প্যারালিম্পিক এর ইতিহাস

প্রত্যেক চার বছর অন্তর অলিম্পিক-জ্বরে আক্রান্ত হয় সমগ্র পৃথিবী। হাজার হোক পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে বড়ো এবং ঐতিহ্যবাহী আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা একমাত্র এই অলিম্পিক। শীতকালীন এবং গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক এই দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করে প্রতি চার বছর অন্তর অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে একথা আমাদের জানা। তবে এই অলিম্পিক ছাড়াও আরও এক ধরনের অলিম্পিক যে হয় সে খবর কিন্তু আমরা অনেকেই রাখি না। এই অলিম্পিকের নাম – প্যারালিম্পিক (Paralympic)।
শুধুমাত্র বিশেষভাবে সক্ষম, সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বিকলাঙ্গ অ্যাথলিটদের কথা মাথায় রেখে অলিম্পিকের পরে পরেই অনুষ্ঠিত হয় এই প্যারালিম্পিক প্রতিযোগিতা। সংবাদে আমরা অনেকেই শুনে থাকি অক্ষম পা নিয়েই সাঁতার কেটে সোনা জিতেছেন, বা দৃষ্টিশক্তি খারাপ থাকা সত্ত্বেও শ্যুটিং প্রতিযোগিতায় রৌপ্য পদক পেয়েছেন কোনো অ্যাথলিট, এই সমস্তই প্যারালিম্পিকের অংশ।
বিকলাঙ্গ বা বিশেষভাবে সক্ষম প্রতিযোগীদের বিশেষ শ্রেণিতে বিভাজিত করে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে সাহায্য করা হয়ে থাকে। একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তখন সবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধে আহত বা বিকলাঙ্গ হয়ে যাওয়া এবং বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বর্ষীয়ান মানুষরা সব একজোট হয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে একটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পরিকল্পনা করে, সেটাই প্যারালিম্পিকের প্রথম যাত্রাসূচনা।
সময়টা তখন ১৯৪৮ সাল। লণ্ডন অলিম্পিক চলছে তখন। ২৯ জুলাই লণ্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ড. লুডউইগ গুটম্যান প্রথম হুইলচেয়ার অ্যাথলিটদের নিয়ে একটি প্রতিযোগিতা চালু করেন। এই প্রতিযোগিতার নাম ছিল স্টোক ম্যাণ্ডেভিল গেমস। এই খেলায় ষোলোজন আহত চাকুরিরত কর্মচারী এবং মহিলা তীরন্দাজিতে অংশ নিয়েছিলেন। প্রথমে এটি প্যারালিম্পিক বলে পরিচিত হয়নি।
পরে ১৯৬০ সালে ইতালিতে আয়োজিত অলিম্পিকের সময় তেইশটি দেশ থেকে মোট ছয়শো জন অ্যাথলিট এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় যোগ দেয়, তখন থেকেই এই প্যারালিম্পিক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং তারপর প্রতি বছর এটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই প্যারালিম্পিক গেমসেও অলিম্পিকের মতো গ্রীষ্মকালীন এবং শীতকালীন বিভাজন রয়েছে।
ইতিহাসের বিচারে প্রথম শীতকালীন প্যারালিম্পিক আয়োজিত হয় ১৯৭৬ সালে সুইডেনে। অলিম্পিকের মতোই প্যারালিম্পিকের ক্ষেত্রেও আলাদা করে একটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবং একটি সমাপ্তি অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়ে থাকে। যদিও মূল অলিম্পিকের দায়ভার থাকে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির উপর, আর এই প্যারালিম্পিকের দায়িত্ব সামলায় আন্তর্জাতিক প্যারালিম্পিক কমিটি সংক্ষেপে আইপিসি।
১৯৮৮ সালে কোরিয়ার সিওলে গ্রীষ্মকালীন প্যারালিম্পিক এবং ১৯৯২ সালে ফ্রান্সের অ্যালবার্টভিলে শীতকালীন প্যারালিম্পিক অনুষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আইপিসি এবং আইওসির মধ্যেকার একটি চুক্তির কারণে যে যে দেশে অলিম্পিক হয়, সেই দেশেই কিছুদিন পরে প্যারালিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আগে পৃথক পৃথক দেশে প্যারালিম্পিক অনুষ্ঠিত হতো, সেই প্রথা বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৬০ সালের প্যারালিম্পিকে যেখানে মাত্র তেইশটি দেশের প্রতিযোগীরা যোগ দিয়েছিল, সেখানে ২০১২ সালের প্যারালিম্পিকে দেখা গেছে মোট একশোটি দেশের প্রতিযোগীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। এবারে আরো একটি ইতিহাসের গভীরে যাওয়া যাক। ১৯৪৮ সালের আগে এই খেলা অলিম্পিকের সঙ্গেই একত্রে বিশেষ শ্রেণি হিসেবে অনুষ্ঠিত হতো।
১৯০৪ সালে জার্মান-আমেরিকান জিমন্যাস্ট জর্জ আইসার কৃত্রিম পা নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। ডানহাতের অক্ষমতা নিয়েও শুধু বাঁহাতে শ্যুটিংয়ে অংশ নেন হাঙ্গেরিয়ান অ্যাথলিট ক্যারোলি ট্যাকাস, ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ দুইবারের অলিম্পিকেই তিনি যোগ দেন। আর ১৯৪৩ সালের অলিম্পিকে যোগদানকারী লিস হার্টেলের কথা তো আমরা সকলেই প্রায় জানি।
অদম্য প্রাণশক্তিতে ভরপুর লিস হার্টেল দুই পায়েই পোলিও আক্রান্ত হয়েও ঘোড়দৌড়ে পদক জিতেছিলেন। এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার নামকরণের মধ্যে একটি বিশেষ ভাষাতাত্ত্বিক কৌশল আছে যাকে ভাষাবিজ্ঞানে বলা হয় ‘পোর্টম্যান্টু’ অর্থাৎ একটি শব্দের মধ্যেই দুরকম শব্দের মিশেল। ‘প্যারাপ্লেজিয়া’ এবং ‘অলিম্পিক’ এই দুই শব্দের মিশেলে তৈরি হয়েছে ‘প্যারালিম্পিক’ শব্দটি।
আবার অনেকে মনে করেন যে গ্রিক শব্দ ‘প্যারা’ থেকে এই প্যারালিম্পিক কথাটি এসেছে যার অর্থ হল অলিম্পিকের সমান্তরালে অনুষ্ঠিত কোনো ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। প্যারালিম্পিক প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য হল ‘স্প্রিন্ট ইন মোশান’ অর্থাৎ তীব্র গতির ছুট। প্যারালিম্পিকের যে প্রতীক রয়েছে তাতে দেখা যায় লাল, নীল এবং সবুজ রঙের উপস্থিতি।
প্রতিটি রঙ আলাদা আলাদা ‘অ্যাজিটো’র আকারে একটি কেন্দ্রে আবর্তিত বৃত্তের মতো আকার গঠন করেছে। যার মানে দাঁড়ায় বিশ্বের সমস্ত প্রান্ত থেকে অ্যাথলিটরা এই খেলায় অংশ নেবে। তবে ২০০৩ সালে আইপিসি তাদের উদ্দেশ্য এবং প্রতীক দুইই পরিবর্তন করে যা আজও বহমান। প্যারালিম্পিকের লক্ষ্য হল বিকলাঙ্গ অ্যাথলিটদের ক্রীড়াদক্ষতা বৃদ্ধি এবং বিশ্বের দরবারে তাদেরকে অনুপ্রেরণামূলক দৃষ্টান্ত হিসেবে দাঁড় করানো।
এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার বিশেষ একটি সঙ্গীতও রয়েছে যাকে ‘অ্যান্থেম অফ ফিউচার’ও বলা হয়ে থাকে, থিয়েরি ডার্নিসের তৈরি এই সঙ্গীতটি ১৯৯৬ সালে প্যারালিম্পিকের সরকারি সঙ্গীতের স্বীকৃতি পেয়েছে। প্যারালিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রথমে আয়োজক দেশের পতাকা উত্তোলন এবং সেই দেশের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়। তারপরেই অলিম্পিকের মতোই অ্যাথলিটরা তাদের দেশ অনুযায়ী একে একে স্টেডিয়ামে ঢোকেন। মূল্যবান বক্তব্য রাখার পরে প্যারালিম্পিক মশালটি স্টেডিয়ামে এনে রাখা হয়।
আয়োজক দেশের একজন প্যারালিম্পিক প্রতিযোগী এই মশাল প্রজ্জলিত করে। অলিম্পিকের মতো এই প্যারালিম্পিকের সমাপ্তি অনুষ্ঠানেও প্যারালিম্পিক পতাকা নামিয়ে ফেলা হয় প্রথমে। প্যারালিম্পিক মশালটিও নিভিয়ে দেওয়া হয়। এই প্যারালিম্পিক প্রতিযোগিতার সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এখানে অ্যাথলিটদের অক্ষমতা অনুযায়ী তাদের বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয় এবং সেইমতো ক্রীড়ায় অংশগ্রহণ করেন তারা। মোটামুটিভাবে দশটি অক্ষমতার শ্রেণি ধার্য করা হয়েছে।
যেমন – পেশিশক্তির অক্ষমতা, পরোক্ষ গমনের অক্ষমতা, অঙ্গের ঘাটতি, পায়ের দৈর্ঘ্যের ভিন্নতা, বৈশিষ্ট্যপূর্ণভাবে কম উচ্চতা, হাইপারটোনিয়া, অ্যাটেক্সিয়া, অ্যাথেটোসিস, দৃষ্টিশক্তির অক্ষমতা এবং বৌদ্ধিক অক্ষমতা বা জড়বুদ্ধিতা। প্রতিটি ক্রীড়ার ক্ষেত্রে এই দশটি শ্রেণিকেও আরো বিভিন্ন ভাগে বিন্যস্ত করা হয়ে থাকে। কোনো একটি বিশেষ ক্রীড়ায় কোনো অ্যাথলিট যোগ দিতে পারবে কিনা তার জন্য তার সক্ষমতার নির্ণায়ক হিসেবে কিছু মাত্রায় পরীক্ষা করা হয়। সেই মতো অ্যাথলিটকে নির্দেশ দেওয়া হয় কোন ক্রীড়ায় অংশ নেওয়ার জন্য সে উপযোগী।
ইতিহাসের তথ্য অনুসারে ১৯৮০ সালের আগে পর্যন্ত শুধুমাত্র মেডিক্যাল ক্লাসিফিকেশনের মাধ্যমেই অ্যাথলিট নির্বাচিত হতো। আর ১৯৮০ সালের পর থেকে ফাংশনাল ক্লাসিফিকেশনের মাধ্যমে অ্যাথলিটদের সক্ষমতা পরীক্ষা করে হয়ে থাকে। সবমিলিয়ে অলিম্পিকের মতো সমস্ত আয়োজন হলেও অর্থসাহায্য বা প্রচার ইত্যাদি ক্ষেত্রে কমিটির দৈন্য বেশ কিছু ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গেলেও একথা বলা যায় অলিম্পিকের মতো জনপ্রিয়তার স্তরে প্যারালিম্পিক মানুষের মনে এখনো জায়গা করে নিতে পারেনি সেভাবে। বিকলাঙ্গ বা বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিরা যেন স্বভাবতই সাধারণের থেকে খানিক দূরের। সে দূরত্ব ঘোচেনি আজও।