মেহেরপুর জেলা | বাংলাদেশ এর জেলা মেহেরপুর

সাবিত্রী এবং রসকদম্ব মিষ্টির জন্য সমগ্র বাংলাদেশে বিখ্যাত এই মেহেরপুর জেলা Meherpur District। বাংলাদেশের একটি অন্যতম জেলা হল মেহেরপুর। এর উত্তরে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলা ও পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণে চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর, দামুড়হুদা উপজেলা, পূর্বে কুষ্টিয়া জেলার মীরপুর উপজেলা এবং পশ্চিমদিকেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে।
এই জেলার পশ্চিমাঞ্চলে উত্তর-দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে প্রায় ৬০ কিলোমিটার বিস্তৃত ভারতীয় সীমান্ত রয়েছে। মেহেরপুর মূলত একটি মৃতপ্রায় বদ্বীপ সমভূমি অঞ্চল। মেহেরপুরে নদীর সর্পিল গতির কারণে এখানে বহু জায়গায় অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের সৃষ্টি হয়েছে। সমুদ্রতল থেকে এই জেলার গড় উচ্চতা ২১ মিটার। মেহেরপুর জেলার অন্যতম প্রধান নদীগুলি হল ভৈরব, মাথাভাঙা, ছেউটি, কাজলা ও মড়কা খাল ইত্যাদি। আয়তনের বিচারে মেহেরপুর সমগ্র বাংলাদেশে ৬৩তম বৃহত্তম জেলা।
এই জেলার সামগ্রিক আয়তন ৭১৬.০৮ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে, মেহেরপুর সমগ্র বাংলাদেশে ৬১তম জনবহুল জেলা। এই জেলার মোট জনসংখ্যা ৬ লক্ষ ৫৫ হাজার ৩৯২ জন। এর মধ্যে ৩ লক্ষ ২৪ হাজার ৬৩৬ জন পুরুষ এবং ৩ লক্ষ ৩০ হাজার ৭৫৮ জন মহিলা আছেন। অনুমান করা হয় ষোড়শ শতকের কিছু পরে মেহের আলী নামের কোনও এক ব্যক্তির নামের অনুষঙ্গ থেকেই এই জেলার নামকরণ হয়েছে।
আবার অনেকে বলেন ইসলামের ঝান্ডাবাহক দরবেশ মেহের আলী শাহ-র নামানুসারে মেহেরপুর জেলার নামকরণ হয়েছে। এছাড়া আরও একটি মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। ভৈরব নদীর তীরে এই অঞ্চলেই নাকি বাস করতেন বিখ্যাত জ্যোতিষ মিহির এবং তাঁর স্ত্রী খনা। ফলে এই অঞ্চলের আদি নাম ছিল সম্ভবত মিহিরপুর যা অপভ্রংশে মেহেরপুর নামে পরিচিত হয়।
অনেকেই বলে থাকেন রাজা বিক্রমাদিত্যের শাসনকালেই এই অঞ্চল গড়ে উঠেছিল। জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগে কখনও এই জনপদ বাগোয়ান কিংবা রাজাপুর পরগণার অধীনে শাসিত হয়েছে। ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের ফলে মেহেরপুর ব্রিটিশদের অধিকারে চলে যায়। বিখ্যাত ভৌগোলিক টলেমির মানচিত্রে গঙ্গার উপর যে কয়টি দ্বীপ লক্ষ্য করা যায়, তার মধ্যে মেহেরপুরও ছিল বলে মনে করা হয়। অন্য বহু ঐতিহাসিক মনে করেন যে কখনও সমতট, কখনও আবার গৌড়ের শাসনে ছিল এই মেহেরপুর।
মনে করা হয় সপ্তম শতাব্দীতে রাজা শশাঙ্কর শাসনের অন্তর্গত ছিল এই জনপদটি। তাঁর মৃত্যুর পর কামরূপের রাজা ভাস্কর বর্মার অধিকারে চলে যায় এই অঞ্চল। মাৎস্যন্যায় চলার সময়ে এই অঞ্চলের কোনও বিশেষ ইতিহাস পাওয়া যায়নি। তবে সুলতানি আমলে এই অঞ্চলের বিশেষ সমৃদ্ধি দেখা দিয়েছিল। সেই সময় বহু আউলিয়া দরবেশ এখানে আসেন ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। ঐতিহাসিকেরা বলছেন, মোগল আমলে এই জেলার বাগোয়ানের জনৈক ভবানন্দ মজুমদার বিখ্যাত নদীয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
একসময় অবিভক্ত নদীয়ার অন্তর্গত ছিল এই মেহেরপুর জনপদ। ফলে নদীয়ার বিখ্যাত শাসক রাজা কৃষ্ণচন্দ্রও বেশ কিছুদিন মেহেরপুরে শাসন করেছেন। রাজা গোয়ালা চৌধুরী পলাশির যুদ্ধের আগে কৃষ্ণনগর থেকে মেহেরপুর পর্যন্ত একটি সড়ক নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায় আর এই সড়ক নির্মাণের কারণেই এই পথে বর্গী দস্যুরা মেহেরপুরে এসে ধন-সম্পদ লুঠ করে নিয়ে যেত। বর্গীদের এই অত্যাচার থেকে বাঁচতে গোয়ালা চৌধুরী সমগ্র এলাকার চারপাশে পরিখা খনন করেন যার ধ্বংসাবশেষ আজও দেখা যায়।
১৮৫৪ অথবা ১৮৫৭ সালে মেহেরপুর মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময় অবিভক্ত নদীয়ার পাঁচটি মহকুমা ছিল – কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর। মেহেরপুর মহকুমার অন্তর্গত হয় পাঁচটি থানা – করিমপুর, গাঙনি, তেহট্ট, চাপড়া ও মেহেরপুর সদর। ১৯৮৪ সালে এই জনপদটি একটি স্বতন্ত্র জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মেহেরপুর জেলার মোট জনসংখ্যার ৯০.৭৭ শতাংশ মানুষই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এছাড়া ৭.২০ শতাংশ মানুষ আছেন খ্রিস্টান এবং ১.২০ শতাংশ হিন্দুও এখানে একত্রে বসবাস করে থাকেন।
বাংলাদেশের সমস্ত জেলার তুলনায় এখানেই সবথেকে কম হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের বসবাস। তাছাড়া বাকি অন্যান্য গৌণ ধর্মের মানুষ রয়েছেন ১.০৩ শতাংশ। মেহেরপুর জেলা গড়ে উঠেছে ৩টি উপজেলা নিয়ে। উপজেলাগুলির নাম হল যথাক্রমে – মেহেরপুর সদর, মুজিবনগর এবং গাঙনি উপজেলা। এছাড়া প্রশাসনিক সুবিধের জন্য এখানে ১৮টি ইউনিয়ন, ১৮০টি মৌজা, ২৮৫টি গ্রাম, ১৮টি ওয়ার্ড রয়েছে। ১৯৬০ সালে মেহেরপুর পৌরসভার মর্যাদা পেয়েছিল। বর্তমানে এই জেলায় দুটি পৌরসভা রয়েছে – মেহেরপুর এবং গাঙনি পৌরসভা।
মেহেরপুরে মোট ৬০,০২৪ হেক্টর ফসলি জমি রয়েছে যেখানে মূলত ধান, পাট, গম, আলু, কচু, মসুর, ভুট্টা, সর্ষে, পান, আনারস, কাঁঠাল এবং শীতকালীন ফসল উৎপন্ন হয়ে থাকে। মেহেরপুর জেলার উল্লেখযোগ্য ভ্রমণস্থানের তালিকা অপূর্ণই থেকে যাবে যদি তালিকার শুরুতেই সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, আমদহ গ্রাম, আমঝুপি নীলকুঠি, ডিসি ইকো পার্ক, মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স, ভাটপাড়া নীলকুঠি, ভবানন্দপুর মন্দির, মুজিবনগর স্মৃতি সৌধের উল্লেখ না থাকে। মেহেরপুর জেলা সদরের নিকটবর্তী বড়বাজারে এই সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির অবস্থিত।
বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী এই মন্দিরের বিগ্রহটি ধ্বংস করে দিয়েছিল। এই মন্দিরকে কেন্দ্র করেই বৈশাখ মাসের শেষ সংক্রান্তিতে বিরাট মেলা বসে। আমদহ গ্রামটিকেই রাজা গোয়ালা চৌধুরীর সঙ্গে বর্গীদের যুদ্ধের ইতিহাস বিজড়িত ভগ্নাবশেষ বলে মনে করা হয়। এই গ্রামের চারপাশে আজও পরিখার নিদর্শন পাওয়া যায়। এই জেলায় গড়ে উঠেছিল বেশ কিছু নীলকুঠি।
মোটামুটিভাবে ১৮০০ সাল নাগাদ এখানে আমঝুপি গ্রামের নীলকুঠিটি গড়ে ওঠে যা পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসে পরিণত হয়। এছাড়া কাজলা নদীর তীরবর্তী ভাটপাড়া নীলকুঠিতে আজও জেলখানা, মৃত্যুকূপ এবং ঘোড়ার আস্তাবলের ভগ্নাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। এই নীলকুঠিটি আনুমানিক ১৮৫৯ সালে স্থাপিত হয়েছিল। আপাতভাবে মেহেরপুর জেলার বিখ্যাত ভবানন্দপুর মন্দিরটিকে দেখে বৌদ্ধ মন্দির মনে হলেও তা আসলে একটি হিন্দু মন্দির।বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণশৈলীর সঙ্গে এই মন্দিরের নির্মাণ কৌশলের অনেক সাদৃশ্য রয়েছে।
এছাড়াও এখানে রয়েছে হিন্দু ধর্মের একজন সংস্কারক স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতীর আশ্রম। মেহেরপুর জেলার কৃতী মানুষদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মুক্তিযুদ্ধের শহীদ এম এ হান্নান, লেখক দীনেন্দ্রকুমার রায়, ক্রিকেটার ইমরুল কায়েস, বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা আব্দুল মোমিন, বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত ওয়ালিল হোসেন, স্বামী নিগমানন্দ প্রমুখ। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের দিক থেকে এই মেহেরপুর জেলা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। এখানকার বাউলগান, নাট্যচর্চা, ভাসানগান কিংবা মানিক পীরের গান খুবই ঐতিহ্যমণ্ডিত।
তাছাড়া জারি, সারি, ঢেঁকি মংলানোর গান কিংবা ভাটিয়ালি, কীর্তন, ছড়া গান, ভাব গান ইত্যাদি এই জেলায় খুবই বিখ্যাত। এই জেলাতেই ভৈরব নদের পশ্চিম দিকে রয়েছে কালি ফকিরের আখড়া যেখানে প্রতি বছর নির্দিষ্ট দিনে বাউল-ফকিরদের সমাবেশ দেখা যায়। তাছাড়া পৌষ মাসের সংক্রান্তিতে মানিক পীরের গান গেয়ে অনেকে এখানে ভিক্ষা করে থাকেন।
বেহুলার স্বামী হারানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভাসান পালা বাঁধা হয় এখানে। জন্ম পালা, বাঁচার পালা, মৃত্যুপালা এই তিন ধরনের পালা অভিনীত হয়ে থাকে মেহেরপুর জেলায়। এই জেলার পুতুলনাচও বিশেষ ঐতিহ্যবাহী। বহু আগে থাকেই উৎসবে-অনুষ্ঠানে পুতুলনাচ দেখানো হয়, মানুষজন টিকিট কেটে তা উপভোগ করতে জমায়েত হয়। ঐতিহ্যবাহী রসকদম্ব এবং সাবিত্রী মিষ্টি তৈরিতে মেহেরপুরের ময়রাদের জুড়ি মেলা ভার। ব্রিটিশ শাসনকালে বাসুদেব প্রধান নামে জনৈক ব্যক্তি এই দুই রকমের মিষ্টি প্রস্তুতির প্রণালী আবিষ্কার করেছিলেন বলে জানা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত ইত্যাদি বহু দেশে এই বিখ্যাত মিষ্টি দুটি রপ্তানি করা হয় মেহেরপুর থেকে।