রাণী হামিদ এর জীবনী

রাণী হামিদ (Rani Hamid) একজন বাংলাদেশী মহিলা দাবাড়ু যিনি বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক দাবা গ্র্যান্ড মাস্টার। ব্রিটিশ মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে তিন তিনবার বিজয়ী হয়ে এবং কুড়িবার জাতীয় চ্যাম্পিয়নের খেতাব জিতে সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৯ সালে ৭৬ বছর বয়সেও রাণী হামিদ বাংলাদেশের জাতীয় মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন।
বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে মহিলা দলের পাশাপাশি জাতীয় দলের হয়েও চ্যাম্পিয়নশিপ খেলার কৃতিত্ব রাণী হামিদকে স্মরণীয় করে রেখেছে। দাবা অলিম্পিয়াডে যোগ্যতার ভিত্তিতে জাতীয় পুরুষ দলের হয়ে খেলার কৃতিত্বে পঞ্চম স্থানে রয়েছেন তিনি। তিনদশক ধরে দাবার জগতে অপ্রতিরোধ্য দাবাড়ু রাণী হামিদ যেন সত্যই দাবা খেলার রাণী! ১৯৪৪ সালের ১৪ জুলাই বাংলাদেশের সিলেটে রাণী হামিদের জন্ম হয়।
তাঁর বাবা সৈয়দ মমতাজ আলী ছিলেন বাংলাদেশের পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তা এবং তাঁর মা মোসাম্মৎ কামরুন্নেসা খাতুন ছিলেন একজন গৃহকর্ত্রী। সৈয়দ মমতাজ আলীর চার পুত্র ও চার কন্যা সন্তানের মধ্যে রাণী হামিদ ছিলেন তৃতীয় সন্তান। সৈয়দ আমীর আলী, শম্সের আলী, সৈয়দ দেলোয়ার আলী এবং সৈয়দ মোতাহের আলী প্রমুখ রাণী হামিদের চার ভাই আর তাঁর তিন বোনের নাম যথাক্রমে সৈয়দা জমিরুন্নেসা খাতুন, সৈয়দা লুৎফুন্নেসা খাতুন এবং মিনু মমতাজ।
রাণী হামিদ শৈশবে বাবার বদলির চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের বহু এলাকায় থাকার অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। বাবার উৎসাহে ছোটবেলা থেকেই বিদ্যালয়ের বা এলাকার যে কোনো রকম ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়া, দৌড়ে প্রথম হওয়া ছিল রাণী হামিদের সহজাত। ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জয়লাভের পুরস্কার স্বরূপ তোয়ালে, জগ, জল পান করার গ্লাস, খাবার প্লেট ইত্যাদি পেয়েছিলেন তিনি।
ছোট থেকেই বাবার অনুপস্থিতিতে ভাই বোনেদের সঙ্গে তিনি প্রায়ই দাবা খেলতে বসে যেতেন। কিন্তু রক্ষণশীলতার কারণে বিবাহের আগে দাবা নিয়ে এগোতে পারেননি তিনি। তাঁর আসল নাম সৈয়দা জসিমুন্নেসা খাতুন, ডাকনাম রাণী। বিবাহের পরে স্বামী আব্দুল হামিদের নামের অংশবিশেষ যোগ করে তিনি বিশ্বের দরবারে রাণী হামিদ নামে পরিচিত করেন নিজেকে। স্বামী আব্দুল হামিদ পাকিস্তান নৌ-বাহিনীর কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশের হ্যান্ডবল ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন।
১৯৫২ সালে চট্টগ্রামের নন্দনকানন গার্লস হাইস্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে রাণী হামিদের প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা হয়। যদিও তাঁর বাবার বদলির চাকরি হওয়ায় বহুবার তাঁকে বিদ্যালয় পরিবর্তন করতে হয়েছে। ১৯৫৪ সালে পুনরায় বিদ্যালয় পরিবর্তন করে রাণী হামিদ ভর্তি হন কুমিল্লা মিশনারি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে। এই স্কুলেও তাঁর বেশিদিন কাটেনি। কুমিল্লার ফয়জুন্নেসা গার্লস হাই স্কুলে ৫ম শ্রেণি থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন তিনি এবং বাবার বদলির কারণে কুমিল্লা থেকে রাজশাহীতে চলে আসেন।
রাজশাহীতে একটি স্কুলে অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে পড়ার পর পুনরায় সিলেটে ফিরে সিলেট বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিক উত্তীর্ণ হন রাণী হামিদ। এরপরেই তাঁর বিবাহ হয়ে যাওয়ায় প্রথাগত পড়াশোনায় ছেদ ঘটে। তবে নিজ উদ্যোগে দূরশিক্ষা-প্রণালীতে (distance education) ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং পরে স্নাতক উত্তীর্ণ হন তিনি। রাণী হামিদের কর্মজীবনের পুরোটা জুড়েই রয়েছে দাবা।
যদিও বিবাহের পরে সংসার ও সন্তান প্রতিপালন সামলেই দাবার জগতে প্রবেশ ঘটে তাঁর। তবে কখনোই শুধু দাবাকে তাঁর কর্মজীবনের অঙ্গ মানতে চাননি তিনি। সংসার এবং দাবা দুটিই তাঁর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্র বলে মনে করতেন তিনি। দাবার প্রতি প্রবল আগ্রহ এবং আকর্ষণ থেকেই তাঁর দাবা খেলতে আসা। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কোয়ার্টারে থাকার সময় প্রতিবেশি জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ন ড. আকমল হোসেনের সংস্পর্শে এসে দাবা খেলা শিখতে শুরু করেন রাণী হামিদ এবং তাঁরই সাহায্যে প্রথম ১৯৭৬ সালে মহসিন দাবা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন তিনি।
ড. আকমল হোসেনের প্রশিক্ষণ এবং স্বামী আব্দুল হামিদের পৃষ্ঠপোষকতা তাঁকে শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু হতে অনেকাংশে সহায়তা করেছে। রাণী হামিদের দাবার প্রশিক্ষক ড. আকমল হোসেন সম্পর্কে শোনা যায় যে সম্পর্কে তিনি রাণী হামিদের মেয়ের বান্ধবীর বাবা ছিলেন। মেয়ের মাধ্যমে ড. আকমল হোসেনকে বাড়িতে ডেকে দাবা খেলা শুরুর মধ্য দিয়েই প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন রাণী হামিদ। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত পরপর তিনবার দাবা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে নবদিগন্ত সংসদ দাবা ফেডারেশন, শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য।
এই তিনটি প্রতিযোগিতাতেই রাণী হামিদ যোগ দেন এবং তিনবারই চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। ১৯৭৯ সালে আরেকটি উন্মুক্ত দাবা প্রতিযোগিতাতেও জয়ী হয়ে একই বছরে দুটি চ্যাম্পিয়নশিপের খেতাব অর্জন করেন রাণী হামিদ। ১৯৮০ সাল থেকে একেবারে পেশাদারিভাবে দাবা খেলা শুরু করেন তিনি। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে থাকেন রাণী হামিদ এবং সাথে তাঁর জয়লাভের রেকর্ড ক্রমেই বাড়তে থাকে। ৩৩ বছর বয়সে দাবা খেলায় তাঁর কর্মজীবনের সূচনা বলা চলে।
১৯৮১ সালে ভারতের হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম এশীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে যোগ দিয়ে রাণী হামিদ যথেষ্ট প্রশংসিত হন তাঁর খেলার দক্ষতার জন্য। ১৯৭৯ সাল থেকে শুরু করে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মোট ছয়বার তিনি জাতীয় মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নের শিরোপা অর্জন করেন। এসময় তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ইয়াসমিন বেগম এবং সৈয়দা শাবানা পারভিন নীপা।
১৯৮৩, ১৯৮৫ এবং ১৯৮৬ সালে তিনি ব্রিটিশ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে জয়লাভ করেন। সামান্য এক বাঙালি নারীর কাছে এই পরাজয়ের গ্লানি মেনে নিতে পারেনি ব্রিটিশ ক্রীড়াজগত। পরবর্তীকালে স্বদেশ বাদে অন্যদেশের মহিলাদের চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণের সুযোগই বন্ধ করে দেয় ব্রিটিশরা। ১৯৮৩ সালে নিউ দিল্লিতে ফখরুদ্দিন আলি আহমেদ টুর্নামেন্টে কিশোর বিশ্বনাথন আনন্দের সঙ্গে দাবা খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে রাণী হামিদের। বিশ্বনাথন আনন্দ তখনও বিশ্বসেরা গ্র্যান্ডমাস্টার হননি, কিন্তু সেই ম্যাচে রাণী হামিদকে পরাজিত করেছিলেন তিনি।
১৯৮৪ সালে পুরুষ দলের হয়ে গ্রিসের দাবা অলিম্পিকে যোগ দেন রাণী হামিদ। এছাড়া লয়েড ব্যাঙ্ক মাস্টার্স দাবা, শহীদ মুফতি কাসেদ অনান্তর্জাতিক দাবা, সার্ক এয়ারলাইন্স দাবা এবং এশিয়ান সিটি চেস চ্যাম্পিয়নশিপে জয়ীর মুকুট অর্জন করেন রাণী হামিদ। ২০১৮ সালে জোনাল চ্যাম্পিয়ন ছিলেন তিনি। ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি কুড়িটি জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে জয়ী হয়েছেন যা দাবার জগতে মহিলা হিসেবে এক বিস্ময়কর কৃতিত্ব। বাংলাদেশে এত বৃহৎ রেকর্ড গড়ার নজির দ্বিতীয় কেউ সৃষ্টি করতে পারেননি।
২০০৫ সালে ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে রাণী হামিদ অংশগ্রহণ করেও শেষ পর্যন্ত জিততে পারেননি, রানার্স আপ হয়েছিলেন তিনি। দাবায় বহুবার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম তুলেছেন রাণী হামিদ। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশের প্রথম ‘ফিডে’ মহিলা আন্তর্জাতিক দাবা মাস্টারের সম্মান পান তিনি।
এছাড়াও ২০১৭ সালে দিল্লিতে আয়োজিত কমনওয়েলথ দাবায় স্বর্ণপদক জয় এবং তার পরের বছর ২০১৮ সালে রাশিয়ান বিশ্বকাপে ‘জার্নালিস্টস চয়েজ অ্যাওয়ার্ড’ প্রাপ্তি তাঁর মুকুটে নতুন পালক এনে দেয়। আগ্রহী কিশোর-কিশোরীদের উৎসাহিত করতে এবং প্রশিক্ষণ দেবার জন্য রাণী হামিদ সহজ বাংলায় দাবা খেলার উপর দুটি বই লিখেছেন – ‘মজার খেলা দাবা’ এবং ‘দাবা খেলার আইন-কানুন’। আমৃত্যু দাবা নিয়েই থেকে যেতে চান রাণী হামিদ এবং বয়স বাড়লেও প্রতিনিয়ত নতুন নিতুন রেকর্ড গড়ার স্বপ্ন আজও তাঁকে তাড়িত করে। ৭৬ বছর বয়সেও ৩৯তম জাতীয় মহিলা দাবায় তিনি বিজয়ী হয়েছেন।