রাম ঠাকুর এর জীবনী

সংসারে একেবারেই মন বসে না ছেলেটার। সব সময়ই চারপাশের মোহ-বন্ধনকে ছিঁড়ে ফেলে অজানার সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে, কিন্তু মায়ের অসহায় মুখ দেখে ছেলেটা আটকে পড়ে। জন্ম-জন্মান্তরের এক মায়াবন্ধন ঘর ছেড়ে বেরোতে দেয় না তাকে। তন্ত্রসাধক Ram Thakur রাধামাধব চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর তার দুই যমজ ছেলে রাম ও লক্ষ্মণের ওপরই সংসারের দায়ভার পড়ার কথা।
লক্ষ্মণ এদিক-ওদিক কাজের চেষ্টা করলেও রামের কাজকর্মে একেবারেই মন নেই। সারাক্ষণই আপনমনে সে কী যেন ভেবে চলে। ভগবানের নাম সংকীর্তন আর মাটির ঠাকুর তৈরি করে পুজো করেই সারাটা দিন কাটে তার। পুজোর সময় ঠাকুরের সঙ্গে আপন মনে কথা বলে চলে রাম। আড়াল থেকে মা ছেলেকে দেখে চোখের জল আটকাতে পারে না।
ছেলেদের ওপর দায় না চাপিয়ে মা কমলাদেবী নিজের মতো করে সংসারের তীব্র অর্থাভাব সামলানোর চেষ্টা করেন, কাউকে কিছু বুঝতে দেন না। রাম কিন্তু বুঝতে পারে যে, এ ভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না, তাকে কিছু একটা করতেই হবে। যেভাবেই হোক তার মায়ের মুখে হাসি ফোটাতেই হবে কিন্তু কী কাজ করবে বা কী কাজ সে পারে, সেটাই তার জানা ছিল না।
তবু, কালবিলম্ব না করে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল রাম। নানা জায়গায় কাজের খোঁজ করলেও কে তাকে কাজ দেবে ? উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরতে ঘুরতে রাম নোয়াখালির ফেনি শহরে পৌঁছল। সেখানে পথের মধ্যে এক উকিলের সঙ্গে তার আলাপ হলো। রামের সব কথা শুনে এবং তার ব্যবহারে সন্তুষ্ট হয়ে সেই উকিল তাকে বললেন, ‘যতদিন না অন্য কোন কাজ পাচ্ছো ততদিন আমার বাড়িতে থেকে আমাদের রান্না করতে হবে... পারবে?’ রাম কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেল। শুরু হলো রামের অন্যরকম এক জীবন।
সারাদিন ধরে রান্নাঘরে চাল, ডাল, আলু, পিঁয়াজ ইত্যাদির সঙ্গে থেকে থেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছিল রাম। সারাক্ষণ বাড়ির লোকেদের খাবারের তৈরি করার কাজে ব্যস্ত থাকলেও তার ঈশ্বরভক্তিতে একটুও ছেদ পড়ত না। সব কাজ সেরে সন্ধ্যাবেলায় সে তার আরাধ্য দেবতাকে পুজো করতে বসতো। পুজোর মধ্যেই ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলা নিয়ে এই নিয়ে বাড়ির অন্যান্য কর্মচারীরা তাকে বিদ্রূপ করত, তাকে নিয়ে চলত হাসিঠাট্টা, মশকরা।
যদিও রাম সেসব গায়েই মাখত না। এভাবেই বেশ চলছিল। একদিন বাড়ির কর্তা ঠিক করলেন কালীপুজো করবেন। কিছুদিন আগে তাঁর একমাত্র ছেলে মরণাপন্ন হওয়ায় তিনি মা কালীর কাছে ছেলের প্রাণভিক্ষা করেছিলেন। তাঁর ছেলে এখন সুস্থ, তাই তিনি মানতের পুজো করছেন। পুজোর দিন সকাল থেকে বাড়িতে সাজো সাজো রব কিন্তু সমস্যা হলো পুরোহিতকে নিয়ে।
একেবারে শেষ মুহূর্তে জানা গেল, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য পুরোহিত আসতে পারবেন না। দোর্দন্ডপ্রতাপ উকিলবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসলেন, এখন কী হবে ? সব আয়োজন যে সম্পূর্ণ। বাড়ির কয়েকজন কর্মচারী তাকে এসে বললো যে, বাড়িতেই তো পুরোহিত রয়েছে। এই অবস্থায় রামকে দিয়েই তো কাজ চালানো যেতে পারে। উকিলবাবুর কথাটা পছন্দ হলো। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সেদিন পুজোয় নিমন্ত্রিত। তাদের সামনেই বাড়ির রাঁধুনি রাম পরম নিষ্ঠাভরে মায়ের আরাধনা করল।
আমন্ত্রিতদের কাছে রামের কালীপুজো প্রশংসা কুড়োলেও বাড়ির অন্যান্য কর্মচারীরা কিন্তু তাকে ছাড়ল না, পুজোর মধ্যেই মা কালীর সঙ্গে কথোপকথন নিয়ে তারা রামকে বিদ্রূপ করতে শুরু করলো। রাম নানা ভাবে তাদের এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও সারাক্ষণ তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা চলতে লাগল। ওরা বার বার রামকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো, ‘কি গো রাম, মা তোমাকে কি বললো ? দু’জনে কী কথা হলো? ও ঠাকুর, বলো না... আমাদের খুব জানতে ইচ্ছা করছে।’ অনেক সহ্য করার পর রাম আর থাকতে পারল না।
প্রচন্ড রেগে গিয়ে বললো, ‘মা কী বলেছে তোমরা সত্যিই শুনতে চাও? তাহলে শোনো... মা বলেছে, বাবুর যে ছেলের জন্য মানত পুজো হলো, মা খুব শিগগিরই তাকে খেয়ে নেবে।’ রামের কথা শুনে উপস্থিত সবাই চমকে উঠল। তাদের কেউ কেউ রামকে তেড়ে মারতেও এল। মানসিকভাবে আহত, অপমানিত রাম কাউকে কিছু না বলে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
পরের দিন দুপুরে হঠাৎ সকলে দেখল উকিলবাবুর ছেলেকে সবাই ধরাধরি করে নিয়ে আসছে। ছেলেটি অন্যদিনের মতো স্কুলে গিয়েছিল। ডাক্তার এসে জানাল ছেলেটি মারাত্মক এক ধরনের কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে। সেদিন রাতেই ছেলেটি এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেল। ছেলেটির মৃত্যুতে কোনরকম দায় না থাকলেও সেই রাতে উকিল বাবুর রাঁধুনিও কাউকে কিছু না জানিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। যে রাঁধুনিই পরবর্তী কালে হয়ে উঠেছিলেন হাজার হাজার মানুষের ভরসা, শ্রদ্ধার ঠাকুর ...... রাম ঠাকুর ।