পরিচিত

সাহিত্য জগতে তিনি ‘শংকর’ নামেই বেশি পরিচিত। ১৯৩৩ সালে ৭ ডিসেম্বর উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁতে মণিশংকর মুখোপাধ্যায়ের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম হরিপদ মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর মায়ের নাম অভয়া মুখোপাধ্যায়। মা বাবার আটটি সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।তাঁর বাবা একজন উকিল ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই তাঁদের পরিবার হাওড়ায় চলে আসে। শংকরের খুব অল্প বয়সেই তাঁর বাবার মৃত্যু হয় ফলে ছোট থেকেই তাঁদের খুব কষ্ট করে দিন কাটাতে হয়। মণিশংকর পড়াশোনার জন্য সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হলেও অর্থাভাবের কারনে কলেজের  মাইনে দিতে পারতেন না।

কলেজের একটি সাহিত্যসভায় রম্য রচনা লিখে তিনি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপালের নজরে পড়েন। প্রিন্সিপাল তাঁর লেখায় খুশি হয়ে তাঁর মাইনে মকুব করে দেন। তিনিই শংকরকে আইএ (IA) পরীক্ষায় বসার সুযোগ করে দেন। শংকর খুব অল্প বয়সেই উপার্জন করতে শুরু করেন। প্রথমে তিনি বিভিন্ন জায়গায় পার্ট টাইম কাজ করতেন। কখনো ফেরিওয়ালার কাজ, কখনো প্রাইভেট টিউশন, সব রকম অভিজ্ঞতাই তাঁর হয়েছিল।

শংকর এইসময় হাওড়ার একটি স্কুলে অস্থায়ীভাবে শিক্ষকতার কাজ করেন। এরপর তিনি কলকাতা হাই কোর্টের শেষ ব্রিটিশ ব্যারিস্টার নোয়েল বারওয়েলের মুহুরি হিসেবে কাজে যোগ দেন। বারওয়েলের অফিসে একটি লাইব্রেরি ছিল। সেখানে নানান ধরনের বই থাকত। বিশ্ব সাহিত্যের সাথে শংকরের এখানেই পরিচয় ঘটে। আস্তে আস্তে তিনি সাহিত্যের দিকে ঝুঁকে পড়েন।

১৯৫৩ সালে বারওয়েলের মৃত্যু হলে শংকর ডালহৌসি পাড়ায় একটি চাকরি করতে শুরু করেন এবং এই সময় থেকেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর সহকর্মীরা এই ব্যাপারে তাঁকে খুব উৎসাহ দিত। এই সময়ে তাঁর আলাপ হয় সাহিত্যিক রূপদর্শীর সাথে। তিনি তাঁকে দেশ পত্রিকার দপ্তরে নিয়ে যান। তাঁর প্রথম লেখা উপন্যাসের নাম ‘কত অজানারে’।

এই বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। এই উপন্যাসটি তিনি বারওয়েলের কাছে কাজ করার সময় হাইকোর্ট পাড়ার নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন। প্রকাশের পরই উপন্যাসটি বেশ জনপ্রিয় হয়। যদিও তাঁকে এরপরেও নানান বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এর পরে তিনি তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘চৌরঙ্গী’ নামক একটি উপন্যাস লেখেন।

এই বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। এই উপন্যাসটি পাঠক মহলে খুবই জনপ্রিয় হয় এবং তিনি রাতারাতি একজন প্রথম সারির সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। চৌরঙ্গী উপন্যাসটি নিয়ে পরে সিনেমাও করা হয় এবং সেখানে উত্তম কুমার নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন। শংকরের সাথে ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগর ঘোষের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল।

শংকর রচিত ‘সীমাবদ্ধ’ এবং ‘জন অরণ্য’ নামক দুটি উপন্যাস নিয়ে সত্যজিৎ রায় দুটি সিনেমা তৈরি করেন। শংকরের লেখা আরো কিছু জনপ্রিয় উপন্যাসের নাম- ‘যেখানে যেমন’, ‘নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরি’, ‘এক ব্যাগ শংকর’, ‘নগর নন্দিনী’, ‘ঘরের মধ্যে ঘর’, ‘বাংলার মেয়ে’, ‘কামনা বাসনা’, ‘সম্রাট ও সুন্দরী’, ‘চরণ ছুঁয়ে যাই’, ‘যাবার বেলায়’ ইত্যাদি।

তাঁর অনেক বই ইংরেজি ও  বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। তিনি স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়াশোনা করেন এবং তাঁকে নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই লেখেন যার মধ্যে অন্যতম ‘অচেনা অজানা বিবেকানন্দ’, ‘অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ’ ইত্যাদি। একসময় তিনি কলকাতার শেরিফ (Sheriff) হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য তিনি অনেক পুরস্কারে পুরস্কৃতও হয়েছেন।  

চৌরঙ্গী উপন্যাস যেন বাস্তবের কলকাতার ব্যস্ত রাজপথ চৌরঙ্গীর মতোই এক জায়গা, যেখানে এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে মানুষের হাসি, কান্না, ভালোবাসা, পাওয়ার আনন্দ আর হারানোর বেদনার গল্প, মানুষের গল্প। যে গল্পের শেষ নেই।বইটিকে শুধু উপন্যাস বললে ভুল হবে, গভীর জীবনবোধের আশ্চর্য দলিল এই বইটি। এতে বহু লাইন আছে যেগুলো পাঠককে গভীরভাবে ভাবাবে, কাঁদাবে, হাসাবে, জীবনকে নতুন করে চিনতে সেখাবে। যারা জীবন সংগ্রামে ক্লান্ত, তাদের নতুন আশার আলো দেখাবে চৌরঙ্গী।

আরো পড়ুন

জীবনী  মন্দির দর্শন  ইতিহাস  ধর্ম  জেলা শহর   শেয়ার বাজার  কালীপূজা  যোগ ব্যায়াম  আজকের রাশিফল  পুজা পাঠ  দুর্গাপুজো ব্রত কথা   মিউচুয়াল ফান্ড  বিনিয়োগ  জ্যোতিষশাস্ত্র  টোটকা  লক্ষ্মী পূজা  ভ্রমণ  বার্ষিক রাশিফল  মাসিক রাশিফল  সাপ্তাহিক রাশিফল  আজ বিশেষ  রান্নাঘর  প্রাপ্তবয়স্ক  বাংলা পঞ্জিকা