পাবলো নেরুদা এর জীবনী

পাবলো নেরুদা (Pablo Neruda) চিলির একজন বিখ্যাত নোবেলজয়ী কবি এবং রাজনীতিক যিনি মূলত তাঁর প্রেমের কবিতার জন্য পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়ে আছেন। একদিকে বিষণ্ন প্রেমের কবিতা আর অন্যদিকে ফ্যাসিস্ট রাজতন্ত্রের হিংসা-নৃশংসতার বিরুদ্ধে ছুরির ফলার মতো শাণিত কবিতায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন আমর্ম কমিউনিস্ট নেরুদা।
তাঁর লেখা ‘টোয়েন্টি পোয়েমস অ্যাণ্ড এ সং অফ ডেসপায়ার’ সারা পৃথিবীর প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে বাইবেলের মতো হয়ে উঠেছে। আবার দক্ষিণ আমেরিকার আরেক বিপ্লবী চে গুয়েভারা তাঁর সৈন্যদেরকে পড়ে শোনাতেন নেরুদা র কাব্যগ্রন্থ ‘ক্যান্ত জেনারেল’। স্পেনের গৃহযুদ্ধ তাঁর লেখার জগতে এক আমূল পরিবর্তন ঘটায়। প্রেম থেকে প্রতিরোধে পাবলো নেরুদা র কবিতা ক্রমশ নতুন নতুন দিগন্ত স্পর্শ করতে থাকে।
কখনো চিলির কনসাল হিসেবে, কখনো বিশ্ব শান্তি আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে তিনি গোটা ইউরোপ ঘুরে বেরিয়েছেন, গিয়েছেন দূরপ্রাচ্যের ভারত, চিন, জাপানেও। চিলির কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের জন্যও একসময় তিনি মনোনীত হয়েছিলেন, আবার ফ্রান্সে কিছুকাল চিলির রাষ্ট্রদূত হিসেবেও কাজ করেছেন।
১৯৭১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন পাবলো নেরুদা । ১৯০৪ সালের ১২ জুলাই দক্ষিণ আমেরিকার চিলি প্রদেশের পাররাল শহরে দক্ষিণ সান্তিয়াগো থেকে ২৫০ কিমি. দূরে পাবলো নেরুদার জন্ম হয়। পাবলো নেরুদা তাঁর ছদ্মনাম, প্রকৃত নাম রিকার্ডো এলীসার নেফতালি রিয়েস বাসোয়ালতো(Ricardo Eliécer Neftalí Reyes Basoalto)।
১৯২০ সালের অক্টোবর মাসে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি পাবলো নেরুদা ছদ্মনামটি গ্রহণ করেন। ‘পাবলো’ কথার অর্থ পরিব্রাজক আর ‘নেরুদা’ শব্দটি আসলে এক চেকোস্লোভাকিয়ান কবি ইয়ান নেরুদার থেকে নেওয়া। আবার অনেকে মনে করেন, মোরাভিয়ার বেহালা-বাদক উইলমা নেরুদার থেকেই তিনি অনুপ্রাণিত হয়ে এই ছদ্মনাম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম জোসে দেল কারমেন রেইয়েস মোরালেস (José del Carmen Reyes Morales) ছিলেন একজন রেল শ্রমিক এবং তাঁর মা রোসা নেফ্তালি বাসোআলতো (Rosa Neftalí Basoalto) ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষিকা।
নেরুদার জন্মের দুই মাস পরেই তাঁর মা মারা যান। তাঁর বাবা সন্তানসহ চলে আসেন তেমুকো শহরে এবং সেখানে দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। ত্রিনিদাদ কান্দিয়া মার্ভেলদে নাম্নী জনৈক মহিলাকে তাঁর বাবা স্ত্রী’র মর্যাদা দেন। ত্রিনিদাদের পুত্র রোডল্ফো (Rodolfo)-র সঙ্গে একত্রে বড়ো হন নেরুদা। ১৯১০ সালে তেমুকো শহরের তেমুকো বয়েজ স্কুলে পাবলো নেরুদার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। ১৯২০ সাল পর্যন্ত তিনি এই বিদ্যালয়েই প্রাচীন গ্রিক ও লাতিন সাহিত্য চর্চা করেন। এই সময় তেমুকো গার্লস হাই স্কুলের অধ্যক্ষা গ্যাব্রিয়েলা মিস্ট্রাল তাঁকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেন।
পরবর্তীকালে ১৯২১ সালে নেরুদা ফরাসি সাহিত্য অধ্যয়নের জন্য সান্তিয়াগো টিচার্স ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। মাত্র ১০ বছর বয়সেই তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। কিন্তু তাঁর বাবা কখনোই তাঁর সাহিত্যচর্চার অনুরাগী ছিলেন না, তিনি এই চারুকলার চর্চাকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। তাই বাবাড় নজর এড়াতে পরবর্তীকালে তিনি জন্মগত নাম পরিবর্তন করে এই ছদ্মনাম গ্রহণ করেন। ১৯১৭ সালে তেমুকো শহরের ‘লা মানিয়ানা’ সংবাদপত্রে আসল নামেই তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।
ঠিক এর পরের বছর ১৯১৮ সালে সান্তিয়াগো শহরের ‘কোররে-বুহেলা’ পত্রিকায় তাঁর আরেকটি কবিতা প্রকাশিত হয় স্বনামে। এরপর থেকেই সান্তিয়াগো আর তেমুকো শহরের নানা পত্রপত্রিকায় ছদ্মনামে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন নিয়মিত। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, কবিতাচর্চা তাঁর কর্মজীবনেরই এক উজ্জ্বল অধ্যায়। কবিতাচর্চা দিয়ে কর্মজীবনের অধ্যায় শুরু হলেও পেশাগতভাবে নেরুদার কর্মজীবন আবর্তিত হয়েছিল একজন দক্ষ ‘ডেমোক্র্যাট’ হিসেবে।
১৯২৭ সালে রেঙ্গুনে চিলির বাণিজ্যদূত হিসেবে পাবলো নেরুদার পেশাগত কর্মজীবনের সূচনা ঘটে। বস্তুত বদলির এই পেশায় তিনি একাদিক্রমে বুয়েন্স এয়ারস, লিসবন, মাদ্রিদ, মার্সেই ভ্রমণ করতে থাকেন। ক্রমে কলম্বো, সিঙ্গাপুর, বাটাভিয়া, জাভা, বুয়েন্স এয়ারস, বার্সেলোনায় নেরুদা বাণিজ্যদূতের পদে আসীন হন। ১৯৩৩ সালে বুয়েন্স এয়ারসে থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় বিখ্যাত স্প্যানিশ বিপ্লবী কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার। কবি লোরকার সঙ্গেই মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৩৪ সালে তিনি স্বকণ্ঠে নিজের কবিতা পাঠ করেন।
১৯৩৬ সালে এস্পানিওল গৃহযুদ্ধ শুরু হলে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর ভাড়াটে দস্যুদের হাতে নিহত হন ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা। তাঁর মৃত্যু নেরুদাকে ভীষণভাবে মর্মাহত করে। স্পেনের গৃহযুদ্ধে আন্দোলনকারীদের সহায়তায় তিনি সমস্ত স্পেন ঘুরে ঘুরে অর্থসংগ্রহ করেছিলেন। ১৯৪৩ সালে পেরু ভ্রমণকালে তিনি ইন্কা সভ্যতার নিদর্শন বিখ্যাত মাচু-পিচু পরিদর্শন করেন। পরে চিলিতে ফিরে মেক্সিকোর বাণিজ্যদূতের পদে আসীন হন এবং পরে চিলির সিনেটর নির্বাচিত হন নেরুদা। ১৯৪৫ সালে পাবলো নেরুদা আনুষ্ঠানিকভাবে চিলির কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন।
চিলির রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির নির্বাচিত প্রতিনিধি গ্যাব্রিয়েল গঞ্জালেস ভিডেলা’র নির্বাচনী প্রচারে তিনি প্রভূত সহায়তা করেছিলেন। কবির নির্বাচনী প্রচারের সাহায্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে গঞ্জালেস কবিরই রচনার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন এবং চিলির উচ্চ আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ দায়ের করেন। নেরুদাকে সিনেটর পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর গ্রেপ্তারের ভয়ে নেরুদা বাধ্য হন গা ঢাকা দিতে এবং ১৯৪৮ সালে চিলি ত্যাগ করে আন্দিজ পর্বতমালা পেরিয়ে অন্যত্র পাড়ি দেন তিনি।
এই নির্বাসনে থাকাকালীন তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যাণ্ড, হাঙ্গেরি ভ্রমণ করেন। পরবর্তীকালে ১৯৬৯ সালে তিনি পুনরায় চিলিতে ফিরে আসেন এবং চিলির কমিউনিস্ট পার্টি পাবলো নেরুদাকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের প্রতিনিধি করে নির্বাচনী প্রচার চালালেও শেষে নেরুদা মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন এবং তাঁর পরিবর্তে সালভাদোর আয়েন্দে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। নেরুদার কর্মজীবনের উত্থান-পতনের সঙ্গী ছিল তাঁর কবিতাচর্চা। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ক্রেপুস্কুলারিও’ (Crepusculario) প্রকাশ পায় ১৯২৩ সালে।
১৯২৪ সালে তিনি লেখেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা সংগ্রহ ‘টোয়েন্টি পোয়েমস অ্যাণ্ড এ সং অফ ডেসপেয়ার’ (Twenty Poems and a Song of Despair)। তরুণ কবির প্রেমের অসামান্য আর্তির ভাষারূপ এই কাব্যগ্রন্থ যা সারা বিশ্বে বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বাংলায় মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখেরা পাবলো নেরুদার বহু কবিতার পাশাপাশি এই বইটিও অনুবাদ করেছেন। বাণিজ্যদূত হিসেবে কাজ করার সময় বহু দেশ ভ্রমণ এবং বহুবার প্রেমে আচ্ছন্ন হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি একের পর এক লিখে ফেলেন ‘অ্যাটেম্পট অফ দ্য ইনফাইনাইট ম্যান’, ‘রিংস্’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থগুলি।
শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে থাকাকালীন ১৯৩৩ সালে তিনি লেখেন ‘রেসিডেন্স অন আর্থ’। তাঁর কবিতা ক্রমশ প্রতীকবাদ থেকে পরাবাস্তববাদের দিকে ধাবিত হয়। কবি লোরকার মৃত্যুতে ব্যথিত নেরুদা ১৯৩৭ সালে লেখেন ‘স্পেন ইন মাই হার্ট’ নামের এক অসামান্য নস্টালজিক কাব্যগ্রন্থ। নেরুদার একটি বিতর্কিত কাব্যগ্রন্থ ‘কান্তো জেনারেল’ (জেনারেল সং) প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৫০ সালে যেখানে সমালোচকেরা মনে করেন ইতালির একনায়কতান্ত্রিক নেতা স্তালিনের স্তুতি রয়েছে। এই বই লাতিন আমেরিকার স্বাধীনতার উদ্যাপনের কথা বলে।
তবে তাঁর স্মরণীয় সাহিত্যকর্মের মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় পেরু ভ্রমণকালে রচিত ‘হাইটস অফ মাচু পিচু’ কাব্যগ্রন্থের কথা। এছাড়া তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘ওড টু দ্য অনিয়ন’, ‘ওড টু দ্য ক্যাট’, ‘বুক অফ টোয়াইলাইট’, ‘১০০ লাভ সনেটস’, ‘স্টিল এনাদার ডে’, ‘দ্য সী অ্যান্ড দ্য বেলস্’ ইত্যাদি। সবশেষে বলতে হয় ‘মেমোয়ার্স’ নামে পাবলো নেরুদা একটি স্মৃতিকথাধর্মী আখ্যান রচনা করেছিলেন ১৯৭৪ সালে। এই বইতে তিনি তাঁর জীবনের নানা অধ্যায় সম্পর্কে নোট দিয়েছেন, নোবেল বক্তৃতার ভাষ্যরূপটিও এখানে রয়েছে।
সারাজীবন ধরে বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন পাবলো নেরুদা। ১৯৪১ সালে পাবলো নেরুদা মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে প্রথম সম্মানীয় ‘ডক্টরেট’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি চিলির জাতীয় সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এরপরে নির্বাসনে থাকাকালীন নেরুদা বিশ্বশান্তি মহাসভার সদস্যপদ নিয়ে ১৯৫০ সালে বিশ্বশান্তি বিষয়ে জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে আলোচনার জন্য ভারতে আসেন।
১৯৬৫ সালে ইংল্যাণ্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘ডক্টরেট’ সম্মানে ভূষিত করেন। আর সবার থেকে উজ্জ্বলতম প্রাপ্তি ঘটে নেরুদার জীবনে ১৯৭১ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভের মাধ্যমে। পাবলো নেরুদার জীবনে বিতর্ক চিরসঙ্গী। তবু তাঁর জীবনের অন্ধকার অধ্যায়ের থেকে তাঁর মেধার দীপ্তিই তাঁকে বিশ্বে স্মরণীয় করে রেখেছে। ১৯৭৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পাবলো নেরুদার মৃত্যু হয়।