নবীনচন্দ্র সেন এর জীবনী

নবীনচন্দ্র সেন এর জীবনী

বাংলা সাহিত্যে প্রাক্‌-রবীন্দ্রযুগের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবি হিসেবে বিখ্যাত নবীনচন্দ্র সেন (Nabinchandra Sen)। উনিশ শতকের নবজাগরণের সময়কালে আখ্যানকাব্য ধারার শেষ কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। আখ্যানকাব্য এবং গীতিকাব্য রচনার মধ্য দিয়ে তাঁর স্বাদেশিকতার পরিচয়ই ফুটে ওঠে। তাঁর লেখা ‘পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্যগ্রন্থটি সেই সময়ে আলোড়ন তৈরি করেছিল দেশবাসী ও তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে।

নবীনচন্দ্রের কবিতার রসমাধুর্য তাঁকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। কবি মাইকেল মধুসূদনের পথ অণুসরন করেও তিনি আপন স্বকীয়তা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। ‘পলাশীর যুদ্ধ’ ছাড়াও তাঁর লেখা অন্যতম বিখ্যাত আখ্যানকাব্যের ট্রিলজি হল ‘রৈবতক’, ‘কুরুক্ষেত্র’ এবং ‘প্রভাস’। ১৮৪৭ সালের ১০ ফ্রেব্রুয়ারি অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায় নোয়াপাড়া গ্রামে এক সুপ্রসিদ্ধ বৈদ্য জমিদার পরিবারে নবীনচন্দ্র সেনের জন্ম হয়।

নবীনচন্দ্রের বাবার নাম ছিল গোপীমোহন রায় এবং মায়ের নাম রাজরাজেশ্বরী দেবী। নবীনচন্দ্রের জন্মের তৃতীয় দিনে তাঁদের গ্রামটি এক ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডে ভষ্মীভূত হয়ে যায়, যার ফলে আবার নতুন করে সব তৈরি করতে হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নবীনচন্দ্রের পরিবারের গুরুপত্নী তাঁর নাম রাখেন ‘নবীন’। নবীনচন্দ্রের পূর্বপুরুষ বৌদ্ধ সেন রাঢ় বাংলায় তাঁদের আদি নিবাস থেকে পূর্ববঙ্গে চলে আসেন মহারাষ্ট্র বিপ্লবের সময়।

বৌদ্ধ সেন ছিলেন তৎকালীন ঢাকার নবাবের কার্য্যকারক। নবাব বৌদ্ধ সেনের কাজে খুশি হয়ে তাঁকে ‘রায়’ উপাধি প্রদান করেন। সেই থেকে নবীনচন্দ্রের পূর্বপুরুষরা ‘রায়’ উপাধি ব্যবহার করেন। নবীনচন্দ্র নিজে অবশ্য তাঁর আদি পদবি হিসেবে ‘সেন’ ব্যবহার করতেন। নবীনের বাবা গোপীমোহন পেশায় ছিলেন চট্টগ্রাম জজ আদালতের মুহুরি।

তাঁর ফার্সি ভাষায় বিশেষ দক্ষতার জন্য তিনি ইংরেজ মহলে যথেষ্ট সম্মান অর্জন করেছিলেন।  নবীনচন্দ্রের শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের পাঠশালায়। এরপরে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন তিনি। তারপর সেই স্কুল থেকে তিনি ১৮৬৩ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি লাভ করেন।

এরপরে তিনি ১৮৬৫ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ. এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার জেনারেল অ্যাসেম্বলিস ইনস্টিটিউশন (বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ) থেকে ১৮৬৮ সালে স্নাতক উত্তীর্ণ হন। তাঁর পুত্র প্রমথলাল সেন ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের এক অন্যতম প্রচারক। নবীনচন্দ্রের কর্মজীবন শুরু হয় হেয়ার স্কুলে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে।

এরপরে তিনি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মাত্র একুশ বছর বয়সে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত হন। তিনি সেই সময়ে বিভিন্ন স্হানে বহু জনহিতকর কাজ করেন। সমাজ সংস্কারেরও ক্ষেত্রেও নবীনচন্দ্র সেন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বাংলা, বিহার ও ত্রিপুরার বিভিন্ন স্হানে দক্ষতার সঙ্গে নিজের কর্মদক্ষতার প্রমাণ রাখেন তিনি।

চট্টগ্রামে চা বাগান মালিকদের সঙ্গে স্হানীয় অধিবাসীদের জমি সংক্রান্ত মামলা নিজ দায়িত্বে নিষ্পত্তি করেন নবীনচন্দ্র। চট্টগ্রামের বাঁশখালিতে সমুদ্র-তীরবর্তী বাঁধ নির্মাণ করে সেখানকার স্হানীয় অধিবাসীদের অশেষ দুর্ভোগের অবসান ঘটিয়েছিলেন তিনি। রানাঘাটের মহকুমা শাসক থাকাকালীন মহাকবি কৃত্তিবাসের বসতভিটা উদ্ধার করে নবীনচন্দ্র সেন তা সংস্কার করেন।

ফেনী জেলায় তিনি একটি স্কুল স্হাপন করেছিলেন যা আজ ‘ফেনী হাই স্কুল’ নামে পরিচিত। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। ছাত্রজীবন থেকেই নবীনচন্দ্র কবিতা লিখতে শুরু করেন। কবিতা রচনার ক্ষেত্রে তাঁর আদর্শ ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর প্রথম দিকের বেশ কিছু কবিতায় একান্ত ব্যক্তিগত অনুভবের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন তিনি মাইকেল প্রবর্তিত অমিত্রাক্ষর ছন্দের মাধ্যমে। তাঁর স্বদেশপ্রেমের কবিতাগুলিতে পূর্বতন কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রভাব দেখা যায়।

উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের ভাবধারায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনিই প্রথম বাংলায় খণ্ড কবিতার প্রচলন করেন। খণ্ড কবিতা দিয়ে তাঁর কবিজীবন শুরু হলেও শেষ দিকে তিনি মহাকাব্যও রচনা করেছেন। তাঁর কবিতাগুলিতে স্বদেশপ্রেম তথা ভক্তিবাদের রস যেমন পরিলক্ষিত হয়, তেমনই সেগুলি মধ্যযুগীয় ধর্মসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে আধুনিক যুক্তিতে রচিত। সেই কারণেই নবীনচন্দ্র ছিলেন উনিশ শতকের নবজাগরণের কবি। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সান্নিধ্যে এসে তাঁর কবিতা লেখার উৎসাহ দ্বিগুণ বেড়ে যায়।

তাঁর প্রথম কবিতা ‘কোন এক বিধবা কামিনীর প্রতি’ প্রকাশিত হয় প্যারীচরণ সরকারের সম্পাদিত ‘এডুকেশন গেজেট’ পত্রিকায়। পরবর্তীকালে তিনি নিয়মিত ‘এডুকেশন গেজেট’, ‘বঙ্গদর্শন’ ও ‘অমৃত বাজার’ পত্রিকায়  লিখতে শুরু করেন। ১৮৭১ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অবকাশরঞ্জিনী’র প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের একুশটি কবিতাই তাঁর আঠারো থেকে তেইশ বছর বয়সে রচিত। তাঁর কবিতা লেখার ক্ষেত্রে তিনি সবচেয়ে বেশি অণুপ্রেরণা পেয়েছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রীর থেকে।

তিনি নিজের জীবনের দুঃখের কাহিনীকে কাব্যের আকারে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন এই কাব্যগ্রন্থে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর নিজস্ব সম্পাদনায় ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ‘অবকাশরঞ্জিনী’র সমালোচনা করেন স্বয়ং। এই কাব্যগ্রন্থ নবীনচন্দ্রকে কবি হিসেবে পাঠকমহলে পরিচিতি এনে দেয়। ১৮৭৫ সালে নবীনচন্দ্রের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘পলাশীর যুদ্ধ’ প্রকাশিত হয়। তাঁর এই কাব্যগ্রন্থে স্বদেশপ্রেমের কথা বারবার উল্লিখিত হয়েছে। ‘পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে নবীনচন্দ্র শুধু  কবিসমাজেই নয় জনসাধারণের কাছেও কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।

পলাশীর যুদ্ধে সিরাজদ্দৌলার পরাজয় এবং ইংরেজদের ভারতে শাসনকার্য পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ঘটনাবলীকে তিনি ‘ভারতবর্ষের কালো অধ্যায়’ বলে চিহ্নিত করে এমনভাবে ব্যক্ত করেছিলেন যা পাঠকদের হৃদয়ে স্বদেশপ্রেম জাগ্রত করেছিল। এর ফলে নবীনচন্দ্র দেশপ্রেমিক কবি হিসেবে যেমন খ্যাতি লাভ করেন, তেমনই তাঁর কর্মস্থলে তিনি ব্রিটিশ কর্মচারীদের বিরাগভজন হন।

স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রও এই কাব্যপাঠ করে কাব্যের সমালোচনায় নবীনচন্দ্রকে ইংরেজ কবি লর্ড বায়রনের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ১৮৭৫ সালে ‘অবকাশরঞ্জনী’র দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয়। এই খণ্ডে ৪৬টি কবিতা ছিল। চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রেক্ষাপটে লেখা তাঁর ‘রঙ্গমতী’ কাব্যগ্রন্থটি, বঙ্কিমচন্দ্রের রোমান্টিক ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে অমিত্রাক্ষর ছন্দে তিনি এই কাব্যটি রচনা করেছিলেন। কর্মসূত্রে পুরীতে থাকাকালীন তিনি মহাভারত পাঠ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরিত্রটি নিজের কল্পনায় পুনর্নির্মাণ করেন।

 তিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ এবং কৃষ্ণের চরিত্রকে তাঁর কল্পনা দিয়ে নতুনভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে। তাঁর সৃষ্ট  ‘রৈবতক’, ‘কুরুক্ষেত্র’, ‘প্রভাস’ এই তিনটি কাব্যগ্রন্থ মহাভারতের প্রেক্ষাপটে রচিত এক অনবদ্য ট্রিলজি। এই ট্রিলজির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রৈবতক’ প্রকাশ পেয়েছিল ১৮৮৭ সালে, তারপর ১৮৯৩ সালে প্রকাশ পায় ‘কুরুক্ষেত্র’ কাব্যগ্রন্থ এবং ১৮৯৬ সালে এই ট্রিলজির শেষ কাব্য ‘প্রভাস’ প্রকাশিত হয়।

নবীনচন্দ্রের মতে মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ মূলত আর্য এবং অনার্য জাতির যুদ্ধ। শ্রীকৃষ্ণ এই দুই জাতিকে সম্মিলিত করে এক নতুন রাজ্য স্হাপন করেছিলেন। নবীনচন্দ্র শ্রীকৃষ্ণকে সমাজ সংস্কারক হিসেবে দেখিয়েছিলেন তাঁর এই ত্রয়ী কাব্যে। অনেকেই নবীনচন্দ্রের এই ত্রয়ী কাব্যকে ‘আধুনিক মহাভারত’ও বলে থাকেন। ‘রৈবতক’-এ শ্রীকৃষ্ণের আদিলীলা, ‘কুরুক্ষেত্র’-এ মধ্যলীলা এবং ‘প্রভাস’-এ শ্রীকৃষ্ণের অন্তিমলীলা তিনি নিজস্ব যুক্তির বিচারে রচনা করেছেন।

সমালোচকেরা বলে থাকেন প্রভাস কাব্যের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা ‘কৃষ্ণচরিত্র’ প্রবন্ধের খানিক প্রভাব রয়েছে। শুধু কাব্যগ্রন্থ নয়, ‘ভানুমতী’ নামে একটি উপন্যাস ও নিজের আত্মজীবনী ‘আমার জীবন’ নামে দুটি গদ্যগ্রন্থও রচনা করেছিলেন নবীনচন্দ্র সেন। তাঁর জীবন কাহিনীটি  পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত একটি উপন্যাসের মতই পাঠ্যগ্রন্থ। এই গ্রন্থটি তৎকালীন সমাজব্যবস্থা, রাজনৈতিক অবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ নথি বলা চলে।

‘ভানুমতী’ উপন্যাসটি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক জীবনের কাহিনী। উপন্যাসের  বাস্তবের চরিত্রগুলিকে কবি নির্মাণ করেছেন নিজের কল্পনা দিয়ে। নিজের স্ত্রীকে লেখা চিঠিগুলি তিনি প্রকাশ করেছেন ‘প্রবাসের পত্র’ নামে। সংস্কৃতে লেখা ‘ভাগবত গীতা’ এবং ‘চণ্ডী শ্লোক’-এর বাংলা অনুবাদও করেছিলেন তিনি। ১৮৯৫ সালে ভগবান বুদ্ধকে নিয়ে তিনি  রচনা করেন ‘অমিতাভ’ নামে একটি অনবদ্য কাব্যগ্রন্থ।

এছাড়াও ১৮৭৭ সালে চট্টগ্রামে বাঁশখালিতে থাকাকালীন রানি ক্লিওপেট্রার জীবনী নিয়ে নবীনচন্দ্র লেখেন ‘ক্লিওপেট্রা’ কাব্যগ্রন্থ এবং শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনী অবলম্বনে ‘অমৃতাভ’ কাব্য রচনা করেন তিনি। ১৮৯০ সালে যিশুখ্রিস্টের জীবনী অবলম্বনে ‘খ্রীষ্ট’ নামেও একটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন নবীনচন্দ্র সেন। ১৯০৯ সালের ২৩ জানুয়ারি নবীনচন্দ্র সেনের মৃত্যু হয়।