পুরীর জগন্নাথ মন্দির | Puri Jagannath Temple

পুরীর জগন্নাথ মন্দির | Puri Jagannath Temple

পুরীর Puri  জগন্নাথ মন্দির Jagannath Temple হল হিন্দুদের চারধামের একটি ধাম। অন্য তিনটি ধাম হল বদ্রীনাথ, রামেশ্বরম ও দ্বারকা। হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী শ্রীবিষ্ণু রামেশ্বরমে স্নান করে বদ্রীনাথে ধ্যান করেন, তারপর পুরীতে খাবার খেয়ে দ্বারকায় বিশ্রাম করেন। প্রতিটা হিন্দু জীবনে অন্তত একটিবার এই চারটে ধাম ভ্রমণ করতে চান। আর চারধামের মধ্যে পুরী বাঙালির সবচেয়ে কাছে হওয়ায় বিষ্ণু বা জগন্নাথের আশীর্বাদ নিতে বাঙালি বারে বারে ছুটে আসে এখানে। জগন্নাথ মন্দির। ছবি ইন্টারনেট। পুরীর সমুদ্র সৈকত থেকে মাত্র তিন কিমি দূরে অবস্থিত জগন্নাথ মন্দির। পুরী স্টেশন থেকেও মন্দিরের দুরত্ব তিন কিমির মধ্যেই।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে বিষ্ণুভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন দেব তৎকালীন পুরীতে বিষ্ণুর আরাধনার জন্য একটি মন্দির গড়ে তুলল। বিষ্ণুর রূপ নীলমাধবকে এই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য সে তার রাজ্যের চারদিকে লোক পাঠাল। তাদের মধ্যে একজন ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতি নীলমাধবকে খুঁজতে গিয়ে জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলে। সেখানে শবররাজ বিশ্ববসুর কন্যা ললিতার সাথে তাঁর দেখা হয়, প্রেম হয় এবং তারা বিয়েও করে নেয়। বিয়ের পর বিদ্যাপতি জানতে পারে তার শ্বশুরমশাই জঙ্গলের মধ্যে গোপনে নীলমাধবের পূজা করে। নীলমাধবকে দেখার জন্য শ্বশুরকে অনুরোধ করলে বিশ্ববসু তাকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়, কিন্তু সে চোখ বাঁধা অবস্থায় যাওয়ার সময় গোটা পথে সরষের দানা ছড়াতে ছড়াতে যায় যাতে পরে সে পথের সন্ধান পেতে পারে।

তারপর নীলমাধবের দর্শন পেয়ে রাজাকে খবর দিলে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন নীলমাধবকে আনতে যায়। কিন্তু সেখানে পৌঁছনোর পর নীলমাধবকে পায় না এবং দৈববাণী হয় যে সমুদ্রের জলে একটি কাঠ ভেসে আসবে যা থেকে বিগ্রহ বানাতে হবে। সেই অনুযায়ী কাঠ ভেসে এলেও সেই কাঠ এমনই পাথরের মত শক্ত যে ছেনি, হাতুড়ি সবই ভেঙে যায়। তখন স্বয়ং বিশ্বকর্মা কারিগরের বেশে রাজার কাছে আসেন। অন্যমতে বলা হয় স্বয়ং জগন্নাথ আসেন রাজার কাছে। তিনি শর্ত রাখেন ২১ দিন দরজা বন্ধ করে তিনি মূর্তি গড়বেন। কেউ যেন তাঁকে বিরক্ত না করে। তিনি নিজে দরজা না খুললে কেউ যেন তাঁর ঘরে না আসে।

রাজা মেনে নিলে তিনি দরজা বন্ধ করে কাজ শুরু করেন। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের রানী গুন্ডিচা রোজই বন্ধ দরজায় কান পেতে কাঠ কাটার ঠক্ ঠক্ শব্দ শোনেন। একদিন রানী শব্দ শুনতে না পেয়ে রাজাকে জানায়। তারা কৌতূহলবশত দরজা খুলে দেখেন কারিগর উধাও এবং তিনটি অসমাপ্ত মূর্তি পড়ে আছে। মূর্তির হাত,পা কিছুই গড়া হয়নি। তখন রাজা ও রানী দুঃখে ভেঙে পড়লে রাজাকে স্বপ্ন দিয়ে জগন্নাথ বললেন এই রূপেই তিনি পূজিত হতে চান। বিশ্বাস করা হয় সেই থেকেই জগন্নাথের মূর্তি ওভাবেই পূজিত হয়ে আসছে। রথযাত্রা এখানের প্রধান উৎসব। রথযাত্রায় জগন্নাথ বোন সুভদ্রা ও দাদা বলরামকে নিয়ে রথে চড়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের রানী গুন্ডিচার মন্দিরে আসেন।

সেখানে সাতদিন থাকার পরে আবার নিজের মন্দিরে ফিরে আসেন। এই যাওয়াটাকেই জগন্নাথের মাসির বাড়ি যাওয়া বলে। পুরীতে রথ টানতে প্রতি বছর লক্ষাধিক ভক্তের ভিড় হয়। পুরীর রথযাত্রা। ছবি ইন্টারনেট। এই মন্দিরকে শ্রী মন্দিরও বলা হয়ে থাকে। প্রাচীনকালে ইউরোপীয় নাবিকদের কাছে মন্দিরটি “সাদা প্যাগোডা” নামে পরিচিত ছিল। চৈতন্যদেব তাঁর জীবনের কুড়ি বছরেরও বেশি সময় পুরীতে কাটিয়েছেন। উড়িষ্যার তৎকালীন রাজা প্রতাপ রুদ্রদেব তাঁকে কৃষ্ণের অবতার বলে মনে করতেন। ১৫৩৩ সালে আষাঢ় মাসে তিনি সেই যে ঢুকলেন মন্দিরে, তারপর আর কেউ তাঁর দেখা পাননি। আজও তাঁর মৃত্যু রহস্যই রয়ে গেছে। জগন্নাথ মন্দির ঘুরতে গেলে আসতে হবে পুরী।

প্লেনে এলে ভুবনেশ্বর বিমানবন্দরে নামতে হবে। ভুবনেশ্বর বিমানবন্দর থেকে পুরী প্রায় ৫৫ কিমি দূরে। ট্রেনে করে আসতে চাইলে সবথেকে ভালো হয় হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে রাতের ট্রেনে পুরী স্টেশন। তারপর ট্যাক্সি বা হোটেলের গাড়ি করে হোটেলে যাওয়া যায়। স্টেশন থেকে মন্দিরের দুরত্ব ৩ কিমি। ২০২১ সালের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সরাসরি পুরী স্টেশন অবধি কয়েকটি ট্রেনের বিস্তারিত তুলে ধরা হল। ট্রেন নাম্বার ট্রেনের নাম কোথা থেকে ছাড়বে কখন ছাড়বে পুরী কখন পৌঁছবে কোন দিন চলে ০২৮৩৭ হাওড়া পুরী ফেস্টিভাল স্পেশাল হাওড়া রাত ১০টা ৩৫ মিনিট সকাল ৭টা ১০ মিনিট সবদিন ০২০৮৭ ধৌলি এসএফ স্পেশাল হাওড়া সকাল ৯টা ১৫ মিনিট সন্ধ্যে ৬টা সবদিন ০২২০১ শিয়ালদহ পুরী দুরন্ত কোভিড - ১৯ স্পেশাল শিয়ালদহ রাত ৮টা ভোর ৩টে ৫৫ মিনিট সোম, শুক্র কলকাতা, দুর্গাপুর থেকে সরাসরি বাসেও পুরী আসা যায়।

জগন্নাথ মন্দিরের কাছে থাকার জন্য বহু হোটেল, রিসোর্ট, গেস্ট হাউস, হলিডে হোম রয়েছে। হোটেলের ভাড়া প্রতিরাতে ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০০০ টাকা অবধি রয়েছে। বেশ কিছু হলিডে হোমে নিজেদের রান্না করার ব্যবস্থাও আছে। জগন্নাথ মন্দিরের থেকে মাত্র ২ কিমির মধ্যে স্বর্গদ্বারের হোটেলগুলোতে থাকলে সুবিধা। শুধুমাত্র মন্দির থেকে কাছে বলেই নয়, এখানে থাকলে কাছাকাছিই আছে বাজার, যেখান থেকে সবজি ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের মাছ, সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি এসব কিনে আনতে পারেন। তারপর নিজেরা বা রান্নার লোক দিয়ে রান্না করাতে পারেন। জগন্নাথ দেব। ছবি ইন্টারনেট। মন্দির চত্বরে জগন্নাথ মন্দির ছাড়াও রয়েছে আরও অনেকগুলো মন্দির।

সেগুলো হল বিমলা মন্দির, মহালক্ষ্মী মন্দির, বটগণেশ মন্দির, নবগ্রহ মন্দির, নরসিংহ মন্দির, গোপীনাথ মন্দির এবং ছোটবড় মন্দির মিলিয়ে আরও বেশ কয়েকটা মন্দির। বিমলা মন্দির হল চার আদি শক্তিপীঠের অন্যতম। মহালক্ষ্মী মন্দিরে অবস্থান করেন জগন্নাথের স্ত্রী। ভক্তদের বিশ্বাস অনুযায়ী, জগন্নাথেরা রথযাত্রায় তিন ভাইবোন গুণ্ডিচার বাড়ি গেলেও দেবী মহালক্ষ্মী তাঁর মন্দিরেই থাকেন। তারপর তিনি গুণ্ডিচার বাড়ি এসে জগন্নাথকে নিজের বাড়ি ফিরতে অনুরোধ করেন এবং রথের একখানি কাঠ ভেঙে নিজের মন্দিরে ফিরে আসেন। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের পরে প্রথমে বটগণেশের পূজা করা হত।

তার পাশেই আছে ‘কল্পবট’ নামক পবিত্র বটগাছ। এই গাছে সুতো বেঁধে ভক্তেরা মানত করে। ফণী ঝড়ের পাল্লায় এই গাছের অনেকটা ক্ষতি হয়েছে। মন্দিরের চারটি প্রবেশ দ্বার রয়েছে। সেগুলো হল সিংহদ্বার, অশ্বদ্বার, হাতিদ্বার এবং ব্যাঘ্রদ্বার। প্রধান দ্বার সিংহদ্বার এবং প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী দুই দেবতা জয় ও বিজয় এই দ্বার তথা মন্দিরের দ্বাররক্ষী। ফণী ঝড়ের পাল্লায় জয়ের মূর্তিটি ভেঙে গিয়েছিল। স্থানীয়দের মতে জগন্নাথ মন্দিরের রান্নাঘর বিশ্বের বৃহত্তম রান্নাঘর, যেখানে প্রতিদিন কয়েক হাজার ভক্ত ভোজন করে। তবে রান্নাঘরে সাধারণের প্রবেশের অনুমতি নেই। বাইরে থেকেই দর্শন করতে পারবেন। এছাড়াও মন্দিরের কাছেই ঘুরে দেখুন পুরীর সমুদ্র, স্বর্গদ্বার, জগন্নাথের মাসির বাড়ি, জগন্নাথের পিসির বাড়ি, লাইট হাউস, পুরীর মোহনা, গম্ভীরা, সুদর্শন পট্টনায়ক স্যান্ড আর্ট ইনস্টিটিউট, সুদর্শন ক্রাফট মিউজিয়াম। সারা বছর ধরেই এখানে ঘুরতে আসা যায়। তবে স্নানযাত্রার পরের ১৫ দিন পুরীর মন্দির সাধারণের জন্য বন্ধ থাকে। সেই সময় গেলে জগন্নাথের দর্শন পাওয়া যাবে না।

প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী সেই সময় জগন্নাথদেব পুরী থেকে ২০ কিমি দূরে ব্রহ্মগিরির অলরনাথ মন্দিরে অবস্থান করেন। রথযাত্রার সময় পুরীতে রথ টানতে লক্ষাধিক ভক্তের ভিড় হয়। সেই সময় যেতে চাইলে অনেক আগে থেকে সব বুকিং করে রাখতে হবে। মন্দিরে এসে মহাপ্রসাদ না খেলে মন্দির আসাই অসম্পূর্ণ হয় বলে মনে করে ভক্তেরা। মন্দির চত্বরের উত্তর পূর্ব কোণে আছে আনন্দবাজার। এখানে বিক্রি হয় জগন্নাথের মহাপ্রসাদ। জগন্নাথ মন্দির ঘুরতে এলে এখান থেকে ভক্তেরা মহাপ্রসাদ কেনে। ফিরে এসে এই প্রসাদ সকলে নিজের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের দেয়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এই প্রসাদ খেলে অন্তরাত্মা পবিত্র হয়, পাপনাশ হয়, রোগব্যাধি দূর হয়। মন্দির চত্বরে জুতো পরে প্রবেশ নিষেধ, ভিতরে ছবি তোলা নিষেধ। মোবাইল ও চামড়ার জিনিস নিয়ে যাওয়াও নিষেধ।

দিনের কোন সময় মন্দির খোলা থাকে তা হোটেল থেকে বা স্থানীয়দের সাথে কথা বলে আগে থেকে জেনে নেবেন। মন্দিরে এখানে পাণ্ডাদের উৎপাত কম হলেও রয়েছে। তবে ওদের সাথে তর্ক করবেন না। ওদের এড়িয়ে চলবার চেষ্টা করুন। বিকেলে মন্দির খোলার পরপরই ভিড় কম থাকে। সেই সময় অনেক ভালোভাবে জগন্নাথের দর্শন পাওয়া যায় এবং পুরো মন্দির চত্বরেও ভালোভাবে ঘোরা যায়। ট্রিপ টিপস কিভাবে যাবেন – জগন্নাথ মন্দির ঘুরতে গেলে আসতে হবে পুরী। প্লেনে এলে ভুবনেশ্বর বিমানবন্দরে নামতে হবে। ভুবনেশ্বর বিমানবন্দর থেকে পুরী প্রায় ৫৫ কিমি দূরে। ট্রেনে করে আসতে চাইলে সবথেকে ভালো হয় হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে রাতের ট্রেনে পুরী স্টেশন।

তারপর ট্যাক্সি বা হোটেলের গাড়ি করে সরাসরি হোটেলে যাওয়া যায়। এছাড়া কলকাতা, দুর্গাপুর থেকে সরাসরি বাসেও পুরী আসা যায়। কোথায় থাকবেন – জগন্নাথ মন্দিরের কাছে থাকার জন্য বহু হোটেল, রিসোর্ট, গেস্ট হাউস, হলিডে হোম রয়েছে। হোটেলের ভাড়া প্রতিরাতে ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০০০ টাকা অবধি রয়েছে। জগন্নাথ মন্দিরের থেকে মাত্র ২ কিমির মধ্যে স্বর্গদ্বারের হোটেলগুলোতে থাকলে সুবিধা। কি দেখবেন – মন্দির চত্বরে দেখুন জগন্নাথ মন্দির, বিমলা মন্দির, মহালক্ষ্মী মন্দির, বটগণেশ মন্দির, নরসিংহ মন্দির, বটগণেশ, আনন্দবাজার ইত্যাদি। এছাড়াও মন্দিরের কাছেই ঘুরে দেখুন পুরীর সমুদ্র, স্বর্গদ্বার, জগন্নাথের মাসির বাড়ি, জগন্নাথের পিসির বাড়ি, লাইট হাউস, পুরীর মোহনা, গম্ভীরা, সুদর্শন পট্টনায়ক স্যান্ড আর্ট ইনস্টিটিউট, সুদর্শন ক্রাফট মিউজিয়াম।

কখন যাবেন – সারা বছর ধরেই এখানে ঘুরতে আসা যায়। তবে স্নানযাত্রার পরের ১৫ দিন মন্দির সাধারণের জন্য বন্ধ থাকে। সেই সময় গেলে জগন্নাথের দর্শন পাওয়া যাবে না। রথযাত্রার সময় যেতে চাইলে অনেক আগে থেকে সব বুকিং করে রাখতে হবে। সতর্কতা – জগন্নাথ মন্দিরে অহিন্দুদের প্রবেশ নিষেধ। মন্দিরের ভিতরে জুতো পরে প্রবেশ নিষেধ, ভিতরে ছবি তোলা নিষেধ। মোবাইল ও চামড়ার জিনিস নিয়ে যাওয়াও নিষেধ। দিনের কোন সময় মন্দির খোলা থাকে তা হোটেল থেকে বা স্থানীয়দের সাথে কথা বলে আগে থেকে জেনে নেবেন। বিশেষ পরামর্শ – বিকেলে মন্দির খোলার পরপরই ভিড় কম থাকে। সেই সময় অনেক ভালোভাবে জগন্নাথের দর্শন পাওয়া যায় এবং পুরো মন্দির চত্বরেও ভালোভাবে ঘোরা যায়।