অম্বিকা কালনার অন্যতম হেরিটেজ মন্দির নন্দগ্রামের মহাপ্রভু মন্দির

কালনা শহরকে ‘কালী-ময়’ বললে অত্যুক্তি হবে না এতটুকু। শহরজুড়ে রয়েছে সিদ্ধেশ্বরী কালী, সাধন কালীর সাধন কুঞ্জ, আনন্দময়ী কালী, সিদ্ধান্ত কালী, সত্যনাথের কালী, সাধক যোগানন্দের কালী মন্দির। এই শহর যে এক সময় তন্ত্রসাধনার কেন্দ্র ছিল তারও প্রমাণ মেলে। এ ছাড়াও কালনা শহরে রয়েছে সাধক কমলাকান্তের জন্মভিটে, ভবাপাগলার আশ্রম। কালী থেকেই শহরের নামকরণ কালনা কি না, তা নিয়ে চর্চা চলে আজও।
শহরের নাম কালনা হলেও রেল স্টেশনের নাম অম্বিকা কালনা। শহরের আরাধ্য দেবী সিদ্ধেশ্বরী যা প্রাচীন জৈন দেবী অম্বিকারই পরিবর্তিত রূপ বলে মনে করা হয়। সেই দেবী অম্বিকার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই স্টেশনের নামকরণ অম্বিকা কালনা কি না, সেই মতও রয়েছে।বর্ধমান জেলায় শৈব শাক্তধর্মের পাশাপাশি বৈষ্ণবধর্ম ও লোকধর্মের অসংখ্য পীঠস্থান ছড়িয়ে রয়েছে। কালনা মহকুমার মন্দিরময় অম্বিকা কালনায় রয়েছে বিচিত্র টেরাকোটা দেব দেউল।মহকুমার অন্তর্গত নন্দগ্রামে রয়েছে সুপ্রাচীন নিতাই গৌর মন্দির। অবশ্য ভবানীপুর মোড় এলাকার মানুষের কাছে মন্দিরটি 'মহাপ্রভু মন্দির' হিসেবেই পরিচিত।
এখানকার সাধারণ গ্রামবাসীরা বেশিরভাগই তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত। পুরাকালে ভাগীরথী নদী বর্তমান মন্দির সংলগ্ন অঞ্চল দিয়েই প্রবাহিত ছিল বলে জানা যায়।কালের গতিতে ভাগীরথী প্রায় ২০০ হাত দূরে বড় রাস্তার অপর প্রান্তে বাঁক নিয়েছে।কথিত আছে সন্ন্যাস পরবর্তী সময়ে মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য জল পথে এই অঞ্চলে এসে উপস্থিত হন। মন্দির সংলগ্ন ভূমিখন্ডে একটি বকুল গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। মতান্তরে প্রভু নিজের হাতে একটি বকুল গাছ রোপণ করে ছিলেন।
এই সূত্র ধরেই মন্দিরের সামনে আজও একটি বিরাটাকর বকুল গাছের দেখা মেলে।যার ছায়া বিস্তৃত, গাছের গোড়া কংক্রিট দিয়ে বাঁধানো।গ্রামবাসীরা আজও ঐ বৃক্ষমূলকে মহাপ্রভুর অঙ্গ স্পর্শে দিব্য বিভূতিতে পরম মহিমান্বিত মনে করে বিশেষ শ্রদ্ধা ভক্তি করে থাকেন।এই বকুল গাছটির বিশেষত্ব হল, গাছটিতে সারা বছর ফুল হলেও ফলের দেখা মেলে না।
সুউচ্চ চুড়া বিশিষ্ট বর্তমান মন্দিরটির বয়স ১০০ বছরেরও বেশি, মন্দিরটি নির্মাণ করেন শ্রী নকুল ব্রক্ষ্মচারী, সুধীর দাশ নামক জনৈক জমিদারের অর্থানুকুল্যে। মন্দিরের দেওয়ালের ফলকে লেখা শ্রী নকুল ব্রক্ষ্মচারী শ্রী পাট।মন্দিরের গর্ভগৃহে সুসজ্জিত কারুকার্য খচিত কাষ্ঠ সিংহাসনে ওপর গৌর নিতাই এর দুটি দারু বিগ্রহ।নিম কাঠের তৈরি প্রতিমা দুটি বেশ বড়, প্রাচীনতম হলেও কোন রূপ জীর্ণতার ছাপ পড়েনি। বাংলাদেশের দারু প্রতিমাগুলির শিল্প নৈপুণ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশের প্রতিমাশিল্পীদের নিষ্ঠা ও দক্ষতার কথা।
১৯৭৮ সাল নাগাদ কালনা কলেজের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক শ্রী রবি রঞ্জন চট্টোপাধ্যায় স্থানীয় কিছু ছাত্রদের নিয়ে মন্দির পরিদর্শনে যান। তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে গর্ভমন্দিরের ভিতরে একটি পুরাতন কাঠের বাক্স।বাক্সটি থেকে দুটি প্রাচীন বাংলা পুঁথি পাওয়া যায়।একটি তালপাতার পুঁথি ও অন্যটি তুলোট কাগজে লেখা।তত্কালীন এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব পঞ্চানন সাঁপুই এর অনুমতি ক্রমে ঐ পুঁথি দুটি পাঠোদ্ধার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বর্তমানে মন্দিরের যাবতীয় দায়িত্বে আছেন মন্দিরের মহান্ত এবং মন্দির কমিটির সদস্য। প্রভুর নিত্য ভোগ হয়। মন্দিরের পেছনে রয়েছে ২০ বিঘা জমি, যা সুধীর দাশ কর্তৃক দেবোত্তর সম্পত্তি করা হয়েছিল।
সারা বছর জুড়ে ঐ আবাদি জমিতে মরসুমি ফসল চাষ করা হয়।তা থেকেই মন্দিরের় সেবার ব্যয় নির্বাহিত হয়।দোল-রাস ইত্যাদি বৈষ্ণবীয় পার্বণ গুলি মন্দিরে সাধারণ ভাবে পালিত হলেও, বাত্সরিক উত্সব হয় ফাল্গুন মাসে।আগে, উত্সবের দিন মাটি খুঁড়ে হোগলা পাতা বিছিয়ে গরম খিচুড়ি ঢেলে রাখবার ব্যবস্থা থাকলেও বর্তমানে খিচুড়ি রাখবার জন্য বেশ বড় দুটি চৌবাচ্চা দেখা যায়।উল্লেখ্য, কয়েক বছর আগে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ এই মন্দিরটির সেবাপূজাদির ভার নিতে চাইলেও, গ্রামবাসীরা তাতে নারাজ।।