পরশুরাম জয়ন্তী

বিষ্ণুর দশাবতারের তালিকায় ষষ্ঠ নামটি Parshuram পরশুরামের। এমনই একটি চরিত্র, যিনি রামায়ণ এবং মহাভারত— দুই মহাকাব্যেই উপস্থিত। তার বাইরে বিবিধ পুরাণেও Parshuram পরশুরামকে খুঁজে পাওয়া যায়। কিংবদন্তি ও পুরাণ মতে, Parshuram পরশুরামের জন্ম চান্দ্র বৈশাখ মাসের শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে। সেই কারণে বেশ কিছু বিষ্ণু মন্দিরে ওই দিন ‘পরশুরাম জয়ন্তী’ পালিত হয়।
বিষ্ণুর অবতার পরশুরামের আবির্ভাবের মুহূর্তটি গুরুত্বপূর্ণ। বৈশাখের শুক্ল তৃতীয়া তিথিতে মা রেণুকার কোলে জন্ম হয় পরশুরামের। সেই কারণে অক্ষয় তৃতীয়ায় পরশুরাম জয়ন্তী পালন করা হয়। পরশুরামের পিতা জমদগ্নি ও মাতা রেণুকা। জমদগ্নি ব্রাহ্মণ হলেও রেণুকা ছিলেন ক্ষত্রিয়কন্যা। সে কারণে পরশুরাম জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ হলেও প্রবল ক্ষাত্রতেজসম্পন্ন ছিলেন।
তাঁর সঙ্গে সুরভি নামের এক গাভীর অধিকার নিয়ে কার্তবীর্যার্জুন নামে এক মহাপরাক্রমশালী ক্ষত্রিয় রাজার তীব্র দ্বন্দ্ব হয়। যুদ্ধে পরশুরাম কার্তবীর্যার্জুনকে পরাজিত করেন এবং তাঁকে হত্যা করেন। কিন্তু রাজন্য হত্যার পাপ তাঁর উপরে এসে পড়ে। পিতা জমদগ্নির নির্দেশে তিনি পাপস্খালনের জন্য তীর্থভ্রমণে বের হন।
ও দিকে কার্তবীর্যার্জুনের হত্যার প্রতিশোধ নিতে ক্ষত্রিয় রাজারা একত্র হন এবং পরশুরামের অনুপস্থিতিতে জমদগ্নিকে হত্যা করেন। ক্রুদ্ধ পরশুরাম ২১ বার পৃথিবীকে একা হাতে ক্ষত্রিয়শূন্য করেন। পরে তাঁর মনে পরিতাপ আসে এবং তিনি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। ‘দেবী ভাগবত’, ‘বিষ্ণুপুরাণ’ ও ‘বায়ুপুরাণে’ পরশুরামের জন্ম সংক্রান্ত বিভিন্ন কিংবদন্তি পাওয়া যায়।
মহাভারতে তাঁকে উগ্রতেজা মহাক্রোধী ব্রাহ্মণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কোনও কোনও আখ্যানে তাঁকে পিতার আদেশে মাতৃহত্যা করতেও দেখা যায়। যদিও জমদগ্নি রেণুকাকে পুনর্জীবিত করেন, তবু সেই মাতৃহত্যার পাপে তাঁর ‘পরশু’ বা কুঠার রক্তরঞ্জিতই থেকে যায়। বহু তীর্থে স্নান করে সেই কুঠার ধুয়ে ধুয়েও তা থেকে মাতৃরক্ত মুছে ফেলা যায়নি।
অবশেষে কর্ণাটকে তুঙ্গ নদীর জলে স্নান সমাপন করে সেই কুঠার কলুষমুক্ত হয়। মহাভারতে পরশুরাম ভীষ্ম ও কর্ণের অস্ত্রগুরু। সে ভাবে ভেবে দেখলে পরশুরাম এক ব্যতিক্রমী এবং বিতর্কিত পুরাণপুরুষ। তিনি ব্রাহ্মণ হয়েও উগ্রতেজা, একগুঁয়ে এবং প্রতিশোধস্পৃহ। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর ঔদার্যের কাহিনিও খুঁজে পাওয়া যায় রামায়ণে, মহাভারতে এবং অন্যান্য পুরাণে।
প্রসঙ্গত, হিন্দু পৌরাণিক বিশ্বাস সংসারে যে আট জন পুরুষ অমরত্ব লাভ করেছেন, পরশুরাম তাঁদের অন্যতম। বিষ্ণুর অবতারদের মধ্যে তিনিই একমাত্র অমর। এখনও বিশ্বাস করা হয়, ব্রহ্মক্ষত্রিয় পরশুরাম কল্কি অবতারকে অস্ত্রশিক্ষা দেবেন বলেই জীবিত রয়েছেন। ‘অক্ষয়’ শব্দের সমার্থক শব্দ ‘অমর’। পরশুরামের জন্মতিথি কি সেই ইঙ্গিতই বহন করছিল? পুরণকাররা অবশ্য এ ব্যাপারে নীরব।
নীরব আর এক অমর ব্যক্তি মহাভারত রচয়িতা স্বয়ং ব্যাসদেবও। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, হনুমান ও অশ্বত্থামার মতোই সশরীরে বিশ্বে আবির্ভাব হয় পরশুরামের। তিনি ন্যায়ের দেবতা। ত্রেতাযুগে শ্রীরাম যখন শিবের ধনুক ভেঙে দেন, তখন মহেন্দ্র পর্বতে তপস্যা করছিলেন। তিনি ধনুক ভাঙার খবর পেয়ে রামের উপর রেগে যান। তবে পরে রামের বিষয়ে সব কথা জানার পর তিনি প্রসন্ন হন।
তিনি রামের সঙ্গে সন্ধি করেন। এরপর যখন দ্বাপরযুগে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হয়, তখন তাঁকে সুদর্শন চক্র ফিরিয়ে দেন পরশুরাম। ভার্গব নামেও পরিচিত পরশুরাম। তিনি পশু-পাখির ভাষা বুঝতে পারতেন। সব ধরনের ফুল-ফলের সঙ্গেও তিনি পরিচিত ছিলেন। তবে তিনি অল্পেই ক্রুদ্ধ হয়ে যেতেন। পুরাণ অনুযায়ী, তিনি একবার শিবের সঙ্গে দেখা করতে কৈলাসে যান। কিন্তু তাঁর পথ আটকান গণেশ। এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে গণেশের একটি পা ভেঙে দেন পরশুরাম।