নিশীথ প্রামাণিক | উপপ্রধান থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কোচবিহারের নিশীথ

ভারতের রাজনীতিতে, যেখানে ৫০ বছর বয়সী নেতাদেরই যুব নেতা হিসাবে ধরা হয়, সেখানে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে মোদী মন্ত্রিসভার সদস্য হলেন নিশীথ প্রামানিক। ২০১৩ সালে তিনি ছিলেন কোচবিহারের দিনহাটার ভেটাগুড়ি-১ পঞ্চায়েতের তৃণমূলের উপপ্রধান। ক্রমে কোচবিহারে যুব তৃণমূলের শক্তিশালী মুখ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তৃণমূলে থাকাকালীন কোচবিহারে কার্যত তাঁর দাপটে মাদার তৃণমূলের অনেকেরই রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল। কার্যত এলাকার দাপুটে নেতা হিসেবে পরিচিতি হয় তাঁর।
আর সেই সময় থেকেই কোচবিহারের এই যুবকের উত্থানের কাহিনি শুরু হয়েছিল। তৃণমূলের কোচবিহারের যুব নেতা নিশীথ প্রামানিকের দল থেকে বহিষ্কার করে। প্রসঙ্গত, কোচবিহারে বিজেপির গণতন্ত্র বাঁচাও যাত্রা নিয়ে আনেক টানাপোড়নের পরে একটি সভা হয়। সেখানে বিজেপি ব্যাপক জমায়েত করতে সমর্থ হয়। তৃণমূল কংগ্রেসের অনেক নেতাই মনে করেন, এই জমায়েতের পিছনে কোন না কোন ভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের জেলা সাধারণ সম্পাদক নিশীথ প্রামানিকের হাত রয়েছে। তার জন্যই দল তাঁকে বহিষ্কার করে।
সেই নিশীথ প্রামাণিকই গত লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপিতে যোগ দেন। কোচবিহারের বিজেপি প্রার্থী করে নিশীথ প্রামাণিকে। তখনি তাঁর বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ করেন গেরুয়া শিবিরের বহিষ্কৃত নেতা অশোক সরকার৷ বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বকে কাঠগড়ায় তুলে ফেসবুকে তিনি লিখলেন, ‘‘কোচবিহারের বিজেপি প্রার্থী নারীপাচার ও স্মাগলিং-এ অভিযুক্ত৷ এই মর্মে তদন্তের নোটিস দিয়েছিল মোদিবাবুরই সিবিআই।’’ এখানেই শেষ নয়, নিশীথ প্রামাণিকের বিরুদ্ধে যে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, সেই নির্দেশিকার প্রতিলিপিও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করেন অশোক সরকার৷ কেবল অশোক সরকারই নন, প্রার্থীতালিকা ঘোষণার পর রাত থেকেই গন্ডগোল শুরু হয়ে যায় কোচবিহারে৷
দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বাছাই করা প্রার্থী নিশীথ প্রামাণিকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখান জেলা বিজেপির নেতা-কর্মীরা৷ জেলার দলীয় কার্যলয়ে ভাঙচুর করেন তাঁরা৷ কার্যালয়ের সামনেই বিক্ষোভ কর্মসূচী পালন করেন৷ তাঁদের স্পষ্ট বক্তব্য, নিশীথ প্রামাণিকের বিরুদ্ধে একাধিক কুখ্যাত অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে৷ স্মাগলিং থেকে শুরু করে গরু পাচার, নারী পাচারের মতো বেআইনি ব্যবসার সঙ্গে যোগ রয়েছে তাঁর৷ পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে তা সামাল দিতে মাঠে নামতে হয় বিজেপির রাজ্যের সহ-পর্যবেক্ষক অরবিন্দ মেনন কে৷ লোকসভা ভোটে কোচবিহার আসনে জয় পায় বিজেপির নিশীথ প্রামাণিক।
সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে সারা দেশে যখন পদ্ম ঝড় বইছে, তখন কোচবিহারেও ফুটল পদ্ম। বরাবরই খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর গুডবুকে ছিলেন এই তরুণ সাংসদ। এবার তাঁকেই করা হচ্ছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। নিশীথ প্রামাণিক কোচবিহার জেলা থেকে প্রথম কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হলেন, একই সঙ্গে সর্বকালের প্রথম রাজবংশী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও বটে। তাই কোচবিহার জেলা এবং রাজবংশী সম্প্রদায়কে ভারতের মানচিত্রে তুলে ধরার কৃতিত্বও দিতে হবে নিশীথ প্রামাণিককেই। রাষ্ট্রমন্ত্রকে এই প্রথম জায়গা করে নিল কোচবিহার (Cooch Behar) তথা উত্তরবঙ্গ। রাজ্য থেকে এই গুরুত্বপূর্ণ দফতরের কনিষ্ঠতম মন্ত্রী হলেন ৩৫ বছরের নিশীথ প্রামাণিক (Nisith Pramanik)। ইদানীং তৃণমূলের বিরুদ্ধে গেরুয়া শিবিরের সবচেয়ে সরব মুখেদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
নিশীথের স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রতিমন্ত্রী হওয়া নিয়ে একাধিক জল্পনা শুরু হয়েছে গোটা রাজ্য তথা উত্তরবঙ্গের রাজনীতিতে। সূত্রের খবর, শিলিগুড়ি লাগোয়া ‘চিকেন নেক’এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হবেন নিশীথ প্রামাণিক। সেই নিশীথকে নিশানা করেই ফেসবুকে কোচবিহারের প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ লেখেন, ‘শুনলাম কোচবিহারের সাংসদ মন্ত্রী হচ্ছেন। বেশ ভাল কথা। কিন্তু লোকসভার সাইট খুঁজতে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। ওয়েবসাইটে সাংসদ মহাশয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখাচ্ছে B.C.A (Bachelor of Computer Application)।
কিন্তু ভোটে দাঁড়ানোর সময় হলফনামায় লেখা সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক। আমি না বিষয়টি বুঝতে পারলাম না! কেউ কি বোঝাবেন নাকি সাংসদ মহাশয় নিজেই বিষয়টি খোলসা করবেন। সামাজিক মাধ্যমেই কোচবিহারের মানুষের কাছে প্রশ্ন রাখলাম।’ নিশীথ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হতেই তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক তুলেছে তৃণমূল। ভারত সরকারের ওয়েবসাইট india.gov.in-এ ‘ইন্ডিয়ান পার্লামেন্ট’ বিভাগে নিশীথ সম্পর্কিত যে তথ্য দেওয়া রয়েছে তাতে লেখা, তাঁর কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনে ব্যাচেলর ডিগ্রি রয়েছে। অর্থাৎ তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা বিসিএ। বালাকুড়া জুনিয়র বেসিক স্কুল থেকে ওই ডিগ্রি পেয়েছেন তিনি।
আবার ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের সময় নিশীথ যে হলফনামা জমা দিয়েছেন তাতে লেখা, তাঁর সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক পাশ। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন তিনি। দিনহাটার ভেটাগুড়ি এলাকার লাল বাহাদুর শাস্ত্রী বিদ্যাপীঠের ছাত্র ছিলেন তিনি। বাংলা থেকে এবার মোট ৪ জনকে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী করেছেন নরেন্দ্র মোদী। বনগাঁর সাংসদ শান্তনু ঠাকুর, বাঁকুড়ার সাংসদ সুভাষ সরকার, আলিপুরদুয়ারের সাংসদ জন বার্লা এবং কোচবিহারের সাংসদ নিশীথ প্রামাণিক।
বঙ্গ বিজেপির এই চার রত্নের মধ্যে গুরুত্বের দিক থেকে নিশীথ প্রামাণিকের পাল্লা কিন্তু ভারী। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁকে। সরাসরি অমিত শাহের ডেপুটি হয়ে বসেছেন তিনি। এছাড়া যুবকল্যাণ ও ক্রীড়া মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পেয়েছেন কোচবিহারের সাংসদ। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের কাছে যে পশ্চিমবঙ্গের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে তা বলাই বাহুল্য। আর নিশীথ প্রামাণিকের মাধ্যমেই সরাসরি অমিত শাহ এবার বাংলার উপর নজরদারি জোরদার করতে পারবেন বলে মনে করছে পর্যবেক্ষক মহল। এতে সরকারের উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করাও সহজ হবে। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গেও প্রাক্তন তৃণমূল নেতা নিশীথ প্রামাণিকের হৃদ্যতা কম নেই। সবমিলিয়ে বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসকে টক্কর দিতে নরেন্দ্র মোদীর তুরুপের তাস হয়ে উঠতেই পারেন নিশীথ প্রামাণিক।