মিতালী রাজ| ধরা ছোঁয়ার বাইরে ক্রিকেটার মিতালী রাজ

মিতালী রাজ|  ধরা ছোঁয়ার বাইরে ক্রিকেটার  মিতালী রাজ

   ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটার মিতালী রাজ (Mithali Raj) ।  টানা ২২ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন মিতালী রাজ। মেয়েদের ক্রিকেটে এই রেকর্ডের ধারে কাছে নেই কেউ। ১৯৯৯ সালে ২৬ জুন অভিষেক ঘটে মিতালীর। তারপর থেকে সেই যাত্রা আজও অব্যাহত। মহিলা ক্রিকেটে বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক রানের রেকর্ড এই মিতালীরই দখলে। ভারতীয় জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হিসেবে একাধিকবার নির্বাচিত মিতালী রাজ দীর্ঘ বাইশ বছরের ক্রিকেট-জীবনে ২১৫টি ম্যাচ খেলেছেন যার মধ্যে ৭টি সেঞ্চুরি এবং ৫৬টি হাফ-সেঞ্চুরি করে ভারতের মহিলা ক্রিকেটের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

তিনিই একমাত্র মহিলা ক্রিকেটার যিনি আন্তর্জাতিক স্তরের একদিনের ম্যাচে সর্বমোট ৭০০০ রান করেছেন। ২০০৩ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে অর্জুন পুরস্কার এবং ২০১৫ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত হন মিতালী রাজ। ১৯৮২ সালের ৩ ডিসেম্বর রাজস্থানের যোধপুরে একটি তামিল পরিবারে মিতালী রাজের জন্ম হয়। তাঁর বাবা দোরাই রাজ ভারতীয় বায়ুসেনার একজন ওয়ার‍্যান্ট অফিসার ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল লীলা রাজ। মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই মিতালী রাজ ক্রীড়াচর্চার সঙ্গে যুক্ত হন। যোধপুরে জন্ম হলেও পরবর্তীকালে তিনি তেলেঙ্গানার হায়দ্রাবাদে থাকতেন।

তাঁর পরিবারের রীতি ছিল মেয়েদের বাধ্যতামূলকভাবে ভরতনাট্যম বা অন্য কোনো ধ্রুপদি নৃত্যের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। সেই মতো তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়ই তিনি ভরতনাট্যম শিখতে শুরু করেন। কিন্তু তাঁর এই সপ্তাহান্তের নাচের ক্লাস বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারেননি তিনি। তাঁর ভাই মিঠুন যখন সেকেন্দ্রাবাদের সেন্ট জনস অ্যাকাডেমিতে ক্রিকেট প্রশিক্ষণে ভর্তি হয়, তাঁর সঙ্গে সঙ্গে মিতালীও যেতেন। মাঠে বসে সে সময় বাড়ির কাজ করতেন তিনি। সেই অ্যাকাডেমির প্রশিক্ষক জ্যোতি প্রসাদই তাঁর বাবাকে প্রথম বলেন যে মিতালীকেও ক্রিকেট প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।

আর তারপর থেকে সমস্ত রুটিনটাই বদলে যায় তাঁর জীবনে। ভোর পাঁচটায় উঠে প্রস্তুত হয়ে প্রশিক্ষণ নিতে যেতেন তিনি, তারপর আটটায় ফিরে এসে সাড়ে আটটায় স্কুলে যেতেন। কেয়েস হাই স্কুলের ক্রিকেট প্রশিক্ষক সম্পদ কুমার বুঝতে পেরেছিলেন মিতালীর মধ্যে যথাযথ প্রতিভা আছে আর সেটাকেই তিনি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। শুধু পড়াশোনা করে জীবন ভেসে যাক তা তিনি কখনোই চাননি। কিন্তু দেখা গেছে পরে কোনো ক্লাসেই অনুত্তীর্ণ হননি মিতালী কারণ তাঁর মা নিজে হাতে সব বাড়ির কাজ করে দিতেন মিতালীর, একইসঙ্গে উপযুক্ত খাবার যাতে মিতালীর জন্য রান্না করা হয় সে ব্যাপারেও ভোর থেকে উঠে তদারক করতেন রান্নাঘরে।

হায়দ্রাবাদের কেয়েস হাইস্কুল ফর গার্লসে মিতালী রাজের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। তারপরে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে তিনি ভর্তি হন সেকেন্দ্রাবাদের ‘কস্তুরবা গান্ধী জুনিয়র কলেজ ফর ওম্যান’-এ। স্কুলে পড়াকালীনই তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে একত্রে তিনি ক্রিকেটের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে এই ক্রিকেটই তাঁর কর্মজীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে। রেলওয়ের হয়ে একটি আভ্যন্তরীণ ম্যাচে প্রথম খেলতে নামেন মিতালী আর সেই ম্যাচেই বিখ্যাত ক্রিকেটার পূর্ণিমা রাও, আঞ্জুম চোপড়া, অঞ্জু জৈনের সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তিনি।

ভারতীয় ক্রিকেটে একইসঙ্গে একদিনের ম্যাচ, টেস্ট এমনকি টি-টোয়েন্টি ম্যাচেও খেলেছেন মিতালী রাজ। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই ১৯৯৭ সালের মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপের জন্য তাঁর নাম মনোনীত করা হয়, কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি সেবার খেলতে পারেননি। ১৯৯৯ সালে মিল্টন কেয়েস স্টেডিয়ামে প্রথমবারের জন্য একদিনের ক্রিকেট ম্যাচ খেলেন মিতালী আয়ারল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে এবং সেখানে ১১৪ রানে অপরাজিত থাকেন। লক্ষ্ণৌতে ২০০১-’০২ সিজনে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলেন মিতালী। ২০০২ সালের ৩ আগস্ট মাত্র ১৯ বছর বয়সে তাঁর তৃতীয় টেস্ট খেলায় ২১৪ রান করে তিনি পূর্ববর্তী ক্যারেন রোল্টনের এককভাবে টেস্ট ম্যাচের ২০৯ রানের রেকর্ড ভেঙে দেন। টন্টনের কান্ট্রি গ্রাউণ্ড স্টেডিয়ামে ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে এই টেস্ট ম্যাচে এমন জয় তাঁকে ক্রমশ বিশ্বের দরবারে পরিচিত করে তোলে।

২০০২ সালে ক্রিকইনফো ওমেন্স ওয়ার্ল্ড কাপ চলাকালীন মারাত্মক টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ার কারণে খেলতে পারেননি তিনি। তারপর ২০০৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বিশ্বকাপ ম্যাচ খেলেন তিনি। ঐ বছরই ২০০৫ মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারতের অধিনায়কত্ব করেন তিনি, কিন্তু সেই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজিত হয় ভারত। তিনি একইসঙ্গে আংশিক সময়ের লেগ-ব্রেক বোলারও বটে। ২০০৬ সালে ইংল্যাণ্ডে প্রথম টেস্ট ও সিরিজ খেলে জয়লাভ করেন মিতালী এবং সেই বছরই তিনি এশিয়া কাপ জেতেন।

২০১৩ সালের মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপে মহিলাদের মধ্যে তিনিই ছিলেন শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার। টেস্ট ক্রিকেটে একটি সেঞ্চুরি এবং চারটি হাফ-সেঞ্চুরি, একদিনের ক্রিকেটে পাঁচটি সেঞ্চুরি এবং পঞ্চাশটা হাফ-সেঞ্চুরি আর সবশেষে টি-টোয়েন্টিতে মোট দশটা হাফ-সেঞ্চুরি করেছেন মিতালী রাজ। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনিই আন্তর্জাতিক স্তরে একদিনের ক্রিকেট ম্যাচে দ্বিতীয় ক্রিকেটার নির্বাচিত হন যিনি ৫৫০০ রান করেছেন। একদিনের ম্যাচ কিংবা টি-টোয়েন্টিতে তিনি ভারতের মহিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছেন বহুবার। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে তিনিই ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্ব করেছিলেন।

কিন্তু সেই ম্যাচে মাত্র নয় রানের ব্যবধানে ইংল্যাণ্ডের কাছে পরাজিত হয় ভারত। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজে আইসিসি ওমেন্স ওয়ার্ল্ড টোয়েন্টি-টোয়েন্টি ম্যাচে মিতালী রাজ ভারতের হয়ে খেলতে নামেন। ঠিক তার পরের বছরই ২০১৯ সালে টি-টোয়েন্টি খেলা থেকে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। ২০০৬ সালে টি-টোয়েন্টি ইন্টারন্যাশনালে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার পর থেকেই ২০২১ সালের একদিনের ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারতের হয়ে বিশ্বকাপ জিততে চেয়েছেন তিনি, তাই টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিয়ে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বকাপের দিকে মনোনিবেশ করতে চান তিনি।

২০২১ সালের মে মাসে ইংল্যাণ্ডের মহিলা ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে একটি ওয়ান-অফ ম্যাচে খেলার জন্য ভারতের টেস্ট স্কোয়াডে খেলার জন্য মনোনীত হন তিনি। টেস্ট ক্রিকেট সহ সমস্তপ্রকার ক্রিকেট ম্যাচে সর্বাধিক রান করার জন্য তাঁকে মহিলা ক্রিকেটের শচীন তেণ্ডুলকর বলা হয়ে থাকে। বিশ্বকাপে ১০০০ রান করে মিতালী রাজই প্রথম ভারতীয় ক্রিকেটার এবং পঞ্চম মহিলা ক্রিকেটারের সম্মান পান। ২০১৭ সালের মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপে সপ্তম অর্ধশতরান করে তিনি পূর্বতন মহিলা ক্রিকেটারদের অর্ধশতরানের রেকর্ড ভেঙে দেন।

তাঁকে ঘিরে বিতর্কও তৈরি হয়েছিল একসময়। ২০১৮ সালের আইসিসি ওমেন্স ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড টোয়েন্টি-টোয়েন্টিতে তাঁকে না নেওয়া হলে তিনি প্রশিক্ষক রমেশ পাওয়ার এবং বিসিসিআই এর সদস্য দিয়ানা এদুলজিকে চিঠি লিখে জানান যে সেই ম্যাচে তাঁকে মনোনীত না করে অপমান করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে রমেশ পাওয়ার জানান যে ক্রিকেট দলে শেষদিকে ব্যাটিং-এ নামতে বলায় খেলা থেকে অবসর নেওয়ার ব্ল্যাক-মেলও করেছিলেন মিতালী রাজ। রমেশ এও বলেন যে, দলীয় পরিকল্পনা বা দলীয় আলোচনায় মিতালী কখনোই সেভাবে গুরুত্ব দিতেন না, তাঁর লক্ষ্য ছিল কেবল ব্যক্তিগত স্কোর বাড়ানো। ফলে এই ঘটনাগুলি নিয়েই বিতর্ক তৈরি হয়েছিল।

এমনকি তৎকালীন ভারতীয় টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক হারমানপ্রীত কৌরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে নানা সমালোচনা দেখা দিয়েছিল। ২০০৩ সালে মিতালী রাজ প্রথম ভারত সরকারের পক্ষ থেকে অর্জুন পুরস্কার পান। তারপর ২০১৫ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। তারপরে ২০১৭ সালে একইসঙ্গে ইউথ স্পোর্টস আইকন অফ এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড, বিবিসি ১০০ ওমেন পুরস্কার এবং উইসডেন লিডিং ওম্যান ক্রিকেটার ইন দ্য ওয়ার্ল্ডের শিরোপা লাভ করেন মিতালী রাজ।

২০২০ সালের নভেম্বর মাসে দশকের সেরা আইসিসি মহিলা ক্রিকেটার হিসেবে র‍্যাচেল-হেইহো ফ্লিন্ট পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন মিতালী রাজ। ২০১৯ সাল থেকে মিতালী রাজের জীবনকে কেন্দ্র করে রাহুল ঢোলাকিয়ার পরিচালনায় একটি জীবনী-নির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয় যেখানে তাপসী পান্নু অভিনয় করছেন মিতালীর চরিত্রে। ছবিটির নাম ‘সাবাশ মিঠু’। যদিও ২০১৭ সালের মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপ হওয়ার পরেই ভায়াকম ১৮ মোশান পিকচার্স এই ছবির জন্য মিতালী রাজের থেকে স্বত্ব সংগ্রহ করেছিল যার কাজ শুরু হয় দুই বছর পরে ২০১৯ সালে। এখনও পর্যন্ত মোট ১০,২৭৭ রানের অধিকারী মিতালী রাজ ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক।  বিশ্ব ক্রিকেটে সচিন এবং মিতালি— দু’জনেই এখন ব্যাটিংয়ে পুরুষ ও মহিলাদের ওয়ান ডে-তে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী। ছেলেদের ক্রিকেটে সব থেকে বেশি রান করেছেন সচিন। অন্য দিকে মেয়েদের ক্রিকেটে সব চেয়ে বেশি রান মিতালীর ঝুলিতে।