নৈহাটির বড়মা কালী পুজো

আপামর বাঙালিদের কাছে দীপাবলীর তৃতীয় দিনে দেবী কালী পূজিতা হন নানা বেশে, নানা রূপে। কোথাও রক্ষাকালী, কোথাও শ্যামা, কোথাও আবার শ্মশানকালী আর কোথাও দেবী পূজিতা হন উগ্রচণ্ডা চামুণ্ডাকালী রূপে। একেক জায়গায় দেবীর নামও একেক রকম দেখা যায়। দক্ষিণেশ্বরে যিনি ভবতারিণী, সেই কালীই আবার তারাপীঠের তারা আর তিনিই হলেন বিখ্যাত ও জাগ্রত দেবী নৈহাটির বড় মা । শনি ঠাকুরকে অনেকে চলতি ভাষায় বড় ঠাকুর বলে থাকেন, একইরকমভাবে নৈহাটিতেও দেবী কালী পূজিতা হন বড় মা হিসেবে।
নৈহাটির অরবিন্দ রোডের ধর্মশালা বড় কালী ঠাকুরকেই স্থানীয় মানুষ ভক্তিভরে বড় মা বলে ডাকেন। বড় কালী মানে নাম মাহাত্ম্যেও বড় আবার আকারে-উচ্চতাতেও বড় সেই কালী ঠাকুরের মূর্তি। স্থানীয় মানুষের কাছে সেই কালী হল ১৪ হাত উঁচু। প্রকৃতপক্ষে কালী মূর্তির উচ্চতা ২১ ফুট। নৈহাটির অরবিন্দ রোডে এই কালীর পুজোকে ঘিরেই আড়ম্বরের ঢল নামে।
ভক্ত ও পুণ্যার্থী দর্শকদের ভিড়ে সমস্ত রাস্তা জমজমাট হয়ে ওঠে। ৯২ বছরের পুরনো এই কালীপুজো পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে অন্যতম ঐতিহ্যবাহী একটি পুজো। মানুষের বিশ্বাস জাগ্রত এই দেবী তাঁদের সকল মনোবাসনা পূরণ করেন এবং বহু মানুষ এই দিন নৈহাটিতে এসে গঙ্গাস্নান করে মায়ের প্যাণ্ডেলে দণ্ডী কাটেন। বহু আগে এই জনপদে ছোটোখাটো রক্ষাকালীর মূর্তিতেই পুজো করা হতো। আজ থেকে ৯০ বছর আগে স্বর্গীয় ভবেশ চক্রবর্তী এবং তাঁর চার জন বন্ধু মিলে নবদ্বীপে একবার ভাঙা রাস দেখতে গিয়েছিলেন।
আর সেখানে গিয়ে বড় বড় মূর্তি দেখে তাঁরা অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে পড়েন। আর এই বিশালাকায় মূর্তিগুলি দেখেই নৈহাটিতে ছোটো রক্ষাকালীর মূর্তির বদলে বিশালাকায় মূর্তি নির্মাণের পরিকল্পনা মাথায় আসে তাঁর। ভবেশ চক্রবর্তী প্রথম এই বড় কালীর মূর্তি স্থাপন করেন বলে নৈহাটির এই কালীর নাম ভবেশ কালী। কিছু বছর পরে, এর বৃহদায়তনের জন্য এটি ভবেশ কালী থেকে বড় মা নামেই পরিচিত হন। ২০২০ সালে এই পুজো ৯৩ বছরে পদার্পণ করেছে। প্রথমদিকে উদ্যোক্তা ভবেশ চক্রবর্তী বাড়ির পুজো হিসেবে কালীর আরাধনা করতেন, কালীকে ভাবা হতো বাড়িরই মেয়ে।
পরে এই পূজা সার্বজনীন হিসেবে গড়ে ওঠে। নৈহাটি বড় কালী পূজা সমিতি এই পূজার সমস্ত ব্যাপার তত্ত্বাবধান করে থাকে। নৈহাটিতে বড় মায়ের একটি মন্দিরও আছে। সেখানে নিত্যদিন পূজা হলেও যে কয়দিন বড় মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তিতে পূজা চলে, ততদিন মন্দিরে পুজো বন্ধ থাকে। সার্বজনীন পূজা হলেও এই পূজায় কোনোপ্রকার চাঁদা চাওয়া হয় না। ভক্তরাই নিজে থেকে গহনা, ভোগ এবং পূজার সমস্ত খরচ বহন করে থাকে। প্রতি বছরই বহু সংখ্যক পুণ্যার্থী ভক্ত বড় মাকে সোনা-রূপো কিংবা অর্থসাহায্য করে থাকেন।
নৈহাটির বড় মা -র মূর্তি প্রায় পুরোটাই সোনায় বা রূপোর গয়নায় ঢাকা থাকে সবসময়। বড় মাকে অন্য কোনো কিছুর গয়নাই পরানো হয় না। কেউ কেউ বলেন ভক্তদের দেওয়া প্রায় দেড় কোটি টাকার গয়না স্থানীয় একটি ব্যাঙ্কের লকারে গচ্ছিত রাখা থাকে এবং পুজোর সময় সেই লকার থেকেই গয়না পরানো হয় বড় মাকে। স্বর্ণালঙ্কারের উজ্জ্বল সাজে সেজে ওঠেন ঘনকৃষ্ণ তমসাময়ী বড় মা।
দুর্গাপূজার মতো এই কালীপূজাও পাঁচ দিন ধরে চলে মহা ধুমধাম করে। বিসর্জনের দিন দেবীমূর্তিকে ফুলের অলঙ্কারে সাজিয়ে তুলে বিশাল শোভাযাত্রা আয়োজিত হয়। ভক্তরা দেবীর উদ্দেশে বাতাসা ছুঁড়ে দেন, গঙ্গায় বিসর্জনের সময় পুরো নৈহাটি জুড়ে সবার আগে বড় মায়ের বিসর্জন হয় এবং তারপরেই অন্যান্য কালী মূর্তির বিসর্জন হয়।
১৯৭০ সালের আগে এই বিসর্জনের সময় এলাকার সবথেকে শক্তিশালী মানুষের কাঁধে করে নিয়ে যাওয়া হতো দেবীমূর্তি, পরে যদিও চাকা দেওয়া ঠেলা গাড়িতে তোলা হয় প্রতিমা। প্রতি বছরই এই বড় মায়ের ভক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কোজাগরী পূর্ণিমায় দেবীমূর্তির কাঠামো পুজো করা থেকে শুরু করে বিসর্জন পর্যন্ত নৈহাটিতে এক আলোর উৎসব যেন নেমে আসে। বড় মায়ের মাহাত্ম্যে আজও তাঁর কাছে মনস্কামনা পূরণের জন্য ছুটে আসেন অগণিত মানুষ।