পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি বাঙালি সংস্কৃতির একটি বিশেষ উৎসব

পৌষ সংক্রান্তি বা  মকর সংক্রান্তি বাঙালি সংস্কৃতির একটি বিশেষ উৎসব

প্রায় নিত্যদিনই দর্শন আর রূপ পাল্টে যাচ্ছে এই পৃথিবীর। সামাজিকতার যে বিষয়গুলো কোনও এক সময় পরিবার-পরিজনদের মধ্যে অনাবিল আনন্দের পরশ এনে দিত, সেই আনন্দঘন সময়ের ছবি ধীরে ধীরে কমে আসছে। সংক্রান্তির আগেই গ্রামে গ্রামে ঢেকিতে, গানের মধ্যে চাল গুঁড়ো করার ছবিও হয়তো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে নগরায়নের ঠেলায়। আশঙ্কা জাগে, আত্মকেন্দ্রিকতার বাড়বাড়ন্তে পৌষ সংক্রান্তিও না কোনও একদিন কাহিনি হয়ে বেঁচে থাকে লেখার পাতায় পাতায়! 

পৌষ বা মকর সংক্রান্তি বাঙালি সংস্কৃতির একটি বিশেষ উৎসব বা বিশেষ ঐতিহ্যবাহী দিন। বাংলা মাস অনুযায়ী পৌষ মাসের শেষ দিনটিতে এই উৎসব পালন করা হয়। শুধু বাংলায় বাঙালিরাই নন, আমাদের দেশের নানা প্রান্তে এই দিনটিকে নানা ভাবে বিশেষ বিশেষ উৎসবের সঙ্গে পালন করা হয়।যে কোনও উৎসবের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে মানুষের মিলনের আনন্দ বার্তা। আত্মীয়-পরিজনের আগমনে উৎসব পূর্ণতা লাভ করে। পৌষের সংক্রান্তির কথা উঠলেই ভেসে ওঠে পিঠে, পুলি, পায়েসের কথা।

মকর সংক্রান্তি বা পৌষ সংক্রান্তি চিরন্তন সনাতনী বাঙালী সংস্কৃতির একটি বিশেষ অনুষঙ্গ। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে পৌষ মাসের শেষ দিনে এই উৎসব পালন করা হয়। বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই দিনটি উদযাপন করা হয়।এর মধ্যে পিঠা তৈরী করা ও ঘুড়ি উড়ানো অন্যতম। মকরসংক্রান্তির দিন সূর্য নিজ কক্ষপথ থেকে মকর রাশিতে প্রবেশ করে। তাই দিনটিকে মকর সংক্রান্তি বলা হয়। প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুসারে ‘সংক্রান্তি’ একটি সংস্কৃত শব্দ, এর দ্বারা সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ করাকে বোঝানো হয়।

১২টি রাশি অনুযায়ী এরকম সর্বমোট ১২টি সংক্রান্তি রয়েছে।  এবছর ১৫ জানুয়ারি দেশজুড়ে পালিত হবে মকর সংক্রান্তি উৎসব। এর তাৎপর্য, সূর্যের মকর রাশিতে প্রবেশের সঙ্গে যুক্ত। সূর্য দেবতা (Sun God) ধনু রাশি ছেড়ে মকর রাশিতে প্রবেশ করলে মকর সংক্রান্তি পালন করা হয়।এই উৎসব সর্বদা ১৪ বা ১৫ জানুয়ারি পালিত হয়। এক বছরে, সূর্য ১২টি রাশির মধ্য দিয়ে যায় এবং যে রাশিতে এটি প্রবেশ করে তাকে তার সংক্রান্তি বলা হয়। এ বছর সূর্য মকর রাশিতে প্রবেশ করবে ১৪ জানুয়ারি।বাঙালি হিন্দুদের কাছে দিনটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।

পশ্চিমবঙ্গে মকর সংক্রান্তি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মূলত নতুন ফসলের উৎসব হিসেবে মকর সংক্রান্তি বা পৌষসংক্রান্তি পালিত হয়। বাংলার ঘরে ঘরে হিন্দু ধর্মানুসারীরা নতুন ধান, খেজুরের গুড় এবং পাটালি দিয়ে নানা ধরণের পিঠা তৈরী করেন।এছাড়া ভারতীয় সংস্কৃতিতে মকর সংক্রান্তি ‘উত্তরায়ণের সূচনা’ হিসেবেও পরিচিত। দিনটিকে অশুভ ও খারাপ সময়ের বিদায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার অন্তর্গত সাগরদ্বীপে কপিল মুনির আশ্রমকে কেন্দ্র করে পূণ্যস্নান ও বিরাট মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

এই মেলায় ভারতবর্ষসহ দেশ-বিদেশের প্রচুর দর্শণার্থীর সমাগম ঘটে। বাংলাদেশে মকর সংক্রান্তি কৃষিপ্রধান বাংলাদেশেও সংক্রান্তি বিশেষ গুরুত্ব সহকারে পালন করা হয়। বাংলাদেশের পুরান ঢাকায় পৌষসংক্রান্তি ‘সাকরাইন’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশেও মকর সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে পিঠা-পুলির তৈরী করা হয়।এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌষমেলার আয়োজন হয়। একই সাথে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বাউল গানের আসর বসে। ‘সাকরাইন’ উপলক্ষে পুরান ঢাকায় ঘুড়ি উৎসব পৌষ সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে পুরাণ ঢাকায় ঘুড়ি উৎসবের আয়োজন করা হয়। ঘুড়ি উৎসব বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন উৎসব।

সেই মুঘল আমল থেকে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। পুরাণ ঢাকার অধিবাসীরা বিশেষ আগ্রহ সহকারে দিনটি পালন করে। এদিন ঘুড়ি উড়ানোর জন্য তারা আগে থেকে ঘুড়ি বানিয়ে এবং সুতায় মাঞ্জা দিয়ে প্রস্তুতি নেয়। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি ভারতবর্ষের পশ্চিম ও উত্তরের রাজ্যগুলোতে প্রবল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে মকর সংক্রান্তি পালিত হয়।

প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারতেও মকর সংক্রান্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই সনাতন ধর্মে দিনটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এদিন পশ্চিম ভারতের গুজরাটে বিশাল পরিসরে পালিত হয়। মানুষ, সূর্য দেবতার কাছে নিজেদের ইচ্ছা বা অভিপ্রায়কে সুন্দর সুন্দর ঘুড়ির মাধ্যমে প্রকাশ করতে পালন করে ঘুড়ি উৎসব। যা মূলত প্রিয় দেবতার কাছে পৌঁছানোর জন্য একটি রূপক বা প্রতীক হিসেবে কাজ করে।

গ্রামগঞ্জে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ হিসেবে মোরগ লড়াই অনুষ্ঠিত হয়। মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে গুজরাটে ঘুড়ি উৎসব এই দিনটিতে জ্ঞানের দেবী সরস্বতীকে সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেও উদযাপিত হয়। গুড় দিয়ে তৈরী তিলের লাড্ডু এই উৎসবের অন্যতম প্রধান খাবার। মহারাষ্ট্রে একে বলা হয় ‘তিলগুল’। কর্ণাটকে বলা হয় ‘ইল্লু বিল্লা’। দক্ষিণ ভারতে এদিন পোঙ্গল উৎসব পালিত হয়। মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে থাইল্যান্ডে জলকেলি উৎসব দেশে দেশে মকর সংক্রান্তি ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে মকর সংক্রান্তি বিশেষ গুরুত্বের সাথে পালিত হয়।

নেপালে এই দিনটি ‘মাঘি’, থাইল্যান্ডে ‘সংক্রান’, লাওসে ‘পি মা লাও’, মায়ানমারে ‘থিং ইয়ান’ এবং কম্বোডিয়ায় ‘মহাসংক্রান’ নামে উদযাপিত হয়। দেশভেদে নামের ভিন্নতার পাশাপাশি উৎসব পালনের ধরণেও রয়েছে ভিন্নতা।

১) মকর সংক্রান্তির দিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে স্নান করে উঠোনে বা ঘরে আলপনা দিয়ে সূর্যদেবের পুজো করার নিয়ম।

২) মকর সংক্রান্তিতে গুড়, চাল, দুধ ইত্যাদি সহকারে নানা ধরনের উপাদেয় মিষ্টি, পিঠে, পুলি, পায়েস ইত্যাদি বানানো হয় এবং খাওয়া হয়।

৩) কেউ বাড়িতে আসলে তাকে মিষ্টি মুখ করানো হয়। কথিত, এই বিশেষ দিনটিতে সূর্যদেব পুত্র শনির প্রতি তাঁর ক্ষোভ ভুলে যান এবং তাঁর গৃহে সূর্যদেবের আগমন ঘটে। তাই এই দিনে সকলে মিলিত হন এবং মিষ্টিমুখ করানোর মাধ্যমে মিষ্টি সম্পর্ক বজায় রাখার অঙ্গীকার করেন।

৪) মকর সংক্রান্তির আর একটি বিশেষ আকর্ষণ ঘুড়ি উৎসব। এই দিন প্রত্যেকটি বাড়ির ছাদে ছোট-বড়রা মিলে ঘুড়ি ওড়ান। এ পাড়া, ও পাড়ার মধ্যে রীতিমতো ঘুড়ি ওড়ানোর কম্পিটিশন চলে। 

[ আরও পড়ুন রাসলীলা ]