পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে রামের অস্তিত্ব বিভিন্ন রুপে

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে রামের অস্তিত্ব বিভিন্ন রুপে

রাম (সংস্কৃত: राम) হলেন হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর সপ্তম অবতার। হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলিতে তাকে অযোধ্যার রাজা বলা হয়েছে। বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রাম হিন্দুধর্মে তিনি একজন জনপ্রিয় দেবতা। রাম বিষ্ণুর অবতার হলেও তিনি মূলত শিব-এর আরাধনা করতেন। ভারত এবং নেপাল ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশে রাম এর পূজা প্রচলিত আছে। রামায়ণ থেকে রামের লীলাক্ষেত্র হিসেবে আমরা ভারতবর্ষকেই দেখতে পাই। তবে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, ভারতবর্ষ ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ভগবান শ্রীরাম ও রামায়ণের অস্তিত্ব ছড়িয়ে রয়েছে।  চীনে রামায়ণ বিখ্যাত চৈনিক ঐতিহাসিক কাং সেং হুয়া রামায়ণের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে জাতক কাহিনীর এক বিশাল সংগ্রহ তৈরি করেছিলেন।

এছাড়া ৭৪২ সালে লিখিত একটি বইয়ে রামের বনবাসে রাজা দশরথের অপরিসীম দুঃখের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। আরেকজন বিখ্যাত চৈনিক ঐতিহাসিক হিস ই চি ‘কপি’ নামে একটি উপন্যাস লিখেন। চৈনিক কপি শব্দের অর্থ বানর, যা রামায়ণের হনুমানের বর্ণনা করা হয়েছে। রামায়ণের মূল চরিত্র ভগবান শ্রীরাম আরো পড়ুনঃ বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর সংক্ষিপ্ত জীবনী শ্রীলংকায় রামায়ণ রামায়ণের কাহিনীর সাথে লঙ্কার নাম অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে। ধারণা করা হয় বর্তমান শ্রীলঙ্কাই রামায়ণের লঙ্কা।

খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ, নরেশ কুমার ধাতুসেনা কর্তৃক রচিত ‘জনকীহরণ’ নামক গ্রন্থে সীতা অপহরণ বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন। একইভাবে সি ডন বোস্টিয়ান এবং জন ডি সিলভা রামায়ণের কাহিনীভিত্তিক গ্রন্থ রচনা করেন। কম্বোডিয়ায় রামায়ণ দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ার কম্বোডিয়ার সাথে হিন্দু ধর্মের সম্পর্কে বেশ পুরনো। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মন্দির কম্বোডিয়ার আঙ্করভাট মন্দির এক সময় হিন্দু মন্দির ছিল। কম্বোডিয়ায় খেমার অঞ্চলে অনেক পাথরে খোদিত লিপি দিয়ে লিখিত গল্প ও চিত্র পাওয়া যায়, যাতে রামায়ণের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।

খেমার সাম্রাজ্যকালে নির্মিত অসংখ্য মন্দিরের দেয়ালে রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনী খোদাই করা আছে। মালয়েশিয়ায় রামায়ণ বিশ্বের যে কটি দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু ধর্মানুসারী বাস করে, তাঁর মধ্যে অন্যতম মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ার বিখ্যাত ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘হিকায়াত সেরি রাম’ এর কাহিনী সমূহের উপর ভিত্তি করে যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হয়। দালাং সম্প্রদায় নামক একটি সম্প্রদায় এই কাহিনীভিত্তিক যাত্রাপালসমূহের আয়োজন করে। এছাড়া ‘কাব্যাদর্শ’, সুভসিত রতনিধি’ প্রভৃতি গ্রন্থে রামায়ণের কাহিনী উল্লেখিত হয়েছে।

মালয়েশিয়ার অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ বাতু কেভে রামায়ণের কাহিনীর আলোকে অসংখ্য ভাস্কর্য রয়েছে। মালয়েশিয়ার বাতু কেভে রামায়ণের কাহিনী অবলম্বনে কুম্ভকর্ণের নিদ্রামগ্ন ভাস্কর্য  মুসলিম সমাজে রামায়ণ বিখ্যাত পর্যটক এবং ব্যবসায়ী মার্কো পোলো তাঁর ভ্রমণসাহিত্যে আলজেরিয়া, মরক্কো এবং আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে হনুমান কর্তৃক সাগর পাড়ি দিয়ে যুদ্ধের কাহিনী প্রচলিত ছিল।

এছাড়া আফ্রিকার বিভিন্ন খ্রিস্টান ও মুসলিম অধ্যুষিত দেশসমূহে শ্রীরামের পুত্র কুশের বংশানুক্রমে কুশাত নামের বংশধররা যুগ যুগ ধরে বসবাস করছে। থাইল্যান্ডে রামায়ণ থাইল্যান্ডের সাথে হিন্দু ধর্মের সংযোগ বেশ প্রাচীন। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতেও থাইল্যান্ডের রাজারা তাঁদের নামের পদ হিসেবে ‘রাম’ শব্দটি ব্যবহার করতেন। এখনও থাইল্যান্ডে রামায়ণের কাহিনী অবলম্বনে যাত্রা ও পালাগানের আয়োজন করা হয়। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে প্রাম্বানান মন্দির প্রাঙ্গণে ‘রামায়ণ ব্যালে’ ইন্দোনেশিয়ায় রামায়ণ ভারতবর্ষের বাইরে ইন্দোনেশিয়ার সাথে হিন্দু ধর্মের সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী ঘনিষ্ট।

মুসলিম প্রধান ইন্দোনেশিয়ায় বর্তমানে প্রায় চল্লিশ লক্ষ হিন্দু ধর্মানুসারী বসবাস করে। সমগ্র ইন্দোনেশিয়া জুড়েই রামায়ণের কাহিনী অবলম্বনে তৈরি ভাস্কর্য্যের দেখা পাওয়া যায়। এছাড়া ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে অবস্থিত প্রাম্বানান মন্দিরে প্রতিদিন ‘রামায়ণ ব্যালে’ অনুষ্ঠিত হয়।  লাওসে রামায়ণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ লাওসের বিখ্যাত মন্দির বত-শে-ফাম, বত-পা-কেব প্রভৃতির দেয়ালে রামায়ণের বিভিন্ন কাহিনী চিত্রিত রয়েছে।

ফরাসি পরিব্রাজক লাফন্ট লাওসের ঐতিহাসিক গ্রন্থ “প লাক-প লমা” এর অনুবাদ করেন, যাতে রামায়ণের প্রচুর কাহিনী উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া লাওসের সাধারণ লোকের মুখে রামায়ণের বিভিন্ন ঘটনা জনপ্রিয়। ইউরোপের দেশ ইতালিতে রামায়ণ ইউরোপের দেশ ইতালিতে এস্ট্রোকান সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ এর প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যে দেখা গেছে তখনকার ঘরসমূহের দেয়ালে রামায়ণে বিভিন্ন কাহিনী চিত্রিত থাকতো! দেখা গেছে তীর ধনুক হাতে শ্রীরাম ও তাঁর পাশে সীতা চিত্রিত। সেই চিত্রগুলো খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীর পুরনো।

উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় রামায়ণ আমরা জানি, বিখ্যাত নাবিক কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারের পূর্বে এ মহাদেশ সম্পর্কে বাকি বিশ্ব জানতোনা। তবে এ ডি ক্যাট্রেফাজেস তাঁর “The Human Species” গ্রন্থে দেখিয়েছেন, আদিকালে ভারতীয় ও চিনারা আমেরিকা সম্পর্কে জানতো এবং তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ছিল। বাল্মীকি রামায়ণে আমেরিকাকে বলা হয়েছে পাতাল দেশ।

বাস্তবিকভাবেই আমেরিকা ভৌগলিকভাবে পা-এর তলে অর্থাৎ ভারবর্ষের উল্টোপাশে অবস্থিত। উত্তর আমেরিকার মেক্সিকোর কিছু আদিবাসীদের মধ্যে মেয়েদেরকে উলুপী নামে ডাকা হয়। আর আমরা তো জানি অর্জুন পাতালদেশের রাজকন্যা উলুপীকে বিয়ে করেছিলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে রামায়ণের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ এই ঘটনাগুলো সারা বিশ্বব্যাপী সনাতন ধর্মের ছড়িয়ে থাকার কাহিনীকে আরো যুক্তিযুক্ত ও শক্তিশালী করে তোলে। আরো পড়ুনঃ দুই হাজার বছর আগে অযোধ্যার রাজকন্যা যেভাবে কোরিয়ার রানী হয়েছিলেন! বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে রামের পূজা অনেক আগে থেকে করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের কাটোয়া মহকুমায় প্রায় কুড়িটির মত রামের মূর্তি‌ আছে।

এছাড়া বাঁকুড়া জেলাতেও রাম মন্দির পাওয়া যায়। বাংলায় রঘুনাথশিলা রূপে ও তার পূজা করা হত।বাংলায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ খুব জনপ্রিয়।বাংলায় অনেক জায়গায় রামায়ণ গান হয়। রাঢ়বাংলায় রামকে নিয়ে অনেক মুদ্রা পাওয়া গেছে। রামকৃষ্ণ পরমহংস,রাণী রাসমণি,মুরারি গুপ্ত,চৈতন্যজীবনীলেখক দয়ানন্দ,অদ্বৈত আচার্য সহ অনেকে রামের পূজা করতেন।বাংলায় গৌড়ীয় বৈষ্ণবমত জনপ্রিয় হওয়ার আগে অনেকেই রাম মন্ত্রে দীক্ষা নিত।

রাণী রাসমণি রঘুবীরের রথযাত্রা করতেন।বীর হাম্বীর এর সময় বাঁকুড়া জেলায় অনেক রাম মন্দির তৈরি হয়।বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়াতে দুর্গাপূজার শেষ হয় "রাবণকাটা নৃত্য" দিয়ে।শিখ ধর্মের ধর্মগ্রন্থ আদিগ্রন্থ বা শ্রী গুরু গ্রন্থ সাহিব-এ অযোধ্যা নৃপতি পরম ধার্মিক রাজা রামচন্দ্রের কাহিনী ও রামায়ণের যুদ্ধের কাহিনী বর্নিত আছে।  বৌদ্ধধর্মানুসারে একবার বোধিসত্ত্ব শ্রীরামচন্দ্ররূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জাতকের কাহিনিতে তাই রামচন্দ্রের উল্লেখ আছে। বৌদ্ধধর্মে রামচন্দ্রকে পরম ধার্মিক এবং আদর্শ নৃপতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।  

 বৌদ্ধধর্মানুসারে একবার বোধিসত্ত্ব শ্রীরামচন্দ্ররূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। জাতকের কাহিনিতে তাই রামচন্দ্রের উল্লেখ আছে। বৌদ্ধধর্মে রামচন্দ্রকে পরম ধার্মিক এবং আদর্শ নৃপতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।