পটুয়াখালী | বাংলাদেশর বরিশাল বিভাগ জেলা পটুয়াখালী

পটুয়াখালী |  বাংলাদেশর বরিশাল বিভাগ জেলা পটুয়াখালী

সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের জেলা খ্যাত পটুয়াখালী বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল ও বাংলাদেশের একটি উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালী Patuakhali । বেশীরভাগ জেলাই স্বাধীনতার আগে থেকে ছিল, কিছু জেলা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গঠিত, আবার কিছু জেলা একটি মূল জেলাকে দুভাগে ভাগ করে তৈরি হয়েছে মূলত প্রশাসনিক সুবিধের কারণে। প্রতিটি জেলাই একে অন্যের থেকে যেমন ভূমিরূপে আলাদা, তেমনি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও স্বতন্ত্র। প্রতিটি জেলার এই নিজস্বতাই আজ বাংলাদেশ কে সমৃদ্ধ করেছে।

সেরকমই একটি জেলা হল পটুয়াখালী (Patuakhali)। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল বিভাগের একটি প্রশাসনিক জেলা হল পটুয়াখালী । অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই জেলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এখানকার কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত। সমুদ্র সৈকতের অপরূপ সৌন্দর্যের কারণে পটুয়াখালী “সাগরকন্যা” নামেও পরিচিত।

কেবল সৌন্দর্য নয়,পটুয়াখালী বিখ্যাত তার মোষের দুধের দই এবং দেশের একমাত্র জলের মিউজিয়ামের কারণেও। বাংলাদেশের অন্যতম জেলা পটুয়াখালীর উত্তরে বরিশাল জেলা, দক্ষিণে বরগুনা জেলা ও বঙ্গোপসাগর, পূর্বে ভোলা জেলা ও তেঁতুলিয়া নদী এবং পশ্চিমে বরগুনা জেলা ঘিরে রয়েছে সমগ্র জেলাটিকে। এই জেলার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে লাউকাঠি, লোহালিয়া, আন্ধারমানিক, পায়রাগঞ্জ, তেঁতুলিয়া, পাঙ্গাশিয়া, আগুনমুখা ইত্যাদি নদী। এই জেলায় উল্লেখযোগ্যভাবে বনাঞ্চলের অভাব দেখা যায়।

যেটুকু বনভূমি আছে তাতে কেওড়া, গেওয়া, কাকড়া, বাবুল, গোলপাতা ইত্যাদি গাছের প্রাধান্য দেখা যায়।   আয়তনের বিচারে পটুয়াখালী সমগ্র বাংলাদেশের ৩,২২১.৩১ বর্গ কিলোমিটার স্থানজুড়ে অবস্থান করছে। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জনসংখ্যার বিচারে পটুয়াখালী সমগ্র বাংলাদেশে একচল্লিশতম জনবহুল জেলা। এখানকার জনসংখ্যা প্রায় ১৫,৩৫,৮৫৪ জন। 

এই জেলার নাম পটুয়াখালী জেলার হল কীভাবে সে সম্পর্কে নানা মতভেদ রয়েছে। পটুয়াখালী শহরের উত্তর দিক দিয়ে প্রবাহিত ‘ভরনী খাল’ নামক নদী পথের মাধ্যমে ষোড়শ শতাব্দীর শুরু থেকেই পর্তুগীজ জলদস্যুরা এই এলাকা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে ব্যাপক অত্যাচার ও লুঠ চালাত। স্থানীয় অধিবাসীরা এই পর্তুগীজ হার্মাদদের ‘নটুয়া’ নামে ডাকত এবং সেই সময় থেকেই খালটি নটুয়ার খাল নামে পরিচিত হয়। মনে করা হয় এই ‘নটুয়ার খাল’-ই পরবর্তীকালে লোকমুখে পটুয়াখালী হয়ে যায়।

আবার অন্য একটি মতে স্বর্গীয় দেবেন্দ্র নাথ দত্ত রচিত একটি কবিতায় উল্লেখিত “পতুয়ার খাল” থেকে পটুয়াখালী নামকরণের উৎপত্তি হয়েছে বলে ধরা হয়।   পটুয়াখালীর ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে দেখা যায় একসময়ে সুন্দরবন পার্শ্ববর্তী সমুদ্রে গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর পলি জমে সমুদ্র ভরাট হয়ে এই জেলা সৃষ্টি হয়। সমগ্র পটুয়াখালী জেলাটিই সুন্দরবন গর্ভজাত।

১৫৯৯ সালে রাজা টোডরমল সম্রাট আকবরের কানুনগো জিম্মক খাঁকে চন্দ্রদ্ব্বীপে পাঠান এখানকার অরণ্য অঞ্চলকে চন্দ্রদ্বীপ থেকে আলাদা করে সংরক্ষিত এলাকা নামে একটি এলাকা গঠনের উদ্দেশ্যে। পরবর্তীকালে বাজুহা বা এই সংরক্ষিত এলাকা থেকেই একে ঔরঙ্গপুর পরগনা, বুজর্গ উমেদপুর, সেলিমাবাদ গড়ে ওঠে। সেই অতীত বুজর্গ উমেদপুর পরগণা বর্তমান পটুয়াখালী শহর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল এই বুজর্গ উমেদপুর পরগণাতেই অবস্থিত। বরিশালের ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ বেটির শাসন আমলেই ১৮১২ সালে পটুয়াখালীকে নিয়ে গঠন করা হয় মির্জাগঞ্জ থানা।

১৮১৭ সালে বরিশালে তৈরি হওয়া ৪টি মুন্সেফী চৌকির অন্যতম বাউফল চৌকির প্রথম মুন্সেফ ব্রজ মোহন দত্ত প্রস্তাব দেন পটুয়াখালীকে নতুন মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠার। ১৮৬৭ সালের ২৭ মার্চ কলকাতা গেজেটে পটুয়াখালী মহকুমা সৃষ্টির ঘোষণা প্রকাশিত হয় এবং ১৮৭১ সালে পটুয়াখালী মহকুমায় রূপান্তরিত হয়। ১৯৬৯ সালের ১লা জানুয়ারি পটুয়াখালী জেলা প্রতিষ্ঠা হয়।

এই জেলার প্রথম জেলা প্রশাসক ছিলেন হাবিবুল ইসলাম। এই জেলায় ৮টি উপজেলা রয়েছে যথা – পটুয়াখালী সদর, মির্জাগঞ্জ, দুমকী, বাউফল, দশমিনা, গলাচিপা, কলাপাড়া, রাঙ্গাবালি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৬ এপ্রিল পটুয়াখালী জেলা পাকিস্তানি বাহিনী দখল করে নেয়। দীর্ঘ ৮ মাস পাক-বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ থাকার পর ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর এই জেলা পাকিস্তানী বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হয়।

পটুয়াখালী জেলা মাছের কারণে বিশেষ বিখ্যাত। এই জেলার নদী মোহনাগুলি ইলিশ চাষের কারণে বিখ্যাত। এখানে রাখাইন তাঁত শিল্পে রাখাইনদের নিজস্ব কায়দার পোশাক ও জামদানী তাঁত শিল্প অন্যতম বিখ্যাত হস্তশিল্প। পটুয়াখালী জেলার দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, কুয়াকাটা বৌদ্ধ মন্দির, কুয়াকাটা রাখাইন পল্লী, মির্জাগঞ্জ উপজেলায় হজরত ইয়ার উদ্দিন খলিফার মাজার, দুমকি উপজেলায় পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সোনারচর অভয়ারণ্য, রাঙ্গাবালী ও জলের মিউজিয়াম প্রভৃতি।

  এই জেলার গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ বাড়িই দো-চালা ও চৌচালা। বাঁশ ও সুপারী কাঠ দিয়ে এসব ঘরের কাঠামো তৈরী করা হয় এবং গোলপাতা, খড় দিয়ে ছাউনি তৈরী করা হয়। এই জেলার অধিবাসীদের ওপর পীরের প্রভাব লক্ষণীয়। মহম্মদ কেরামত আলী, জনাব কে এম নুরুল হুদা, জনাব ফয়েজ আহম্মদ এই জেলার কৃতী সন্তানদের মধ্যে অন্যতম। প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যেমন-জারীগান, সারীগান, রুপবান, যাত্রাগান, ভাটিয়ালী, কবিগান, রাখালী, মুর্শীদিগানপ্রভৃতি এখানে খুবই পরিচিত। রাখাইন সম্প্রদায়ের পেগু নাচ এই জেলার অন্যতম আকর্ষণ।