মনোজ মিত্র | বাঙালি থিয়েটার, চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন অভিনেতা মনোজ মিত্র

মনোজ মিত্র  |  বাঙালি থিয়েটার, চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন অভিনেতা মনোজ মিত্র

বাংলা থিয়েটারের সবথেকে আলোচিত ও অভিনন্দিত নাটককারদের মধ্যে একজনের আবির্ভাব। তিনি মনোজ মিত্র Manoj Mitra। ১৯৫৯ ‘‌মৃত্যুর চোখে জল’‌ নাটক রচনার মধ্যে দিয়েই মনোজ মিত্রের বাংলা থিয়েটারে আগমন। যদিও তার আগে সুন্দরম নাট্যদলে তাঁর দুটি নাটকে অভিনয়ে অংশগ্রহণ ঘটে গেছে।  এছাড়াও তিনি একজন অধ্যাপক এবং সুদক্ষ নাটক রচয়িতা ও নির্দেশক। ‘সাজানো বাগান’ নাটকটি তাঁর অমর সৃষ্টি। বিখ্যাত নাট্যদল ‘সুন্দরম’ তাঁর হাতেই গড়ে ওঠে।

১৯৩৮ সালে ২২ ডিসেম্বর খুলনার সাতক্ষীরা মহকুমার ধূলিহর গ্রামে মনোজ মিত্রের জন্ম হয়। তাঁর পুরো নাম হল মনোজ কুমার মিত্র। ডাকনাম বুদ্ধদেব। মনোজ মিত্রের বাবার নাম অশোককুমার মিত্র এবং তাঁর মায়ের নাম রাধারানী মিত্র। তাঁর বাবা ধূলিহর গ্রামের প্রথম বিএ (B.A) পাস ব্যক্তি এবং পেশায় তিনি ধূলিহর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীকালে অশোককুমার বিভিন্ন আদালতের বিচারক হিসেবে ও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসে বেশ কিছুদিন কাজ করেন।

  মনোজ মিত্র তাঁর বাবা মায়ের পাঁচ সন্তানের মধ্যে প্রথম সন্তান। তাঁরা তিন ভাই এবং দুই বোন। তাঁর দুজন ভাইয়ের নাম উদয়ন মিত্র এবং অমর মিত্র। উদয়ন মিত্র স্টেট আর্কাইভসের ডেপুটি ডিরেক্টর এবং অমর মিত্র বাংলা সাহিত্যের একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক। তাঁর ছোট বোন ও ছোট ভাই খুব অল্প বয়সে মারা যান। তাঁর  স্ত্রীয়ের নাম আরতি মিত্র। তাঁদের একটিই মেয়ে, ময়ূরী মিত্র। গ্রামে বিভিন্ন পালা পার্বণে  অভিনীত হওয়া বিভিন্ন নাটক দেখে অভিনয়ের প্রতি মনোজ মিত্রের আকর্ষণ তৈরি হয়।

গ্রামের একটি বিজয়া সম্মিলনীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রোগের চিকিৎসা’ নামে হাস্যকৌতুকে তিনি প্রথম অভিনয় করেন। বাবার বদলির চাকরি হওয়ায় গৃহশিক্ষকের কাছে মনোজ মিত্রের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। তিনি ১৯৪৫ সালে ধূলিহর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে তাঁর পরিবার কলকাতায় চলে এলে তাঁরা দন্ডিরহাটে চলে যান। সেখানে তিনি নরেন্দ্রকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং এই বিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে তিনি বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করেন।

১৯৫৪ সালে তিনি সেখান থেকে স্কুল ফাইনাল পাশ করে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়তে ভর্তি হন। সেখানে তিনি সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, সুব্রত সেন, নৃপেন্দ্র সাহার মতো মানুষদের। এরপর১৯৬০ সালে  তিনি দর্শন নিয়ে এম.এ পাস করেন। সেই সময় তিনি বেশ কিছুদিন গল্প লেখার নেশায় বুঁদ  হয়ে ছিলেন। সেই সময়কার নামকরা পত্রিকা ‘মাসিক বসুমতি’ এবং ‘মন্দিরা’ তে তিনি নিয়মিত গল্প লিখতেন।

তিনি ‘অন্য স্রোত’ নামের একটি গল্প সংকলন সম্পাদনা করেন সেই সময়ে যার ভূমিকা লিখে দেন সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। এর পাশাপাশি তিনি ‘জয়তী’ নামক একটি সাহিত্য পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন। ১৯৫৭ সালে মনোজ মিত্র ও তাঁর বন্ধু পার্থপ্রতিম চৌধুরী, অতনু সর্বাধিকারী ও আরো কয়েকজন মিলে ‘সুন্দরম’ নামের একটি নাটকের দল গড়ে তোলেন। সেখানে তিনি পার্থপ্রতিম চৌধুরীর নির্দেশনায় ‘পথের পাঁচালী’ এবং ‘সিঁড়ি’ নাটকে অভিনয় করেন।

১৯৫৯ সালে সুন্দরম-এর জন্য মনোজ মিত্র জীবনের প্রথম নাটক মৃত্যুর চোখে জল’ রচনা করেন। ‘সুন্দরম’ সেই নাটকটি একটি প্রতিযোগিতায় মঞ্চস্থ করে এবং প্রথম স্থান অর্জন করে। কিছু নীতিগত বিরোধের কারণে ১৯৬০ সালে  তিনি ও তাঁর বন্ধু অতনু সর্বাধিকারী সুন্দরম ত্যাগ করেন। এরপর তিনি বেশ কিছুদিন ‘গন্ধর্ব’ নামক একটি দলে অভিনয় করেন। কলেজ জীবনের বন্ধু নৃপেন্দ্র সাহা সম্পাদিত গন্ধর্ব  নাট্য পত্রিকায় তাঁর লেখা পরের দুটি নাটক ‘মোরগের ডাক’ এবং ‘নীলকণ্ঠের বিষ’ ছাপা হয়। পরবর্তীকালে তিনি আবার সুন্দরম-এ ফিরে যান। মনোজ মিত্র ছোট থেকেই অধ্যাপক হতে চেয়েছিলেন। তাঁর বাবারও তাই ইচ্ছে ছিল।

এদিকে থিয়েটারের প্রতি আকর্ষণও ছিল প্রবল। সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজে অধ্যাপনা করার সুযোগ পেয়েও সেখানে মনোজ একদিনের বেশি কাজ করেননি। ১৯৬১ সালে তিনি রানীগঞ্জের ত্রিবেণীদেবী ভালোটিয়া কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। একই সাথে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্যও নিজের নাম নথিভুক্ত করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘নৈতিক সংশয়বাদ’। সেই সময় তিনি বেশ কিছুদিন থিয়েটার থেকে দূরে থাক্কলেও ‘সুন্দরম’ নাট্যদলের সাথে তাঁর যোগাযোগ বজায় ছিল।

ছুটিতে কখনও কলকাতায় এলে তিনি সেই দলের অভিনয়ে অংশগ্রহণ করতেন।  প্রখ্যাত নাট্যকার মন্মথ রায় একবার রানীগঞ্জে তাঁর কাছে ঘুরতে গিয়ে মনোজ মিত্রকে নতুন নাটক লেখার উৎসাহ দেন। ১৯৬৩ সালে  মনোজ মিত্র তাঁর নতুন নাটক ‘অশ্বথামা’ তাঁর কলেজে মঞ্চস্থ করেন। ১৯৬৪ সালে অধ্যাপনার চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় চলে আসেন তিনি। একই সাথে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর গবেষণার কাজও বন্ধ করে দেন। কলকাতায় এসে তিনি ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র কলেজে স্থায়ী অধ্যাপকের কাজে যোগ দেন।

সেখানে তাঁর সহকর্মী ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। এরপর মনোজ মিত্র তাঁর কিছু বন্ধুদের সাথে ‘ঋতায়ন’ নামক একটি নাট্যদল গড়ে তোলেন যেখানে তাঁরই লেখা সব নাটক অভিনয় করা হত এবং তিনি সবকটি নাটকের পরিচালনার দায়িত্ব নিতেন। এর পাশাপাশি তিনি সবকটি নাটকে অভিনয়ও করতেন। সেই সময় তাঁর লেখা ‘অবসন্ন প্রজাপতি’, ‘নীলা’, ‘সিংহদ্বার’, ‘ফেরা’, ‘লঘুগুরু’, ‘নেকড়ে’ ও আরো অন্যান্য নাটক নিয়মিত অভিনয় করা হত। ১৯৭০ সালে সেই দলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

১৯৬৫ সালে নিউ আলিপুর কলেজে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন মনোজ মিত্র। সেই সময়ে তিনি পুনরায় গবেষণা করার জন্য নিজের নাম নথিভুক্ত করান এবং প্রায় আড়াই বছর সেই কাজে নিযুক্ত থাকেন। কিন্তু সেই গবেষণার কাজও তিনি শেষ করেননি। এই সময় ‘সুন্দরম’এর নাট্য পরিবেশন বেশ কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালে মনোজ মিত্রের নেতৃত্বে এই দলটির আবার নতুন করে চলা শুরু হয়। নতুনভাবে  ‘সুন্দরম’ শুরু করবার পরে ‘পরবাস’ নাটকটি অভিনীত হয়। এই সময় থেকে তিনিই সুন্দরম-এর সব দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৭ সালে সুন্দরম তার ষাট বছর পূর্ণ করে। 

১৯৭৭ সালের ৫ এপ্রিল তাঁর কালজয়ী নাটক ‘সাজানো বাগান’ অবনমহলে প্রথম অভিনীত হয়। নাটকটির মঞ্চায়ন তাঁর পছন্দ না হওয়ায় তিনি আবার নতুন করে সেই নাটকটি লেখেন। সেই বছরেই মুক্তাঙ্গনে নাটকটি আবার অভিনীত হয় এবং দর্শকদের মন জয় করে নেয়। এরপর থেকেই তাঁর খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৯৮০ সালে  প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক তপন সিংহ মনোজ মিত্রের এই নাটকটি অবলম্বনে ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ নামে একটি সিনেমা বানান যেখানে বাঞ্ছারামের ভূমিকায় মনোজ মিত্র স্বয়ং অভিনয় করেন।

এটি ছিল তাঁর অভিনীত প্রথম সিনেমা। রাতারাতি সিনেমাটি দর্শকদের মধ্যে অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়ে তোলে। এই ছবিটি বাংলা চলচ্চিত্রে একটি মাইলফলক হয়ে থেকে গেছে। এই সময় থেকেই তিনি সমান্তরালভাবে থিয়েটার এবং সিনেমা দুটি মাধ্যমেই অভিনয় করে চলেছেন। ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ মুক্তি পাওয়ার কিছুদিন পরে তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্য বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৯৪ সালে তিনি সেই বিভাগের ‘শিশিরকুমার ভাদুড়ী অধ্যাপক’ পদে যোগ দেন।

২০০৩ সালে তিনি সেখান থেকে অবসর নেন। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য অ্যাকাদেমির সভাপতির দায়িত্বও সামলেছেন তিনি ২০১৯ সাল অবধি। মনোজ মিত্র অসংখ্য ছবিতে অভিনয় করেছেন। সেই সব ছবির মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি হল ‘শত্রু’, ‘বৈদুর্য রহস্য’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘গণশত্রু’, ‘রাখি পূর্ণিমা’, ‘মধু মালতি’, ‘আদালত ও একটি মেয়ে’, ‘ময়নাতদন্ত’, ‘অন্তর্ধান’, ‘দামু’, ‘চরাচর’, ‘হুইল চেয়ার’, ‘আজব গাঁয়ের আজব কথা’ ইত্যাদি।

তিনি বাংলা চলচ্চিত্র জগতের তাবড় তাবড় পরিচালকের সাথে কাজ করেছেন যাঁদের মধ্যে অন্যতম – সত্যজিৎ রায়, তরুণ মজুমদার, গৌতম ঘোষ, বাসু চ্যাটার্জি, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, তপন সিংহ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, হরনাথ চক্রবর্তী, প্রভাত রায় ও রাজা সেন। তিনি দূরদর্শনের কয়েকটি ধারাবাহিকেও সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছেন। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ১০০টির কাছাকাছি নাটক লিখেছেন। ‘সাজানো বাগান’ এর পাশাপাশি তাঁর আরো কিছু জনপ্রিয় নাটকের মধ্যে অন্যতম হল ‘নরক গুলজার’, ‘কেনারাম বেচারাম’, ‘বৃষ্টির ছায়াছবি’ ইত্যাদি। তিনি বেশকিছু নাটক সংক্রান্ত বইও লিখেছেন।

১৯৭৮ সালে মনোজ মিত্রকে গিরিশচন্দ্র পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হয়। ১৯৮৫ সালে তাঁকে সংগীত নাটক একাডেমী পুরস্কার প্রদান করা হয়। এছাড়াও নাট্য জগতে তাঁর সারা সানাই নামের চরিত্রটি এই নাটকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সে নিজেকে রবিঠাকুরের আত্মীয় বলে মনে করে। তাঁকেই দাদাঠাকুর বলে ডাকে। সানাই মনে করেন, দাদাঠাকুর বেঁচে থাকলে এমনভাবে দেশ-ভাগ হত না। এভাবে এই নাটকে এই প্রসঙ্গ এনে মনোজ মিত্র যেন নাটকে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন। বলতে চেয়েছেন, ভৌগোলিক বেড়া মানে না কোনও মানবিক সম্পর্ক যা বেঁচে থাকে ভালবাসার ‘জাদু’তে।