মহরম

সারা বিশ্ব জুড়ে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা তাজিয়া নিয়ে শোক-মিছিলে সামিল হন মহরমের দিন। একইসঙ্গে পুণ্যার্জন এবং শোক পালনের দিন এই মহরম (Muharram)। হজরত মহম্মদ (সাঃ) -এর পৌত্র হাসান এবং হোসেনের নির্মম হত্যার করুণ ইতিহাস জুড়ে আছে এই বিশেষ মাসটিকে ঘিরে। শিয়া হোক বা সুন্নি উভয় সম্প্রদায়ের মুসলমানদের মধ্যেই মহরম সমান গুরুত্ব সহকারে পালিত হয়।
হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহরমের তাৎপর্য কি জেনে নেওয়া যাক। হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহরম যার দশম দিনে বিশ্বের আপামর ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা পালন করে ‘আশুরা’। মহরমের একটি অত্যন্ত ঐতিহ্যবাহী সংস্কার হল এই আশুরা। ‘আশুরা’ শব্দটি ‘আশরা’ শব্দের অপভ্রংশ। আরবিতে ‘আশরা’ শব্দটির অর্থ ‘দশ’।
যেহেতু হিজরি বর্ষপঞ্জি একটি চান্দ্র-বছর, ফলে ইংরেজি গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির সঙ্গে তারিখের অমিল ঘটে তার। সৌর বছরের নিরিখে এই মহরমের তারিখ বদলে বদলে যায়। প্রতি বছর মহরমের দশম দিনটি বিশেষ দিন হিসেবে পালিত হলেও ইংরেজি ক্যালেণ্ডারে তা কখনো সেপ্টেম্বরে, কখনো আগস্টে আবার কখনো বা জুলাই মাসে পালিত হয়ে থাকে। মহরমের পিছনে যে পৌরাণিক ঐতিহ্য রয়েছে তাতে মুসলমানরা বিশ্বাস করেন যে এই দিনে মহান আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছিলেন মানবজাতির পিতা আদমকে।
এমনকি আল্লাহ্ এই দিনেই নাকি আকাশ-মাটি, জল, হাওয়া, বেহেস্ত-দোজখ, চাঁদ-সূর্য ইত্যাদি সৃষ্টি করেছিলেন। মুসলমানরা মনে করেন মহরম মাসের দশম দিনেই হজরত নোহার নৌকা জুদি পাহাড়ের পাদদেশে আটকেছিল ঢেউয়ের তালে তালে ফিরতে ফিরতে আর এই একই দিনে নবী মুসার শত্রু ফেরাউনকে নীলনদে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন আল্লাহ্। অনেকের বিশ্বাস মহরমের ঠিক ১০ তারিখেই নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন ইব্রাহীম আর প্রায় মুমূর্ষু আইয়ুব রোগমুক্ত হয়েছিলেন।
আজও বহু ইসলাম ধর্মাবলম্বী মনে করেন যে এই মহরমের দিনই একদিন কেয়ামতের দিন হবে অর্থাৎ পৃথিবী ধ্বংস হবে। তবে এসবই জনশ্রুতি বা লোকবিশ্বাস, এর কোনো পাথুরে প্রমাণ নেই। কিন্তু এই মহরম উদ্যাপনের একটি করুণ ঐতিহাসিক কারণও আছে। হিজরি ৬১ সনের মহরমের দশম দিনটি সকল মুসলমানদের কাছে নবী হোসেনের নির্মম হত্যাকাণ্ডের করুণ শোকাবহ দিন হিসেবে ঐতিহাসিক তাৎপর্য বহন করে।
হিজরি ৬০ অব্দে খলিফা মুয়াবিয়ার মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র এজিদ নিজেকে সমগ্র বিশ্বে মুসলিমদের খলিফা বলে ঘোষণা করেন। মদ্যপান, নিজের দুই বোনকে বিবাহ করার মতো অবৈধ আইন-কানুন চালু করায় অত্যাচারী এবং স্বৈরতান্ত্রিক এজিদের শাসনে হজরত মহম্মদ (সাঃ) এর দৌহিত্র মহম্মদ হোসেন এবং হাসান কোনোভাবেই বশ্যতা স্বীকার করতে চাননি। হোসেন এজিদকে খলিফা হিসেবে মান্যতা না দিয়ে নিজের পরিবার-পরিজন নিয়ে মদিনা ত্যাগ করে চলে যান মক্কার উদ্দেশ্যে।
সেই সময় ইরাকবাসীরা একদিকে উমাইয়া খলিফা এজিদ আরেকদিকে ইরাকের শাসনকর্তা ওবায়েতুল্লার নির্মম পেষণে জেরবার হয়ে হোসেনের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলে হোসেন পরিবারসহ ইরাকের কুফা প্রদেশের উদ্দেশে যাত্রা করেন। কিন্তু ক্ষমতাপিপাসু এজিদ চাননি তাঁর বিরোধী কেউ বেঁচে থাকুক, তাই ওবায়েতুল্লার মাধ্যমে এজিদ ইরাকে থাকা হোসেনের অনুগামীদের পরপর হত্যা করতে থাকেন।
হোসেনকেও মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছিলেন এজিদ। সেজন্য প্রায় চার হাজার সৈন্য নিয়ে ওবায়েতুল্লা হোসেনকে বন্দি করে ফেলেন কারবালার প্রান্তরে। ধূ ধূ মরুভূমির মধ্যে একমাত্র জলের উৎস ছিল ফেরাত নদী, সেই পথও বন্ধ করে দেয় ওবায়েতুল্লার সৈন্যরা। জল পিপাসায় শ্রান্ত-ক্লান্ত হোসেন আর তাঁর পরিবারের মুখে জলটুকু তুলে দিতে তাঁর এক অনুগামী নদী থেকে জল ভরে আনতে গেলে ওবায়েতুল্লার সৈন্যদের হাতে তিনি ধরা পড়ে যান।
সৈন্যরা প্রথমে তাঁর হাত কেটে দেয়, এরপর তাঁকে বাণবিদ্ধ করে। তারপরেও হোসেনের সেই অনুগামী হোসেনকে জল পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে গেলে তাঁকে শেষ পর্যন্ত প্রাণে মেরে ফেলে ওবায়েতুল্লার সৈন্যরা। হোসেনের শিশু পুত্র আলি আসগর জলের তেষ্টায় অজ্ঞান হয়ে গেলে তাঁর প্রাণসংশয় দেখা দেয়। হোসেন ওবায়েতুল্লার কাছে অনুরোধ রাখেন তাঁরা মদিনায় ফিরতে চান আর তা নাহলে এজিদের সঙ্গে আলোচনা করতে চান। কিন্তু হোসেনের কোনো অনুরোধই মানেননি ওবায়েতুল্লা।
শিশুপুত্র আলি আসগরকে কোলে নিয়ে জোর করে জলের জন্য ফেরাত নদীর দিকে এগোতে গেলে বাণবিদ্ধ করে সৈন্যরা মেরে ফেলে শিশু আসগরকে। শুরু হয় নৃশংস হত্যালীলা। সন্তানের শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন হোসেন। আর সেই সুযোগে তাঁকেও তীরের আঘাতে হত্যা করে ওবায়েতুল্লার সৈন্যরা। এর পরে তাঁর মাথা কেটে এজিদের কাছে উপহারস্বরূপ পাঠানো হয়। দীর্ঘ দশদিন ধরে যুদ্ধ চলেছিল উমাইয়া খলিফা এজিদ ও ওবায়েতুল্লার যৌথ সেনাবাহিনীর এবং হোসেনের নিরস্ত্র পরিবারের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত শহিদ হন হোসেন।
মহিলা ও শিশু সহ মোট একাত্তর জন সদস্য ছিল হোসেনের দলে। হোসেনকে হত্যার পর সমস্ত পুরুষকে মেরে সম্পদ লুঠ করে মহিলাদেরকে পাঠানো হয় এজিদের কাছে। অন্যদিকে এজিদ ষড়যন্ত্র করে হজরত মহম্মদের (সা:) কন্যা ফতিমা আলির বড়ো ছেলে হজরত হাসানকেও হত্যা করেন। হোসেন কখনোই প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ করতে চাননি।
তিনি চেয়েছিলেন ইসলামের পথই হোক সত্য ও ন্যায়ের পথ। হাসান-হোসেনের মৃত্যুর এই করুণ ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে মহরমের উদ্যাপনের সঙ্গে। মূলত শিয়া মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, লেবানন, বাহারিন প্রভৃতি দেশে মহরমের আশুরা জাঁকজমক সহকারে পালিত হয়। তাজিয়া নিয়ে মিছিল, মাতমের পাশাপাশি এইদিনে শিয়ারা রোজা রাখেন।
মহরমের দশ দিনের মধ্যে প্রথম চারদিন স্মরণ করা হয় ইমাম হোসেনকে, তারপরের চারদিন হোসেনের পরিবারের স্ত্রী-পুত্র-শিশুদের স্মরণ করা হয়, তাদের জন্য শোক প্রকাশ করা হয় আর নবম দিন শহিদ ইমাম হোসেন আর তার ছয় মাসের শিশুপুত্র আলি আসগরের জন্য রক্ষিত থাকে। শেষ দিন অর্থাৎ দশম দিনে মিছিল করে তাজিয়া নিয়ে মুসলমানরা পথে নামেন। তাজিয়া একটি আরবী শব্দ যা মূল শব্দ ‘আযা’ থেকে এসেছে যার অর্থ- সান্ত্বনা দেওয়া, সমবেদনা জানানো, ধৈর্যধারণ করতে বলা।
তাজিয়া শব্দটির মূল অর্থ – মৃত ব্যক্তির শোকাতুর আত্মীয়দের সমবেদনা জানানো। এক অর্থে, তাজিয়া একটি প্রতীক যাকে কেন্দ্র মহররমের ‘আজাদারী’ (শোকের অনুষ্ঠান এবং কারবালার ট্র্যাজেডির সাংস্কৃতিক চিত্র) প্রথা আবর্তিত হয়। আজাদারী আসলে কারবালার সেই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হওয়ার পর যাঁদের কবর দেওয়া হয়নি।
আশুরার দিন আখড়ার মাধ্যমে একটি প্রতীকী যুদ্ধপ্রদর্শন করা হয়। তরোয়াল নিয়ে অনেকে নিজের গায়ে দাগ কাটেন, অনেকে ক্রমাগত নিজের পিঠে চাবুক মারতে থাকেন ‘হায় হাসান! হায় হোসেন!’ বলতে বলতে। আর এসবের মধ্য দিয়ে নিজেকে কষ্ট দিয়ে হোসেনের সেদিনের কষ্টকে অনুভব করতে চান তারা। তবে এসবের পাশাপাশি তিন দিন ব্যাপী একটি সভার রেওয়াজও আছে অনেক জায়গায়।
এই সভা প্রথম হোসেনের বোন জয়নব করেছিলেন হোসেনের মৃত্যুর পরে। এই সভার তিনটি পৃথক ভাগ রয়েছে। প্রথম ভাগ অর্থাৎ ‘সোজ’-এ কারাবন্দী থাকাকালীন হোসেন ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের প্রতি যে অত্যাচার তার কাহিনী পাঠ করা হয়। দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ ‘হাদিস’-এ হোসেনের পরিবার-পরিজনদের বর্ণনা দেওয়া হয়। এই হাদিসের আবার দুটি পর্ব – ফাজায়েল আর মাসায়েব। সবশেষে ‘নূহা’ অংশে ঠিক কী কী অত্যাচার করা হয়েছিল হোসেনের উপর তার লোমহর্ষক নৃশংস বর্ণনা থাকে। অনেক শিয়া ইতিহাসবিদের লেখায় এই সভা উদ্যাপনের উল্লেখ থাকলেও বর্তমানে খুব একটা এই রীতি আর পালিত হয় না।