নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী এর জীবনী

ভারতীর ফুটবলের জনক বলা হয় নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী কে (Nagendra Prasad Sarbadhikari)। ভারতে ক্লাব ফুটবলের জনক তিনিই, ভারতের প্রথম ফুটবল ক্লাব ‘বয়েজ ক্লাব’ তাঁরই প্রতিষ্ঠিত। ব্রিটিশদের সঙ্গে ফুটবল খেলায় শোভাবাজার ক্লাবের হয়ে প্রথম ‘ফ্রেণ্ডস্ কাপ’ জয় করেন নগেন্দ্রপ্রসাদ। শোনা যায় স্বামী বিবেকানন্দও নাকি উৎসাহিত হয়ে মাঠে নগেন্দ্রপ্রসাদের সঙ্গে ব্রিটিশদের ফুটবল ম্যাচ দেখতে আসতেন।
পরবর্তীকালে তাঁর হাত ধরেই রাগবি, হকি, টেনিস, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলাও প্রবর্তন হয় ভারতে। প্রথম ভারতীয় হিসেবে ওভার হেড বোলিং করার কৃতিত্ব তাঁরই। এমনকি ভারতীয়দের প্রথম রাগবি দল নগেন্দ্রনাথই তৈরি করেন। বিদেশি খেলার পাশাপাশি তিনি দেশীয় খেলাগুলিতেও ভারতের যুবকদের উৎসাহ জুগিয়েছেন।
পরাধীন ভারতবর্ষের যুবকদের ঔপনিবেশিকতা, জাতপাতের ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্ত করে খেলার মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে নিরন্তর সচেষ্ট ছিলেন নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী। ১৮৬৯ সালের ২৭ আগস্ট কলকাতায় নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী র জন্ম হয়। পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলায় ছিল তাঁদের আদিবাড়ি। তাঁর বাবা সূর্যকুমার সর্বাধিকারী ছিলেন ব্রিগেডিয়ার রায় বাহাদুর ব্রিটিশ ভারতের একজন সার্জেন এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল হেমলতা দেবী।
সিপাহি বিদ্রোহের সময় ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে কাজ করেছিলেন সূর্যকুমার সর্বাধিকারী। নগেন্দ্রপ্রসাদরা ছিলেন সাত ভাই ও এক বোন। তাঁর এক ভাই স্যার দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন, আরেক ভাই সুরপ্রসাদ সর্বাধিকারী ছিলেন বিশিষ্ট সার্জেন যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মেসোপটেমিয়ায় গিয়ে চাকরি করেন এবং পরবর্তীকালে ডাক্তার রাধাগোবিন্দ করের সঙ্গে একত্রে ‘কারমাইকেল কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন কলকাতায়।
১৮৭৭ সালের একদিন মায়ের সঙ্গে গাড়িতে করে গঙ্গাস্নানে যাওয়ার সময় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাশের মাঠে একদল দীর্ঘদেহী ইংরেজদের একটা গোলাকার বস্তু নিয়ে খেলতে দেখেন বালক নগেন্দ্রপ্রসাদ। ‘ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাব’-কে খেলতে দেখে খুব আগ্রহী হয়ে গাড়ি থেকে নেমে তিনি তাঁদের সেই খেলা দেখতে থাকেন। মাত্র দশ বছর বয়সী নগেন্দ্রপ্রসাদের সামনে হঠাৎ বলটা চলে আসে আর ব্রিটিশরা তাঁকে নির্দেশ দিতে থাকেন ক্রমাগত বলে কিক করার জন্য।
ব্রিটিশদের বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে তিনি খালি পায়েই প্রথম শট মারেন ফুটবলে, ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে সেটাই ভারতীয়দের প্রথম ফুটবল কিক। উৎসাহিত হয়ে পড়েন নগেন্দ্রপ্রসাদ, পরের দিনই তাঁর হেয়ার স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে চাঁদা তুলে তিনি একটি বল কিনে ফুটবল খেলতে শুরু করেন। নগেন্দ্রপ্রসাদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় হেয়ার স্কুলে। ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষায় দক্ষ নগেন্দ্রপ্রসাদ এরপরে স্কুলশিক্ষা শেষ করে হেয়ার স্কুলের পর প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই তাঁর পড়াশোনা শেষ করেন।
হিন্দু ধর্মশাস্ত্র ও তন্ত্রশাস্ত্রেও তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল। সেই আগ্রহ থেকেই তিনি গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। কীর্তন গানেও অনায়াস দক্ষতা ছিল নগেন্দ্রপ্রসাদের। পরবর্তীকালে শোভাবাজার রাজবাড়ির রাজা আনন্দকৃষ্ণ দেবের মেয়ে কমলিনীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। তাঁর ফুটবল খেলায় উৎসাহ দেখে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক মিঃ স্ট্যাক নিজ উদ্যোগে নগেন্দ্রপ্রসাদকে ফুটবল খেলা শেখান। তাঁর উৎসাহে নগেন্দ্রনাথ খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাংলার সেরা সেন্টার ফরওয়ার্ড হিসেবে অদ্বিতীয় হয়ে ওঠেন।
সেই সময়ে তিনি ময়দানে অনেকরকম খেলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। ব্রিটিশরা বাঙালিদের অলস ও ভিতু বলে অপমান করতো আর নগেন্দ্রপ্রসাদ সেই অপমানের উত্তর দিয়েছিলেন ফুটবল খেলা শিখে ও শিখিয়ে। কৈশোরেই তিনি বেশ কয়েকটি ক্লাব তৈরি করেন যার মধ্যে ‘বয়েজ ক্লাব’ হল ভারতে প্রতিষ্ঠিত প্রথম ফুটবল সংগঠন। এই ক্লাবের মাধ্যমেই তিনি কলকাতায় হকি ও টেনিস খেলার সূচনা করেন। এছাড়াও তিনি ‘ফ্রেন্ডস ক্লাব’, ‘হাওড়া স্পোর্টিং ক্লাব’, ‘চূচুড়াঁ ক্লাব’, ‘প্রেসিডেন্সি ক্লাব’ তৈরি করেন।
প্রেসিডেন্সি ক্লাব থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউশন, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ তাঁদের পৃথক পৃথক ফুটবল দল গঠন করে। নগেন্দ্রপ্রসাদের প্রতিষ্ঠিত ক্লাবগুলিতে বিভিন্ন ধরনের খেলার ব্যবস্হা ছিল। তাঁর প্রচেষ্টায় শহরের অভিজাত সম্প্রদায়ের ছেলেদের সঙ্গে শ্রমজীবী শ্রেণির যুবকরা একসঙ্গে ক্রীড়া ও শরীরচর্চা করার সুযোগ পেয়েছিল। ১৮৭৭ সাল থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত তিনি সর্বাধিক সাতশো ম্যাচ খেলেছেন। উনিশ শতকে ভারতে ব্রিটিশ সৈনিক, ব্যবয়াসীদের ফুটবল ম্যাচে ভারতীয়রা ছিলেন ব্রাত্য।
নগেন্দ্রপ্রসাদ তাঁর সহপাঠী চোরাবাগানের বিখ্যাত মল্লিক পরিবারের নগেন্দ্র মল্লিকের সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ফ্রেন্ডস ক্লাব’। তাঁর প্রতিষ্ঠা করা এই ক্লাব থেকেই যাত্রা শুরু হয় কলকাতা ক্লাব ফুটবলের। এরপরে তিনি ১৮৮৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ওয়েলিংটন ক্লাব’ যেখানে সদস্য সংখ্যা ছিল পাঁচশোর মতো। সমাজের অভিজাত শ্রেণির মানুষরা এই ক্লাবের সদস্য হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে গর্বিত মনে করতেন।
এই ক্লাবে ফুটবল ছাড়াও ক্রিকেট, হকি, রাগবি, টেনিস খেলার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু একবার কুমোরের ছেলে মনি দাসকে ওয়েলিংটন ক্লাবে সদস্য নিযুক্ত করা নিয়ে ক্লাব সদস্যদের সঙ্গে মনোমালিন্য হয় নগেন্দ্রপ্রসাদের। তিনি বর্ণবৈষম্যকে দূরে সরিয়ে রেখে এক সাম্যভাব নিয়ে ক্লাব গড়তে চেয়েছিলেন। সেই কারণেই মনি দাসের নিযুক্তি নিয়ে মনোমালিন্যের কারণে তিনি ওয়েলিংটন ক্লাব ভেঙে দেন। এরপর ১৮৮৬ সালে নগেন্দ্রপ্রসাদ স্হাপন করেন ‘শোভাবাজার ক্লাব’।
এই ক্লাবের প্রথম সদস্য হন মনি দাস যিনি পরবর্তীকালে মোহনবাগান দলের হয়ে ফুটবলের নেতৃত্ব দিয়ে নিজের প্রতিভার পরিচয় রেখেছিলেন। ‘শোভাবাজার ক্লাব’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে নগেন্দ্রপ্রসাদ যেন এক সামাজিক বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। তিনি এই ক্লাবের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন এবং তাঁরই নেতৃত্বে ‘শোভাবাজার ক্লাব’ কলকাতার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্লাবে পরিণত হয়। ১৮৯২ সালে একটি উন্মুক্ত ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয় যাতে ‘শোভাবাজার ক্লাব’ সমস্ত ইউরোপীয় ক্লাবগুলিকে ২-১ গোলে এ পরাজিত করে জিতে নেন ‘ট্রেডস কাপ’।
এই জয় শুধুমাত্র ভারতীয়দের জয় ছিল না, এই জয় ছিল ব্রিটিশদের অপমানজনক ব্যবহার ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে জয়। ইউরোপীয়ান ক্লাবের সঙ্গে ভারতীয় ক্লাবের খেলা দেখতে দর্শক হিসেবে হাজির ছিলেন স্বয়ং বিবেকানন্দ। ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে এই জয়ের জন্য নগেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারীকে শুধু কলকাতায় রাজবাড়িতে সম্মানিত করা হয়নি, সম্মান জানানো হয় পাঞ্জাবের পাতিয়ালাতেও। নগেন্দ্রনাথ বহু মানুষকে ফুটবল খেলার জন্য অণুপ্রাণিত করেন। তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ফুটবলের জগতে আসেন কালীচরণ মিত্র যিনি পরবর্তীকালে কিংবদন্তি ফুটবলার ‘গোষ্ঠ পাল’কে আবিষ্কার করেন।
১৮৮৩ সালে এক বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় যার সম্পূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছিলেন নগেন্দ্রপ্রসাদ। তিনি অনুভব করেছিলেন শুধু ফুটবল খেললেই হবে না, তৈরি করতে হবে খেলার উপযুক্ত পরিকাঠামো। সেই উদ্দেশ্যেই ১৮৯২ সালে ‘ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাব’, ‘ডালহৌসি ক্লাব’ ও ‘ন্যাভাল ভলান্টিয়ার্স’ এই তিন ক্লাবের সঙ্গে মিলে তিনি আয়োজন করেন সর্বভারতীয় শিল্ড। এই শিল্ড পরিচালনার জন্য তৈরি হয় ‘ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন’। আইএফএ শিল্ড গঠনের উদ্যোগে নগেন্দ্রপ্রসাদই ছিলেন একমাত্র ভারতীয় সদস্য।
১৮৯২ সালে আইএফএ শিল্ড খেলা হয়। তাঁর পথ অণুসরন করে ১৮৮৯-তে ‘মোহনবাগান ক্লাব’ ও ১৯৯২তে ‘মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১১ সালে মোহনবাগানের আইএফএ শিল্ড জয়ের মতো ঐতিহাসিক ঘটনার নেপথ্যে ছিল নগেন্দ্রপ্রসাদের ভূমিকা। তিনিই ভারতীয় ফুটবলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে গিয়েছিলেন ।শুধু ফুটবল নয় ক্রিকেট খেলাতেও তাঁর দক্ষতা ছিল অসামান্য।
তিনিই ছিলেন প্রথম ভারতীয় ক্রিকেটার যার ওভার হেড বোলিং করার ক্ষমতা ছিল। মোনা বসু ও সুধন্যা বসু এই দুই বিখ্যাত ক্রিকেটার ছিলেন নগেন্দ্রপ্রসাদের শিষ্য। তাঁরই চেষ্টায় ক্রিকেট খেলায় ‘হ্যারিসন শিল্ড’ প্রতিযোগিতা শুরু হয় এবং এর মাধ্যমেই তিনি ইংরেজদের সঙ্গে ভারতীয়দের প্রতিযোগিতার পথ দেখিয়েছিলেন।
দীর্ঘ পঁচিশ বছর ভারতীয় ফুটবলকে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি কলকাতা হাইকোর্টের অ্যার্টনী জেনারেল হন। ফুটবলের পাশাপাশি নগেন্দ্রপ্রসাদ ছিলেন একজন নাট্যানুরাগী। শেক্সপিয়ারের নাটক ‘টেম্পেস্ট’ ও ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন নগেন্দ্রপ্রসাদ। ১৯৭৭ সালে নগেন্দ্রপ্রসাদের সম্মানার্থে ভারতীয় ফুটবলের শতবর্ষ পূর্তি উদযাপন হয় মাত্র, এর বেশি আর কেউ তাঁকে মনে রাখেনি। সম্প্রতি ২০১৯ সালে শ্রীভেঙ্কটেশ ফিল্মসের প্রযোজনায় পরিচালক ধ্রুব ব্যানার্জী নগেন্দ্রপ্রসাদের জীবনী অবলম্বনে নির্মাণ করেন ‘গোলন্দাজ’ চলচ্চিত্রটি যেখানে নগেন্দ্রপ্রসাদের ভূমিকায় দেখা যাবে অভিনেতা দেবকে। ১৯৪০ সালের ১৭ জানুয়ারি নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী র মৃত্যু হয়।