পণ্ডিতা রমাবাঈ এর জীবনী

পণ্ডিতা রমাবাঈ  এর জীবনী

পণ্ডিতা রমাবাঈ ( Pandita Ramabai ) একজন ভারতীয় মারাঠি মহীয়সী নারী যিনি ভারতীয় সমাজে নারী স্বাধীনতা ও অধিকার এবং শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অধিকারের বিষয়ে একজন অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ভারতের প্রথম নারী যিনি ‘পণ্ডিতা’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন এবং সংস্কৃতে তাঁর অসামান্য বুৎপত্তির কারণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ‘সরস্বতী’ উপাধিও পেয়েছিলেন যা এক অনন্য নজির। ১৮৮৯ সালে ভারতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে তিনি আমন্ত্রিত দশজন নারীর মধ্যে অন্যতম ছিলেন।

১৮৫৮ সালের ২৩ এপ্রিল দক্ষিণ কর্ণাটকের এক চিতপাবন মারাঠি ব্রাহ্মণ পরিবারে পণ্ডিতা রমাবাঈয়ের জন্ম হয়। তাঁর প্রকৃত নাম রমা ডোংরে। তাঁর বাবা অনন্ত ডোংরে ছিলেন খ্যাতনামা সংস্কৃত পণ্ডিত। তিনিও ছিলেন মুক্ত চিন্তাসম্পন্ন একজন সমাজ সংস্কারক। তৎকালীন সমাজে নারীর শিক্ষাদান নিষিদ্ধ ছিল, তবুও অনন্ত ডোংরে তাঁর বালিকা বধূ লক্ষ্মীবাঈ অর্থাৎ রমাবাঈ-এর মাকে শিক্ষা দানের উদ্যোগ নেন এবং তৎকালীন ব্রাহ্মণ সমাজের চক্ষুশূল হন। নিজ সিদ্ধান্তে অনড় অনন্ত ডোংরে নিজের গ্রাম, বসতবাটি ছেড়ে গুলমল অরণ্যে থাকার সিদ্ধান্ত নেন।

এই দম্পতির ছয় সন্তানের মধ্যে তিনজন মারা যায়। রমাবাঈ ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। বাবা মায়ের মুক্ত চিন্তন, দর্শন ও শিক্ষার আলোয় নিজেদের আলোকিত করতে করতে রমাবাঈ তাঁর দিদি ও তাঁর ভাই শ্রীনিবাস বেড়ে উঠতে থাকেন। ১৮৭৬ এর মহা দুর্ভিক্ষের সময় মাত্র দশ বছর বয়সে মা বাবা ও দিদি কৃষ্ণাবাঈকে হারান রমাবাঈ। অনাথ রমাবাঈ এবং তাঁর ভাই সংস্কৃত শিক্ষার জন্য সমগ্র ভারত ভ্রমণ করেন।

সংস্কৃতে তাঁর অসামান্য দক্ষতা ও সুবক্তা হিসেবে তাঁর নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয় সংস্কৃতে বক্তব্য রাখার জন্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বক্তব্য শুনে ও তাঁর অদ্ভুত মেধার পরিচয় পেয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিল উপস্থিত শ্রোতারা। ১৮৭৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে তাঁকে সম্বর্ধনা দিয়ে ‘পণ্ডিতা’ উপাধি প্রদান করা হল। তিনি ‘রমাবাঈ’ থেকে হয়ে উঠলেন ‘পণ্ডিতা রমাবাঈ’।

শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সংস্কৃত গ্রন্থের ব্যাখ্যাকারী হিসেবে দেশব্যাপী খ্যাতির জন্য তাঁকে দেওয়া হয় ‘সরস্বতী ‘ উপাধি। পণ্ডিতা রমাবাঈ হলেন ‘পণ্ডিতা রমাবাঈ সরস্বতী’। সেই সময়কালে একজন ভারতীয় নারীর, তাও এত অল্প বয়সে এমন প্রাপ্তি অভাবনীয়! সেইসময় আরও একটি ঘটনা ঘটল যা একজন ভারতীয় নারীর সম্মান বহুগুণ বাড়িয়ে দিল। রমাবাঈয়ের জ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে খ্যাতনামা একেশ্বরবাদী সংস্কারক কেশবচন্দ্র সেন তাঁকে বেদের অনুলিপি প্রদান করেন পড়বার জন্য এবং তিনি তা সানন্দে গ্রহনও করেন। 

হান্টার কমিশনের চেয়ারম্যান ডঃ ডাবল্যু ডাবল্যু হান্টার দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া সংবাদপত্রে পণ্ডিতা রমাবাঈয়ের একজন উচ্চ বর্ণের হিন্দু নারী হওয়া সত্ত্বেও নারী শিক্ষার জন্য আন্দোলনের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এত শিক্ষা,সম্মান, জ্ঞান চর্চার মধ্যেও জীবন সহজ ছিল না পণ্ডিতা রমাবাঈয়ের। ১৮৮০ সালে ভাই শ্রীনিবাসের মৃত্যু হলে রমাবাঈ সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়েন।

এই সময় শ্রীনিবাসেরই বন্ধু কলকাতা হাইকোর্টের উকিল অন্ত্যজ বর্ণের বিপিন বিহারী মেধ্বী রমাবাঈয়ের শিক্ষা ও সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে রমাবাঈ তাতে সম্মতি দেন। ১৮৮০ সালের ১৩ নভেম্বর একটি নাগরিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাঁদের বিবাহ সুসম্পন্ন হয়। সেইসময় ভারতে জাতিভেদ প্রথা প্রবল। তার উপর এই বিবাহটি ছিল আন্তঃবর্ণ। অতএব সেই সময়ে এই বিবাহটি নিয়ে কলকাতায় যথেষ্ট আলোচনা হল যদিও আসামের শিলচরে তাঁরা তাঁদের সুখী দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করতে থাকেন।

পরবর্তীকালে তাঁদের কন্যা সন্তান হলে রমাবাঈ নাম রাখেন মনোরমা।  কিন্তু এখানেও সুখ, শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হল না। বিয়ের দুই বছরের মধ্যেই ১৮৮২ সালে স্বামী বিপিনবিহারীও অকালেই চলে গেলেন। যখন তিনি মারা যান রমাবাঈ এর বয়স মাত্র তেইশ। স্বামীকে হারিয়ে রমাবাঈ কলকাতা থেকে পুনে চলে আসেন এবং মহিলাদের শিক্ষার প্রচারের জন্য আর্য মহিলা সমাজ গঠন করেন।

এই সমাজের উদ্দেশ্য ছিল স্ত্রী শিক্ষার প্রসার এবং বালিকাদের বাল্যবিবাহের নিপীড়ন থেকে রক্ষা করা। তাছাড়া ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ১৮৮২ সালে শিক্ষা বিষয়ে যে কমিশন গঠিত হয়েছিল রমাবাঈ তার পক্ষ নিয়ে বলেছিলেন, ”এ দেশের শিক্ষিত লোকের মধ্যে শতকরা নিরানব্বই জনই নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে যথাযথ শিক্ষার বিরোধিতা করেন।

যদি সামান্যতম ত্রুটি পান তবে তাঁরা সে সরিষার দানাটিকে পাহাড়সমে পরিণত করেন এবং যেকোন মহিলার চরিত্র হননের প্রয়াস করে থাকেন।” শুধু তাই নয়, তিনি সেখানে শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, মহিলা স্কুল-ইন্সপেক্টর নিয়োগ করা এবং নারীদের চিকিৎসার জন্য মহিলা ডাক্তার প্রয়োজন, তাই মেডিকেল কলেজে মেয়েদের ভর্তি হবার সুযোগ দেওয়ার সুপারিশও পেশ করেছিলেন। এই সুপারিশ তৎকালীন সমাজে বিপুল আলোড়ন তুলেছিল।

এই সুপারিশের প্রেক্ষিতেই পরবর্তীকালে লেডি ডাফরিন নারীদের মেডিকেল কলেজে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেওয়ার দাবীতে আন্দোলন করেন। ১৮৮৩ সালে রমাবাঈ ব্রিটেনে যান চিকিৎসাবিজ্ঞানে শিক্ষা গ্রহনের জন্য। কিন্তু শ্রবণ সংক্রান্ত সমস্যার কারণে তাঁর সেই শিক্ষাগ্রহণ সম্পূর্ণ হয়নি। তিনি এরপর চেলটেনহ্যাম উইমেন্স কলেজে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, গণিত ও ইংরেজি সাহিত্য পড়ার জন্য ভর্তি হন। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন সময়ে তিনি খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেন।

১৮৮৬ সালে তিনি আত্মীয় তথা প্রথম মহিলা ভারতীয় ডাক্তার, আনন্দীবাই গোপালরাও জোশীর স্নাতকোত্তর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমেরিকা যান। সেখানে দুই বছর অবস্থানকালে তিনি আমেরিকার বহু জায়গা ভ্রমণ করেন উচ্চ বর্ণের বিধবা হিন্দু নারীদের জন্য পুনর্বাসন দেওয়ার উদ্দেশ্যে। শেষ পর্যন্ত এত পরিশ্রম করে তিনি ‘রমাবাঈ অ্যাসোসিয়েশন অব বস্টন’ প্রতিষ্ঠা করেন যার মাধ্যমে তিনি উচ্চ বর্ণের বিধবাদের দশ বছর অবধি আশ্রয় দান,

বেশ কিছু কিন্ডারগার্টেন স্কুল ও মহিলাদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং নিজের কিন্ডারগার্টেন স্কুলের জন্য পাঠ্য পুস্তক প্রকাশনা শুরু করেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকের অনুবাদ করেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় বক্তৃতাও প্রদান করেন। সেখানে তিনি তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘দ্য হাই-কাস্ট হিন্দু ওম্যান’ ইংরেজিতে প্রকাশ করেন।

রমাবাঈ এই বইটি উৎসর্গ করেছিলেন, উচ্চ-বর্ণের হিন্দু মহিলা, আরও ভালো করে বললে ব্রাহ্মণ মহিলা ডাঃ আনন্দীবাঈ যোশীর উদ্দেশ্যে। রমাবাঈ ১৮৮৮ সালের জুনে উইমেন্স ক্রিশ্চিয়ান টেম্পারেন্স ইউনিয়ন (Woman’s Christian Temperance Union)-এর লেকচারার হিসেবে পুনরায় ভারতে ফিরে আসেন। ভারতে ফিরে তিনি বোম্বাইয়ের চৌপট্টি এলাকায় মেয়ে মনোরমার সাথে ‘সারদা সদন’ প্রতিষ্ঠা করেন ও এই সংস্থার অধ্যক্ষা হিসেবে যোগ দেন।

১৮৯১ সালে অর্থ সংকোচের কারণে সারদা সদনকে পুনেতে স্থানান্তরিত করা হয় এবং এখানেই এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম বিধবা সদস্যা গদুবাঈ নাটুর সাথে রমাবাঈয়ের তত্ত্বাবধানে ডি.কে.কারভের বিবাহ সম্পন্ন হয়। এই সময়কালের মধ্যেই রমাবাঈ দক্ষিণ ভারতের গুলবার্গে ‘খ্রিস্টান হাই স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৬ সালের ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের সময়, রমাবাঈ গরুর গাড়িতে মহারাষ্ট্র এবং গুজরাটের বিভিন্ন গ্রাম ভ্রমণ করতেন এবং হাজার হাজার পরিত্যক্ত, অনাথ ক্ষুধার্ত শিশু এবং সর্বস্বহারা মহিলাদের উদ্ধার করে গুজরাটের কেডাগাঁওয়ে প্রতিষ্ঠিত খৃষ্টান সংস্থা ‘মুক্তি সদন’-এ আশ্রয় দান করেন।

এই মুক্তি সদনের সাথে তিনি সারদা সদনকেও অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি তাঁর মাতৃভাষা ও ইংরেজি সহ সব মিলিয়ে মোট সাতটি ভাষায় দক্ষ ছিলেন। তিনি হিব্রু ও গ্রিক ভাষাও পড়তে পারতেন। তিনি মূল হিব্রু এবং গ্রিক থেকে তাঁর মাতৃভাষা মারাঠিতে বাইবেলের অনুবাদও করেন। ১৯২০ মনোরমা ‘মুক্তি মিশনের’ প্রধান হন রমাবাঈ। নিজের দায়িত্ব গুছিয়ে দেন সুযোগ্যা কন্যার হাতে।

কিন্তু এক বছরের মধ্যেই মনোরমার মৃত্যু হয়। এত মৃত্যুতেও অনড় রমাবাঈকে, এই একটি মৃত্যু ভেঙে ফেলার জন্য যথেষ্ট ছিল। এই অসহনীয় দুঃখের সঙ্গে যোগ হয় মারণরোগ যক্ষ্মা। তাতেই আক্রান্ত হয়ে নয় মাস লড়াই করে অবশেষে মাত্র তেষট্টি বছর বয়সে ১৯২২ সালের ৫ এপ্রিল পণ্ডিতা রমাবাঈয়ের মৃত্যু হয়।  

[ আরও পড়ুন নস্ট্রাদামুস ]