নীরা আর্য্য| নেতাজিকে বাঁচাতে স্বামীকে হত্যা করও গর্বিত মহিলা নীরা আর্য্য

শত সহস্র যুবক যুবতীর তাজা রক্তের বিনিময়ে এসেছিল ভারতের স্বাধীনতা। তাঁদের ক'জনেরই বা নাম জানি আমরা। অথচ, যাঁদের নাম জানিনা, তাঁদের অমর বলিদান ছাড়া ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তি ছিল অসম্ভব। এই সমস্ত অজানা অখ্যাত বিপ্লবীরা ইতিহাসের পাতায় আজও রয়ে গিয়েছেন উপেক্ষিত। তেমনই একজন বিল্পবী ছিলেন নীরা আর্য্য। যাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু লেখা হয়নি। ছবিও নেই একটি দু'টি ছাড়া। অথচ এই বীরাঙ্গনার আত্মত্যাগের কাহিনী শুনলে শিউরে উঠতে হয়।
এক নারী দেশের স্বাধীনতার জন্য কীভাবে সর্বসুখ বিসর্জন দিতে পারেন, দেশের স্বার্থে কতটা নির্মম হয়ে উঠতে পারেন, তার সবথেকে বড় উদাহরণ বুঝি ছিলেন বীরাঙ্গনা নীরা আর্য্য। নীরা আর্য্য বাগপতের নীরা বর্তমান উত্তর প্রদেশের বাগপত জেলার খেকড়ায়, ১৯০২ সালের ৫ মার্চ, জন্ম হয়েছিল নীরা আর্য্যের। বাবা ছিলেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী শেঠ ছাজ্জুমল। ভারত জুড়ে তাঁর ব্যবসা থাকলেও, মূলকেন্দ্র ছিল কলকাতা। সেখানেই মেয়ে মীরা ও ছেলে বসন্তকুমারকে নিয়ে থাকতেন শেঠ ছাজ্জুমল।
কলকাতাতেই শুরু হয়েছিল দুই ভাইবোনের পড়াশোনা। নীরার চোখের সামনেই একসময় কলকাতা হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। যার প্রভাব পড়েছিল যুবতী নীরা ও দাদা বসন্তের ওপর। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে কোনও মাথা ব্যথা ছিল না শেঠ ছাজ্জুমলের। ব্যবসা ও মেয়ে নীরাই ছিল তাঁর প্রাণ। শেঠ ছাজ্জুমল চেয়েছিলেন তাঁর পরে ব্যবসার দায়িত্ব নিক বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি জানা ডাকাবুকো মেয়ে নীরা। সম্ভবত ব্যবসায়িক স্বার্থের তাগিদেই, শেঠ ছাজ্জুমল নীরার বিয়ে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ পুলিশের গোয়েন্দা অফিসার শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাসের সঙ্গে।
যিনি মনে করতেন, দেশের যা কিছু ভাল হয়েছে বা হচ্ছে, তার কৃতিত্ব ব্রিটিশদের। নীরা মানতেন না স্বামীর কথা নীরা ছিলেন চরম জাতীয়তাবাদী। বিয়ের আগে বাবাকে লুকিয়ে দাদার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন নানা আন্দোলনে। ফলে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে আদর্শগত পার্থক্য ছিল। নীরার মনে হয়েছিল বাবার কথা শুনে বিয়েটা তিনি না করলেই পারতেন। তাহলে বাঙালি যুবক যুবতীদের মতো দেশের আহ্বানে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতেন। তবুও বাবার মুখ চেয়ে করে চলেছিলেন ব্রিটিশভক্ত স্বামীর সংসার। বেশ কিছু বছর সংসার করার পর, নীরা শুনেছিলেন তাঁর দাদা বসন্তকুমার যোগ দিয়েছেন আজাদ হিন্দ ফৌজে।
এরপর আর কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি নীরা। দুঃসহ সংসারের বেড়ি পা থেকে খুলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতার যুদ্ধে। যোগ দিয়েছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের ঝাঁসি রেজিমেন্টে। আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম মহিলা গুপ্তচর আজাদ হিন্দ ফৌজের ঝাঁসি রেজিমেন্টের নেতৃত্বে ছিলেন লক্ষ্ণী সেহগল। দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাসকারী ভারতীয় বংশদ্ভুত মহিলা সেচ্ছাসেবকদের নিয়ে ১৯৪৩ সালে গড়ে উঠেছিল এই রেজিমেন্ট। ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল সিঙ্গাপুর, রেঙ্গুন ও ব্যাঙ্ককে। রেজিমেন্টের ক্যাডেটদের শিখতে হতো সমস্ত ধরণের আগ্নেয়াস্ত্র ও বেয়নেট চালানো, মাইন পাতা, গ্রেনেড ছোঁড়া ও মার্শাল আর্ট। উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ক্যাডেটদের পাঠানো হতো বার্মার জঙ্গলে।
আজাদ হিন্দ ফৌজের ছিল শক্তিশালী গোয়েন্দা বিভাগ। সেই বিভাগে ছিলেন ঝাঁসি রেজিমেন্টের ক্যাডেটরাও। যাঁর সূচনা হয়েছিল নীরা আর্য্যকে দিয়েই। সম্ভবত তিনিই ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম মহিলা গোয়েন্দা। তিনি ছাড়া গোয়েন্দা বিভাগে ছিলেন সরস্বতী রাজামণি, মান্যবতী আর্য্য, দুর্গা মল্ল গোর্খা ও আরও অনেক বীরাঙ্গনা। সামনে বাম দিক থেকে লক্ষী সায়গল, রজনী প্রজাপতি, সরস্বতী রাজামণি ও কালো চশমা চোখে নীরা আর্য্য। পরবর্তী জীবনে নীরা আর্য্য তাঁর আত্মকথায় ( ১৯৬৯, হিন্দ পকেট বুক প্রকাশিত) লিখেছিলেন, তাঁরা চুল ছেঁটে ছেলেদের পোশাক পরে, বিভিন্ন কাজের অছিলায় ব্রিটিশ অফিসারদের বাড়ি ও সেনাশিবিরে প্রবেশ করতেন। তথ্য সংগ্রহ করার জন্য। এরপর তথ্যগুলি পাঠানো হতো নেতাজির কাছে। কখনও কখনও তাঁদেরকে দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নথি হাতবদল করা হতো।
বলে দেওয়া হত কোনও ভাবেই যেন নথিগুলি ব্রিটিশদের হাতে না যায়। ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকলে প্রথমে নথিগুলি পুড়িয়ে দিতে হবে, তারপর পিস্তল চালিয়ে করতে হবে আত্মহত্যা। কঠোরভাবে এই আদেশ মেনে চলতেন ঝাঁসি রেজিমেন্টের গোয়েন্দারা। জঙ্গল যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন এক ক্যাডেট : স্বাধীনতা আন্দোলনের এক বিস্মৃত নায়ক, ফাঁসির দড়ি যাঁর কাছে ছিল জয়ের মালা সেই দুঃসাহসী অভিযান একদিন সামান্য অসতর্ক হওয়ায় ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন দুর্গা মল্ল গোরখা। আত্মহত্যা করার সুযোগটুকুও পাননি। নেতাজির হদিশ পাওয়ার জন্য, দুর্গার ওপর অমানুষিক অত্যাচার শুরু করেছিল ব্রিটিশরা। তাদের কবল থেকে দুর্গাকে উদ্ধার করার জন্য এক দুঃসাহসী অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নীরা আর্য্য ও সরস্বতী রাজামণি। বৃহন্নলা সেজে তাঁরা ঢুকে পড়েছিলেন সেই ব্রিটিশ শিবিরে, যেখানে বন্দি করে রাখা হয়েছিল দুর্গাকে। নেচে গেয়ে ব্রিটিশ অফিসারদের বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন দুই বীরাঙ্গনা।
সুযোগ বুঝে অফিসারদের সুরার গ্লাসে মিশিয়ে দিয়েছিলেন আফিম। অফিসারেরা নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার পর, বন্দি দুর্গাকে শিকল মুক্ত করে তাঁরা নিয়ে এসেছিলেন সেনাছাউনির বাইরে। তিনজনকে দেখে ফেলেছিল এক সেনা। গুলি চালিয়ে দিয়েছিল। গুলি লেগেছিল সরস্বতী রাজামণির পায়ে। রক্তাক্ত সরস্বতীকে নিয়ে নীরা ও দুর্গা হারিয়ে গিয়েছিলেন বিপদসঙ্কুল অরণ্যের গভীরে। তাঁরা জানতেন কিছুক্ষণ পরেই অরণ্যজুড়ে শুরু হবে চিরুনি তল্লাসি। তাই ঘন অরণ্যের মধ্যে থাকা একটি উঁচু গাছে উঠে পড়েছিলেন। কয়েক ঘণ্টা পরে কানে ভেসে এসেছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জঙ্গল তোলপাড় করার আওয়াজ। কিন্তু গুলি খাওয়া এক নারী যে তাঁর দুই সঙ্গীকে নিয়ে উঁচু গাছের ঘন পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারেন, সেটা কল্পনাও করতে পারেনি ব্রিটিশরা। তাই একসময় হতাশ হয়ে ফিরে গিয়েছিল ছাউনিতে।
গাছের ওপর নীরাদের কেটেছিল তিনদিন। এই তিনদিন তাঁরা না খেয়েছিলেন। ঘুমিয়ে নিতেন পালা করে। তবে নীরা ও দুর্গার সবথেকে বেশি চিন্তা ছিল সরস্বতীকে নিয়ে। কারণ তাঁর পায়ের ক্ষত ক্রমশ বিষিয়ে যাচ্ছিল। বাধ্য হয়ে তিনদিন পর গাছ থেকে নেমে পড়েছিলেন তাঁরা। দুর্গম অরণ্যে ছিল পথ হারানোর সম্ভাবনা। কিন্তু তাঁদের তিনজনেরই নেওয়া ছিল অরণ্যযুদ্ধের প্রশিক্ষণ। তাই তাঁরা জানতেন অরণ্যে পথ হারালে কীভাবে হারানো পথ খুঁজে নিতে হয়। কয়েকদিন পর তিন বীরাঙ্গনা এসে পৌঁছেছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের গোপন ক্যাম্পে। ঝর্নার জল ও বুনো ফল ছাড়া এই ক'দিন কিছুই পেটে পড়েনি তাঁদের। ক্যাম্পে ফেরার পর শুরু হয়েছিল সরস্বতীর চিকিত্সা। সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন সরস্বতী।
এই দুঃসাহসী অভিযানের জন্য নীরা ও সরস্বতীকে পুরস্কৃত করেছিলেন নেতাজি। সরস্বতী রাজামণি হয়েছিলেন ঝাঁসি বাহিনীর 'লেফটেন্যান্ট' ও নীরা আর্য্য 'ক্যাপ্টেন'। লক্ষ্ণী সেহগলের সঙ্গে ঝাঁসি রেজিমেন্ট পরিদর্শনে নেতাজি হত্যা করেছিলেন স্বামীকে স্ত্রী ঝাঁসি রেজিমেন্টে যোগ দিয়েছেন, সেকথা জানতে পেরেছিলেন গোয়েন্দা স্বামী শ্রীকান্ত। খুশি হয়েছিলেন। কারণ তাঁর ওপর ব্রিটিশ সরকার একটি গুরু দায়িত্ব দিয়েছিল। নেতাজির ওপর গোয়েন্দাগিরি করা ও সুযোগ পেলে তাঁকে হত্যা করা। কিন্ত কার্যত তা ছিল অসম্ভব। কারণ নেতাজি তখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ঘুরে বেড়াতেন। ক্ষণে ক্ষণে স্থান বদলাতেন। শ্রীকান্ত বুঝেছিলেন স্ত্রী নীরাকে নজরবন্দি করলেই পৌঁছানো যাবে নেতাজির কাছে।
সম্ভবত এভাবেই শ্রীকান্ত জয়শঙ্কর দাস পেয়ে গিয়েছিলেন নেতাজির খোঁজ। কারণ ১৯৪৩ সালে পর পর ঘটেছিল দুটি ঘটনা। যে দুটি ঘটনার মধ্যে যোগসুত্র থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। মালয় রাজার উপহার দেওয়া বারো সিলিন্ডারের গাড়িতে করে বার্মার অরণ্যপথে সফর করছিলেন নেতাজি। চালকের আসনে ছিলেন নেতাজির বিশ্বস্ত সঙ্গী ও দেহরক্ষী নিজামুদ্দিন। যাঁকে নেতাজি 'কর্নেল' উপাধি দিয়েছিলেন। ২০১৬ সালে টেলিগ্রাফ পত্রিকাকে ঘটনাটির বিবরণ দিয়েছিলেন কর্নেল নিজামুদ্দিন। 'নেতাজিকে নিয়ে অরণ্য ঘেরা পথে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাত্ লক্ষ করলাম ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে একটি বন্দুকের নল। কেউ একজন ঝাঁপিয়ে পড়ল নেতাজির সামনে। তিনটে বুলেটের আঘাতে আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।
জ্ঞান ফেরার পর দেখি নেতাজি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। ক্যাপ্টেন লক্ষী সায়গল আমার শরীর থেকে বুলেট বের করে নিয়েছেন।' কর্নেল নিজামুদ্দিন কিছুটা ভাগ্যের জোরেই সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন নেতাজি। তবে এরপরই ঘটেছিল দ্বিতীয় ঘটনাটি। স্বামী শ্রীকান্ত জয়শঙ্কর দাসকে বেয়নেট ( মতান্তরে ছুরি) দিয়ে হত্যা করেছিলেন নীরা আর্য্য। সম্ভবত তাঁর কাছে আজাদ হিন্দ বাহিনীর গোয়েন্দা সূত্রে খবর এসেছিল, নেতাজিকে হত্যা করার চক্রান্তের দায়িত্ব তাঁর স্বামীকেই দিয়েছিল ব্রিটিশরা। দেশদ্রোহী স্বামীকে যোগ্য শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব নিজের হাতেই তুলে নিয়েছিলেন নীরা। নেতাজিকে বাঁচাতে নিজের হাতেই মুছে দিয়েছিলেন নিজের সিঁথির সিঁদুর।
স্বামীকে হত্যা করার সময় একটুও হাত কাঁপেনি তাঁর। এই ঘটনার পর নীরা আর্য্যের নাম হয়ে গিয়েছিল নীরা নাগিনী। নীরা আর্য্যকে নিয়ে মধু ধামার (ফারহানা তাজ) লেখা বই লালকেল্লায় শুরু হয়েছিল বিচার দক্ষিণ এশিয়ায় অক্ষশক্তির পরাজয়ের ফলে ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ। মিত্রশক্তির হাতে ধরা পড়েছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের হাজার হাজার সেনানী। তাঁদের একটি বড় অংশকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল ভারতে। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে লালকেল্লায় শুরু হয়েছিল সেনানীদের বিচার। তাঁদের মধ্যে ছিলেন নীরা আর্য্যও।
লাল কেল্লায় বিচার চলেছিল ১৯৪৫ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৪৬ সালের মে মাস পর্যন্ত। বেশিরভাগ সেনানী মুক্তি পেলেও মুক্তি পাননি নীরা। ব্রিটিশ বাহিনীর বিশ্বস্ত অফিসার শ্রীকান্ত জয়শঙ্কর দাসকে হত্যার অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল নীরাকে। শুরু হয়েছিল বিচার কালাপানিতে নীরা দণ্ড ঘোষণার পর নীরাকে প্রথমে পাঠানো হয়েছিল কলকাতার কারাগারে। সেখান থেকে জাহাজে করে নীরাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আন্দামানে। তাঁর জীবনের এই অধ্যায় পরবর্তীকালে লিখে গিয়েছিলেন নিজের আত্মকথায়। ১৯৬৯ সালে আত্মকথাটি প্রকাশ করেছিল হিন্দ পকেট বুকস। আন্দামানের সেলুলার জেলে নীরার অভিজ্ঞতার কথা শুনলে শিউরে উঠতে হয়।
ফুটতে থাকে শিরা ধমনীর মধ্যে দিয়ে ছুটতে থাকা রক্ত। কলকাতা থেকে আন্দামানের সেলুলার জেলে নিয়ে যাওয়ার পর, নীরা আর্য্যকে রাখা হয়েছিল ছোট্ট একটি কুঠুরিতে। পাশের কুঠরিগুলিতে ছিলেন মহিলা রাজনৈতিক বন্দিরা। তাঁরা ছিলেন মুক্ত। কিন্তু বন্য জন্তুর মতোই প্রথম দিন কুঠুরিতে বেঁধে রাখা হয়েছিল নীরাকে। গলায় বাঁধা ছিল চেন। হাতে পায়ে পরানো ছিল শেকল লাগানো বেড়ি। নীরাকে কিছু খেতে দেওয়া হয়নি প্রথম দিন। মাদুর কম্বলও দেওয়া হয়নি প্রথমে। কুঠুরির কনকনে ঠান্ডা মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন পরিশ্রান্ত নীরা। মাঝরাতে এক প্রহরী কুঠুরিতে ঢুকে গায়ের ওপর দুটো কম্বল ছুড়ে দিয়ে গিয়েছিল। আন্দামানের সেলুলার জেল উপড়ে নেওয়া হয়েছিল স্তন সকাল বেলায় জুটেছিল প্রথম খাবার। খেতে দেওয়া হয়েছিল ফুটন্ত খিচুড়ি। এরপর একজন কামারকে সঙ্গে নিয়ে কুঠরিতে ঢুকেছিলেন ব্রিটিশ জেলার।
কামার কাটতে শুরু করেছিল হাতের বেড়ি। হাতের চামড়া কেটে ঊঠে এসেছিল। নীরা বুঝতে পারছিলেন, ইচ্ছে করেই তাঁকে আঘাত করছে প্রভুভক্ত ভারতীয় কামার। তবুও যন্ত্রণা সহ্য করেছিলেন দাঁতে দাঁত চেপে। কিন্তু পায়ের বেড়ি কাটতে গিয়ে, পায়ের হাড়ে হাতুড়ি মারতে শুরু করেছিল কামার। চিত্কার করে উঠেছিলেন নীরা, 'তুমি কি অন্ধ, পায়ে হাতুড়ি মারছ কেন?' কামার অশ্লীলভাবে নীরার বুকের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, 'পায়ে কেন, দরকার হলে তোমার বুকেও হাতুড়ি মারতে পারি। তুমি কিছুই করতে পারবে না।' রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নীরা বলেছিলেন, 'আমি জানি আমি তোমাদের ক্রীতদাস। তোমরা যা খুশি করতে পারো আমাকে নিয়ে।' এরপর একদলা থুতু কামারের মুখে ছুঁড়ে দিয়ে নীরা বলেছিলেন, 'মেয়েদের সম্মান করতে শেখো।' নীরা আর্য্যকে নিয়ে তেজপাল সিং ধামা ও মধু ধামার লেখা বই ঘটনাটি উপভোগ করছিলেন জেলার। এগিয়ে এসে বলেছিলেন, 'নেতাজির কোথায় সেটা বলে দাও।
আমরা তোমায় ছেড়ে দেব।' ভাবলেশহীন মুখে নীরা বলেছিলেন,'সারা বিশ্ব জানে নেতাজি বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন।' উত্তেজিত জেলার বলেছিলেন, 'তুমি মিথ্যে কথা বলছ। সুভাষ বোস এখনও জীবিত।' মাথা উঁচু করে নীরা সগর্বে বলেছিলেন, ' হ্যাঁ নেতাজি বেঁচে আছেন, আমার বুকে।' ক্রোধে উন্মত্ত জেলার বলেছিলেন, 'সুভাষ বোস যদি তোমার বুকে থাকে, তাহলে সেখান থেকে আমরা তাকে বের করে আনব।' এরপর জেলার নীরাকে অমানুষিকভাবে মারতে শুরু করেছিলেন। ছিঁড়ে দিয়েছিলেন জামা। দুই হাতে নীরার দুই স্তন মুচড়ে ধরে কামারের দিকে ইশারা করেছিলেন। কামার তার বাক্স থেকে বের করেছিল 'ব্রেস্ট রিপার'। নারীদের ওপর অত্যাচার করার মধ্যযুগীয় যন্ত্র।
দেখতে অনেকটা সাঁড়াশির মতো। যন্ত্রটি আগুনে লাল করে সেটি দিয়ে নারীদের স্তন উপড়ে নেওয়া হতো। কামার ব্রেস্ট রিপার যন্ত্রটি নীরার ডান স্তনে বসিয়ে, দুই হাতলে প্রবল চাপ দিতে শুরু করেছিল। নীরার ঘাড় দুই হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন জেলার। নীরার আর্ত চিত্কার সেদিন বুঝি শুনতে পেয়েছিল সেলুলার জেলে বন্দি থাকা সমস্ত কয়েদি। ব্রেস্ট রিপার দিয়ে কামার উপড়ে নিয়েছিল নীরার ডান স্তন। রক্তাক্ত নীরা জ্ঞান হারাবার আগে কানের পাশে শুনতে পেয়েছিলেন জেলারের হিশিহিশে কণ্ঠ, ' আবার মুখে মুখে তর্ক করলে অন্য বেলুনটিও উপড়ে নেওয়া হবে। ধন্যবাদ দাও কুইন ভিক্টোরিয়াকে, ব্রেস্ট রিপারটা আগুনে গরম করা ছিল না।' শিল্পীর কল্পনায় সেই ভয়ানক দৃশ্য এটাই শেষ নয়, এর পরেও সেলুলার জেলে আরও অনেক পাশবিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল নীরাকে।
সারা শরীর হয়ে গিয়েছিল ক্ষতবিক্ষত। তবুও আহত নাগিনীর মনে ডানা মেলত একটাই স্বপ্ন, স্বাধীন ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে সুর্য্যোদয় দেখবেন। আত্মত্যাগের সম্মান দেয়নি দেশ নীরা আন্দামানে আসার একবছর পর, স্বাধীন হয়েছিল ভারত। মুক্তি পেয়েছিলেন নীরা। কিন্তু তাঁর আত্মত্যাগের সম্মান দেয়নি দেশ। অভিমানে সাধারণের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন অসাধারণ নীরা। বহু দশক পরে, নীরা আর্য্যকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল হায়দ্রাবাদের ফলকনুমা এলাকায়। স্বাধীন ভারতে ফুল বেচে পেট চালাতেন তিনি। থাকতেন বস্তির এক চালাঘরে। বস্তির লোকেরা তাঁকে ডাকতেন পেডাম্মা (ঠাকুমা) বলে।
পরবর্তীকালে তাঁর পরিচয় জানার পর, তাঁকে সরকারি পেনসন দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন নীরা। সকলের অলক্ষ্যে, ১৯৯৮ সালে ২৬ জুলাই, হায়দ্রাবাদের উসমানিয়া হাসপাতালে প্রয়াত হয়েছিলেন ৯৬ বছরের বীরাঙ্গনা নীরা আর্য্য। না, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য হয়নি তাঁর। জোটেনি গান স্যালুট। এক সহৃদয় সাংবাদিক তাঁর শেষকৃত্য করেছিলেন। তিনিই দিয়েছিলেন ফুলের মালা, ফেলেছিলেন দু'ফোঁটা চোখের জল। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে, যে কুঁড়েঘরে নীরা থাকতেন, সেটিও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কারণ সেটি দাঁড়িয়ে ছিল সরকারি জমির ওপর। সেদিনই নীরা বুঝতে পেরেছিলেন, যে মাটির জন্য তিনি রক্ত ঝরিয়েছিলেন, সেই মাটিও তাঁর নিজের ছিল না।