প্রতিভা বসু এর জীবনী

প্রতিভা বসু এর জীবনী

বাংলা সাহিত্যের একজন প্রথিতযশা লেখিকা তথা সঙ্গীতশিল্পী প্রতিভা বসু (Pratibha Basu) বিখ্যাত সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী হিসেবে পরিচিত হলেও, সেই পরিচয়ের বাইরে নিজের লেখনীর মাহাত্ম্যে স্বীয় প্রতিভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাঁর  সমগ্র জীবন ছিল বৈচিত্র্যময় – একদিকে সুরেলা কন্ঠস্বর দিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ থেকে কাজী নজরুল, চিত্তরঞ্জন দাশের মত ব্যক্তিত্বদের কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন তিনি, অপরদিকে সাহিত্যের আঙিনায় তাঁর রচনাশৈলীতে মুগ্ধ হয়েছিল আপামর পাঠককুল।

তাঁর গল্প অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রে হয়েছে উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেনের মতো চিত্রতারকারা অভিনয় করেছিলেন এবং বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেই সব ছবি। সাহিত্যে তাঁর অনন্য সৃষ্টির জন্য একাদিক্রমে আনন্দ পুরস্কার, লীলা পুরস্কার ও জগত্তারিণী স্বর্ণপদকে ভূষিত হয়েছেন প্রতিভা বসু। ‘আলো আমার আলো’, ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’, ‘মনোলীনা’, ‘সমাগত বসন্ত’, ‘সেতুবন্ধ’, ‘মনের ময়ূর’ ইত্যাদি উপন্যাস, ‘মাধবীর জন্য’, ‘প্রতিভূ’, ‘স্বর্গের শেষ ধাপ’, ‘খণ্ডকাব্য’ ইত্যাদি অসামান্য সব ছোটোগল্পের পাশাপাশি তাঁর লেখা ‘মহাভারতের মহারণ্যে’ প্রবন্ধটিও বাংলা সাহিত্যে পুরাণকেন্দ্রিক আলোচনায় এক উজ্জ্বল স্থান অধিকার করে নিয়েছে। তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনের জলছবি’ থেকেই মূলত প্রতিভা বসুর জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানা যায়।

১৯১৫ সালের ১৩ মার্চ অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার হাঁসড়া গ্রামে প্রতিভা বসুর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম আশুতোষ সোম ও মায়ের নাম সরযূবালা সোম। ছোটোবেলা থেকেই যে কোন গান শুনে তার কথা ও সুর মনের মধ্যে গেঁথে নিতে পারতেন তিনি। আশুতোষ ও সরযূবালা তাঁদের মেয়েকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন আর সেই স্বাধীনতায় তাঁর প্রতিভা বিকশিত হয়েছিল অত্যন্ত সাবলীলভাবে। প্রতিভা বসুর বাল্যকালে ডাকনাম ছিল ‘রাণু সোম’। 

তৎকালীন সমাজব্যবস্থার উর্ধ্বে গিয়ে আশুতোষ তাঁর আদরের মেয়েকে পড়াশোনার পাশাপাশি সঙ্গীতশিক্ষাও দিয়েছিলেন সেকালের বিখ্যাত ওস্তাদের কাছে। চারু দত্ত, মেহেদি হাসান, প্রফেসর গুল মহম্মদ খাঁ, ভোলানাথ মহারাজের মত সঙ্গীতজ্ঞদের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিয়ে মাত্র এগারো বছর বয়সে ‘হিজ মাষ্টার্স’ থেকে প্রথম গানের রেকর্ড প্রকাশ করেন প্রতিভা। পরবর্তীকালে সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। তাঁদের দুই কন্যা মীনাক্ষী এবং দময়ন্তী এবং এক পুত্র শুদ্ধশীল বসু।

তাঁর দৌহিত্রী কঙ্কাবতী দত্তও বাংলা সাহিত্যে একজন সুপরিচিত লেখিকা। তাঁর সঙ্গীতের সূত্র ধরেই তিনি সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলামের মতো ব্যক্তিত্বদের। নজরুলগীতি এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত খোদ কাজী নজরুল এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছে শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন প্রতিভা। দিলীপ রায় তাঁকে তালিম দিয়েছিলেন অতুলপ্রসাদী গান এবং দ্বিজেন্দ্রগীতির। কাজী  নজরুলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। নজরুল কোন নতুন গান লিখলে বা সুর করলে তা তিনি প্রতিভাকে শিখিয়ে সেই গান গাইতে বলতেন।

খুব অল্পদিনের মধ্যেই প্রতিভার গানের প্রশংসা খুব অল্পদিনের মধ্যেই ঢাকা থেকে ছড়িয়ে পড়ে কলকাতায়। চিত্তরঞ্জন দাশ, সত্যেন বসুর মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন প্রতিভা তাঁর সঙ্গীত-প্রতিভার কারণে। প্রাক্‌-স্বাধীনতা যুগের অগ্নিগর্ভ সময়ে জন্ম এবং বেড়ে ওঠার কারণে খুব কাছ থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছিলেন তিনি। তৎকালীন বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী লীলা নাগের অনুপ্রেরণায় প্রতিভাও স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত হন খুব অল্প বয়সেই। তিনি লীলাদির অনুরোধে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের অন্যতম নায়ক অনন্ত সিংহের ফাঁসি রদ করার জন্য গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করেন।

প্রতিভার সমগ্র জীবনে তাঁর লীলাদির আদর্শ ও ব্যক্তিত্ব তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে সর্বক্ষেত্রে। বিবাহের পরে সংসার ও সন্তানাদি সামলে সঙ্গীতচর্চায় ছেদ পড়ে প্রতিভার। তাঁর সঙ্গীতচর্চা সংসারের অনটনে হারিয়ে গেলেও সাহিত্যের মাধ্যমে তাঁর চারুকলাবৃত্তির একটি অন্য ধারা বিকশিত হতে শুরু করে। ছোটবেলার গল্প লেখার অভ্যাস ও তাঁর সাহিত্যিক স্বামীর অণুপ্রেরণা আবার নতুন করে তাঁর সৃজনশীল সত্তাকে জাগিয়ে তোলে। পঁয়তাল্লিশটি উপন্যাস ছাড়াও অসংখ্য ছোটোগল্প, ভ্রমণ কাহিনী, স্মৃতিকথা, গদ্যগ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করে তিনি বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। 

তিনি নিজের বৈচিত্র্যময় জীবনের কথা লিপিবদ্ধ করে গেছেন তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনের জলছবি’ নামক গ্রন্থে। তাঁর সাহিত্যে নারীর জীবনযন্ত্রণার কথা বার বার ফিরে এসেছে। দেশভাগের পটভূমিতে হিন্দু মুসলমানের সম্পর্ক, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্বাধীনতা-পরবর্তী জীবনের কথা, নারী-পুরুষের সম্পর্ক এই সমস্ত বিষয় তাঁর লেখায় স্হান পেয়েছে। তাঁর লেখার নারী চরিত্রগুলির মধ্যে তিনি কখনও তাঁর ‘লীলা’দির মতো নারীর সাহসিকতার গল্প বলেছেন আবার কখনও শোষিত-লাঞ্ছিত, অপমানিত নারীর কথাও তুলে ধরেছেন।

তাঁর গল্পের নারীরা অবলা বা দুর্বল নয়, বরং তাঁদের লড়াকু সত্ত্বাই তিনি তাঁর গল্পে তুলে ধরেছেন। তাঁর উপন্যাসগুলিতে নারীর পাশাপাশি পুরুষদেরও কথাও উঠে এসেছে সমানভাবে। তাঁর গল্পের পুরুষ চরিত্রগুলি কোথাও কোমল, সেবাপরায়ণ আবার কখনও তাঁরা লম্পট, দুশ্চরিত্র কিংবা আরো নানাবিধ বৈচিত্র্যে ভরা। এভাবেই নারী-পুরুষের সমান অধিকারবোধের মর্যাদা দিয়েছেন প্রতিভা বসু তাঁর গল্পের মধ্যে। তাঁর সৃজনশীলতা ছিল উদার, প্রগতিশীল ও রবীন্দ্রভাবনা দ্বারা প্রভাবিত।  প্রতিভার প্রথম উপন্যাস ‘মনোলীনা’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৪ সালে। 

প্রতিভার উপন্যাসগুলির বিষয়বস্তু সময়ের থেকে অনেকটাই এগিয়ে থাকার কারণে প্রায় সবকটি উপন্যাসই অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বাণিজ্যসফল। তাঁর উপন্যাসগুলির মধ্যে ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয় ‘সেতুবন্ধ’ ও ‘সুমিত্রার অপমৃত্যু’, ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয় ‘মনের ময়ূর’, ১৯৫৪ সালে প্রকাশ পায় ‘বিবাহিতা স্ত্রী’। এছাড়াও ১৯৫৮ সালে ‘মেঘের পরে মেঘ’ ও ‘মধ্যরাতের তারা’, ‘সমুদ্রহৃদয়’ (১৯৫৯), ‘বনে যদি ফুটল কুসুম’ (১৯৬১), ‘ঘুমের পাখিরা’ (১৯৬৫), ‘সমুদ্র পেরিয়ে’ (১৯৭৫), ‘ঈশ্বরের প্রবেশ’ (১৯৭৫), ‘পদ্মাসনা ভারতী ও ‘প্রথম বসন্ত’ (১৯৭৯), ‘রাঙা ভাঙা চাঁদ’ (১৯৯৪), ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ১৯৯৭ সালে একসঙ্গে তাঁর চারটি উপন্যাস ‘মালতির উপাখ্যান’, ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’, ‘সকালের সুর সায়াহ্নে’, ‘দ্বিতীয় নক্ষত্র’ প্রকাশিত হয়।

তাঁর উল্লেখযোগ্য ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে ‘মাধবীর জন্য’, ‘বিচিত্র হৃদয়’, ‘প্রতিভূ’, ‘ঘাসমাটি’, ‘ভালবাসার জন্ম’, ‘সকালবেলা’, ‘প্রথম সিঁড়ি’, ‘ঈশ্বর ও নারী’ ইত্যাদি। দেশভাগের যন্ত্রণা, স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তৎকালীন সমাজের ছবি ধরা পড়ে প্রতিভা বসুর লেখায়। তাঁর গল্পের মধ্যবিত্ত-শিক্ষিত চরিত্রগুলি তাঁর সৃজনশীলতায় একেবারে বাস্তব হয়ে উঠেছে। পারিপার্শ্বিক ঘটনা ও রোজকার জীবনযাত্রা থেকে নেওয়া টুকরো টুকরো ঘটনাগুলিকে একটি গল্পের আকার দিয়েছেন তিনি অত্যন্ত নিপুণভাবে।

দেশভাগের প‌রিপ্রেক্ষিতে তাঁর লেখা ‘সমুদ্র হৃদয়’ উপন্যাসের পটভূমি গড়ে উঠেছে এক হিন্দু মেয়ে ও একটি মুসলমান ছেলের প্রেমকে কেন্দ্র করে। তেমনই ‘সুমিত্রার অপমৃত্যু’ গল্পে দেখা যায় একটি মুসলমান ছেলের সঙ্গে পালিয়ে রেজিষ্ট্রি  বিয়ে করেছে গল্পের নায়িকা এবং এই ঘটনা জানতে পেরে মেয়ের বাবা পুলিশের সাহায্য নিয়ে মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এই দুটি ঘটনাই ভীষণভাবে আমাদের পরিচিত ও প্রতিনিয়ত এরকম পরিস্থিতি আমাদের নজরে আসে। তেমনই কোথাও আবার অপহরণকারী পুরুষের প্রেমে পড়তে দেখা যায় প্রতিভার গল্পের নায়িকা। তাঁর ‘গর্ভধারিনী’ গল্পটি একটি রহস্য গল্প যেখানে শুরু থেকে শেষ অবধি এক টান টান উত্তেজনা কাজ করে।

গল্পের বুননে কোথাও পাঠক গল্পের চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে ফেলে সহমর্মী হয়ে ওঠে। সাবলীল লেখনী, গল্পের প্রয়োজনে নিঃসংকোচ শব্দচয়ন এবং অনায়াস বিচরণ প্রতিভা বসুর লেখনীকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছিল। সেই কারণেই তাঁর গল্পগুলি পাঠকমহলে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়। ‘স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়’ গল্পে আমরা দেখতে পাই দুজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ভাইবোনের কথা যারা স্বাধীনতার পরবর্তীকালে এক অন্ধকার গলিতে তাঁদের জীবন নির্বাহ করতে শুরু করে। স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা তাঁর অন্য একটি গল্প ‘ফ্রেম’।

‘ঘাসমাটি’ গল্পে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা মানুষদের অস্তিত্ব রক্ষার কাহিনী ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। ‘সকালবেলা’ গল্পে আমরা একটি মেয়ের কাহিনী জানতে পারি যে মেয়েটির বাবা ও সৎমা তাঁকে যৌন পণ্য হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এই গল্পগুলির মধ্যে দিয়ে প্রতিভা বসু সমাজে ঘটে যাওয়া অন্ধকার দিকগুলিতে আলোকপাত করতে চেয়েছেন। তিনি সময়ের থেকে কতটা এগিয়ে ছিলেন তা তাঁর রচনার মাধ্যমেই জানা যায়। জীবনের শেষদিকে এসে প্রতিভা বসু লেখেন ‘মহাভারতের মহারণ্যে’ নামে এক অত্যন্ত বিখ্যাত প্রবন্ধ।

তাঁর কাছে মহাভারতের গল্প ছিল কালো মেয়েদের বিজয়ের কাহিনী। মহাভারতের যুদ্ধকে তিনি আর্য-অনার্যের দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখিয়ে পাণ্ডবদের সততা ও জয় নিয়েও প্রশ্ন করেছেন।প্রতিভা বসুর উপন্যাস ও গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেকগুলি জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্র। এগুলির মধ্যে অন্যতম উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘আলো আমার আলো’, ‘পথে হল দেরী’, ‘অতল জলের আহ্বান’-এর মতো বিখ্যাত ছবিগুলি। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘জগত্তারিণী স্বর্ণ পদক’-এ ভূষিত করে। এছাড়াও আনন্দ পুরস্কার ও লীলা পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন প্রতিভা বসু। ২০০৬ সালের ১৩ অক্টোবর ৯১ বছর বয়সে কলকাতায় প্রতিভা বসু র মৃত্যু হয়। 

আরো পড়ুন      জীবনী  মন্দির দর্শন  ইতিহাস  ধর্ম  জেলা শহর   শেয়ার বাজার  কালীপূজা  যোগ ব্যায়াম  আজকের রাশিফল  পুজা পাঠ  দুর্গাপুজো ব্রত কথা   মিউচুয়াল ফান্ড  বিনিয়োগ  জ্যোতিষশাস্ত্র  টোটকা  লক্ষ্মী পূজা  ভ্রমণ  বার্ষিক রাশিফল  মাসিক রাশিফল  সাপ্তাহিক রাশিফল  আজ বিশেষ  রান্নাঘর  প্রাপ্তবয়স্ক  বাংলা পঞ্জিকা