মুর্শিদাবাদ জেলা | Murshidabad

পশ্চিমবঙ্গ West Bengal বেশীরভাগ জেলাই স্বাধীনতার আগে থেকে ছিল। কিছু জেলা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গঠিত, আবার কিছু জেলা একটি মূল জেলাকে দুভাগে ভাগ করে তৈরি হয়েছে মূলত প্রশাসনিক সুবিধের কারণে। প্রতিটি জেলাই একে অন্যের থেকে যেমন ভূমিরূপে আলাদা, তেমনি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও স্বতন্ত্র। প্রতিটি জেলার এই নিজস্বতাই আজ আমাদের বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে। সেরকমই একটি জেলা হল মুর্শিদাবাদ Murshidabad।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদা বিভাগের একটি জেলা Murshidabad মুর্শিদাবাদ। ভৌগলিক দিক থেকে দেখলে এই জেলার উত্তরে মালদা জেলা ও বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা, দক্ষিণে নদীয়া জেলা, পশ্চিমে বীরভূম জেলা এবং উত্তর-পশ্চিমে ঝাড়খণ্ডের পাকুড় জেলা, উত্তর-পূর্বে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা, এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে পূর্ব বর্ধমান জেলা অবস্থিত৷ পশ্চিমবঙ্গের মাঝখানে অবস্থিত এই জেলাটি অনেকটা ত্রিভুজাকৃতিবিশিষ্ট। মুর্শিদাবাদ জেলার প্রধান নদী ভাগীরথী।
এই নদী জেলাকে দুভাগে ভাগ করেছে।মুর্শিদাবাদ পাঁচটি মহকুমায় বিভক্ত, যথা – বহরমপুর সদর, কান্দি, জঙ্গীপুর, লালবাগ, ডোমকল। এই জেলার সদর দপ্তর বহরমপুর শহরে অবস্থিত। ৫৩২৪ বর্গ কিমি অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত এই জেলা আয়তনের বিচারে রাজ্যে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে৷ ২০১১ সালের জনগননা অনুসারে মুর্শিদাবাদ সমগ্র রাজ্যে জনসংখ্যার বিচারে তৃতীয় স্থান অধিকার করে। মুর্শিদাবাদের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় মুর্শিদাবাদের প্রাচীন নাম ছিল মুখসুসাবাদ, যা লোকমুখে প্রচারিত হয় মুখসুদাবাদ নামে।
পরবর্তীকালে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁয়ের নাম থেকেই মুর্শিদাবাদ শহর এবং জেলার নামকরণ করা হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মুর্শিদাবাদ ছিল বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার রাজধানী। এই মুর্শিদাবাদেই ছিল রাজ্যের কোষাগার, রাজস্ব অফিস। বিচার বিভাগীয় কাজকর্মও এখান থেকেই হত। বিশ্ব নগরী (cosmopolitan city) হিসেবে এই জেলা সমগ্র বাংলায় খ্যাতি অর্জন করেছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ফরাসী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ড্যানিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিসহ ইউরোপীয় সংস্থাগুলি এই মুর্শিদাবাদকে কেন্দ্র করেই ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে।
মুর্শিদাবাদ একসময়ে রেশম শিল্প, হাতির দাঁত, হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীত এবং মুঘল চিত্রের জন্য বিখ্যাত ছিল। ১৭১৭ সালে বাংলার রাজধানী করা হয় মুর্শিদাবাদকে। এই সময়ে মুর্শিদাবাদের নবাব ছিলেন সিরাজউদ্দৌলা। ১৭৫৭ সালের ২৫ জুন পলাশীর প্রান্তরে সিরাজউদ্দৌলা ও তাঁর সেনাবাহিনীর সঙ্গে ব্রিটিশ বাহিনীর যে মরণপণ যুদ্ধ হয়েছিল তা কেবল বাংলাই নয়, সমগ্র ভারতের ভবিষ্যত রচনা করেছিল। শেষ পর্যন্ত পলাশীর যুদ্ধে হেরে যান বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ।
এর ছয় বছর পর মুর্শিদাবাদ থেকে বাংলার রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তর করা হয়। এই জেলায় বাংলা ভাষাভাষী মানুষের আধিক্য বেশী দেখা যায়। সরকারি কাজকর্মের ক্ষেত্রে বাংলা এবং ইংরেজি ভাষার ব্যবহার দেখা যায়। ধান ও পাট এই জেলার প্রধান শস্য। মুর্শিদাবাদ জেলায় কৃষিকাজই বলতে গেলে অর্থনীতির মূল ধারক ও বাহক৷ এখানে প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়৷ এছাড়াও প্রায় ২২-২৩ হাজার হেক্টর জমিতে আউস এবং ১ লক্ষ ৭ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ হয়ে থাকে।
অন্যান্য ফসল হয়ে থাকে ৫৫-৬০ হাজার হেক্টর জমিতে। মুর্শিদাবাদ জেলার ভ্রমণ তালিকা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে শুরুতেই যদি হাজারদুয়ারির নাম না থাকে৷ ১০০০টি দরজা (৯০০টি আসল) যুক্ত প্রাসাদের নাম হাজারদুয়ারি। নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের বংশধর নবাব নাজিম হুমায়ুন জাহের নির্দেশে ১১৪টি ঘর ও ৮টি গ্যালারি যুক্ত এই প্রাসাদটি তৈরি করেছিলেন ডানকান ম্যাকলিওড। হাজারদুয়ারি প্রাসাদের ভিতর অবস্থিত মিউজিয়ামে রাখা আছে বাংলার প্রাচীন নবাবদের ব্যবহৃত সামগ্রীর বিভিন্ন নিদর্শন।
হাজারদুয়ারি প্রাসাদের উল্টো দিকে ১৮৪৭ সালে নির্মিত হয়েছিল নিজামাত ইমামবাড়া যা বাংলা তথা ভারতের অন্যতম বৃহৎ ইমামবাড়া। নবাব নাজিম মনসুর আলি খান ফেরাদুন জাহের আমলে নির্মিত এই ইমামবাড়ার আশাপাশের বাচ্চাওয়ালি তোপ, দক্ষিণ দরওজা, ছক দরওয়াজা, ঘড়ি ঘর এই স্থানের অন্যতম আকর্ষণের অঙ্গ। নিজামাত ইমামবারার ঠিক সামনে মদিনা মসজিদ অবস্থিত।
এই মসজিদ সিরাজউদ্দৌলা কারবালা থেকে মাটি এনে তৈরি করেছিলেন বলে কথিত আছে। তাঁর মায়ের ইচ্ছায় নবাব সাদা রঙের এই চার গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ তৈরী করেছিলেন৷ হাজারদুয়ারি থেকে দেড় কিলোমিটার উত্তরে দেউরির উল্টো দিকে অবস্থিত জাফরাগঞ্জ সমাধিস্থল৷ শোনা যায় এখানে ১০০০ জনকে কবর দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কাটরা মসজিদ, মতিঝিল, কাঠগোলা প্রাসাদ, পলাশির প্রান্তর অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র এই জেলার। রাজ্যের সব থেকে বেশি পাট উৎপন্ন হয় মুর্শিদাবাদে।
পাটের তৈরী নানা দ্রব্যাদি বিশেষ করে পাটের পুতুল এখানকার হস্ত শিল্পের মূল আকর্ষণ। নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় আর একটি হস্ত শিল্পের সমৃদ্ধি ঘটেছে এই জেলায় সেটি হল কাঠের তৈরী নানা প্রকার ঘর সাজানোর সরঞ্জাম৷ মুর্শিদাবাদে তৈরী সিল্ক এবং রেশমের কাপড় জগৎ বিখ্যাত। কেবল স্থানীয় নয় জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাকগুলির চাহিদা প্রচুর বিশেষ করে মুর্শিদাবাদের বালুচর শহরে বিখ্যাত বালুচরি শাড়ি খ্যাতি লাভ করেছে৷
বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিগন এই জেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বিশিষ্ট বাঙ্গালী ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, বাঙালি গল্পকার, কবি এবং ঔপন্যাসিক মনীশ ঘটক, বিখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, শিক্ষাবিদ এবং স্বনামধনয় বিজ্ঞান লেখক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, লেখক নবারুণ ভট্টাচার্য, প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবুল বাশার, বিখ্যাত গায়ক অরিজিৎ সিং এবং গায়িকা শ্রেয়া ঘোষাল৷
মুর্শিদাবাদ জেলা পাঁচটি মহকুমা নিয়ে গঠিত। পৌরসভা এলাকা বাদে প্রতিটি মহকুমায় একাধিক সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক রয়েছে যা আবার গ্রামীণ এলাকা এবং আদমশুমারি শহরে বিভক্ত। মুর্শিদাবাদ জেলায় মোট ৮টি পৌরসভা ও ২৬টি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক রয়েছে। ◻ বহরমপুর সদর মহকুমার পৌরসভা ও ব্লকসমূহ • বহরমপুর ও বেলডাঙ্গা পৌরসভা • বহরমপুর, বেলডাঙ্গা- ১, বেলডাঙ্গা- ২, হরিহরপাড়া ও নওদা সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক ◻ ডোমকল মহকুমার পৌরসভা ও ব্লকসমূহ
ডোমকল পৌরসভা • ডোমকল, রাণীনগর- ১, রাণীনগর- ২ ও জলঙ্গী সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক ◻ লালবাগ মহকুমার পৌরসভা ও ব্লকসমূহ • মুর্শিদাবাদ ও জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ পৌরসভা • মুর্শিদাবাদ-জিয়াগঞ্জ, ভগবানগোলা- ১, ভগবানগোলা- ২, লালগোলা ও নবগ্রাম সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক ◻ কান্দি মহকুমার পৌরসভা ও ব্লকসমূহ • কান্দি পৌরসভা • কান্দি, খড়গ্রাম, বড়ঞা, ভরতপুর- ১ ও ভারতপুর- ২ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক ◻ জঙ্গীপুর মহকুমার পৌরসভা ও ব্লকসমূহ • জঙ্গীপুর ও ধুলিয়ান পৌরসভা।
সাগরদিঘী, রঘুনাথগঞ্জ-১, রঘুনাথগঞ্জ- ২, সুতি- ১, সুতি-২, সামশেরগঞ্জ ও ফারাক্কা সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক পুলিশ প্রশাসনিক সার্কেল ও থানাঃ মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশ পাঁচটি সার্কেলে বিভক্ত। প্রতিটি সার্কেল আবার কয়েকটি করে থানা নিয়ে গঠিত। মুর্শিদাবাদ জেলায় মোট ২৯টি থানা রয়েছে। ◻ বহরমপুর সদর সার্কেলের থানাসমূহ • বহরমপুর, বেলডাঙা, রেজিনগর, হরিহরপাড়া, নওদা, দৌলতাবাদ ও শক্তিপুর থানা এবং বহরমপুর মহিলা থানা ◻ লালবাগ সার্কেলের থানাসমূহ •
মুর্শিদাবাদ, লালগোলা, জিয়াগঞ্জ, ভগবানগোলা, রানীতলা ও নবগ্রাম থানা ◻ ডোমকল সার্কেলের থানাসমূহ • ডোমকল, জলঙ্গী, ইসলামপুর ও রাণীনগর থানা ◻ কান্দি সার্কেলের থানাসমূহ • কান্দি, বড়ঞা, খড়গ্রাম, ভরতপুর ও সালার থানা ◻ জঙ্গীপুর সার্কেলের থানাসমূহ • সাগরদিঘী, রঘুনাথগঞ্জ, সূতি, সামসেরগঞ্জ ও ফরাক্কা থানা এবং জঙ্গিপুর মহিলা থানা।