রান্নাপুজো এর ব্রতকথা

থায় বলে বাঙালির নাকি ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’। কিন্তু প্রবাদটি আংশিক সত্যি। সারাবছর ধরে বাঙালির জীবনযাত্রা লক্ষ্য করলে অন্তত কুড়ি থেকে বাইশটি ‘পার্বণ’-এর হদিশ পাওয়া যাবেই! তার মধ্যেই অন্যতম ‘অরন্ধন’ বা রান্নাপুজো (Ranna puja)। রান্নাপুজো য় আসলে নাগদেবী মনসার উপাসনা করা হয়। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষাকাল। এইসময় বঙ্গে প্রবল বৃষ্টি হয়, এবং বৃষ্টির ফলে বাড়ে সাপের আনাগোনা।
বিষধর সাপের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য ধর্মপ্রাণ বাঙালী ভাদ্র মাসের সংক্রান্তি অর্থাৎ শেষের আগের দিন সাপের দেবী মা মনসার আরাধনা করে। দেবীর প্রতীক হিসেবে রান্নাঘর ও উনুনকে পুজো করা হয়। কোথাও কোথাও মনসার মূর্তি বা পাঁচটি সাপের মূর্তিও গড়া হয়ে থাকে। রান্নাপুজো য় আসলে নাগদেবী মনসার উপাসনা করা হয়। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষাকাল।
এইসময় বঙ্গে আগের দিন ঘরে ঘরে রান্না হয় নানারকম খাদ্যদ্রব্য। মরসুমের সেরা সব্জি ও মাছ থাকে রান্নার তালিকায়। আর থাকে পান্তা ভাত। কচুর শাক, ওলের বড়া, আরো নানা রকম ভাজাভুজি, চচ্চড়ি, ইলিশ মাছ ও অন্যান্য নানা মাছের বিভিন্ন পদ, চালতার চাটনি প্রভৃতি রেঁধে তুলে রাখা হয় পরের দিনের জন্য। পুজোর দিন সকালে রান্নাঘর ধুয়ে মুছে আলপনা দেওয়া হয়।
সাজিয়ে দেওয়া হয় রোজকার রান্নার উনুনকেও। ওইদিন বন্ধ থাকে সমস্ত রান্নাবান্না। পুজোর আয়োজন হয় রান্নাঘরেই। শালুক ও ফণীমনসার ডাল দিয়ে সাজানো হয় দেবীর ঘট। আগের দিনের রেঁধে রাখা বাসি ভোগ নিবেদন করা হয় দেবীকে। পুজো শেষ হওয়ার পর ভোগ গ্রহণ করেন সকলে। তিথি অনুযায়ী ভাদ্র মাসের রান্না খাওয়া হয় আশ্বিন মাসে।
রান্না বন্ধ থাকার কারণে এই অনুষ্ঠানের নাম ‘অরন্ধন’ ও উনুনকে পুজো করার কারণে নাম হয় রান্নাপুজো । এছাড়াও স্থানভেদে ‘ইচ্ছারান্না,‘’ধরাটে রান্না’, ‘আটাশে রান্না’ প্রভৃতি নামে পরিচিত এই পার্বণ। গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় জলাশয়গুলিতে এইদিন মাছ ধরার প্রতিযোগিতাও আয়োজিত হয়। থাকে না কোনো বাধা বা নিষেধাজ্ঞা।
সবথেকে বেশি পরিমাণে মাছ যে ব্যক্তি ধরতে পারেন, তাঁকে পুরস্কৃতও করা হয়ে থাকে। জনশ্রুতি এই যে, চৈতন্যদেবের সময়কালে দেবী দুর্গার এক রূপ হিসেবেই পূজিতা হতেন দেবী মনসা। তাই সেকালে এই উৎসবে প্রচলিত ছিল বলিদান প্রথা। ছাগল বলি ছাড়াও আরো নানা পশু ও চালকুমড়ো, আখ ইত্যাদি বলি দেওয়া হত দেবীর উদ্দেশ্যে। এখন কালের প্রভাবে সেই প্রথা প্রায় অবলুপ্ত হয়েছে।
অবশ্য কিছু কিছু জায়গায় এখনো চালু আছে বলি দেওয়ার প্রথা। শাস্ত্রমতে শারদীয়া দুর্গাপূজার আগে এটিই বাঙালির শেষ উৎসব। তাই দেবী মনসার পূজার মাধ্যমেই বঙ্গে শুরু হয়ে যায় দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি। শোনা যায় অনেকদিন আগে এক দেশে এক সদাগর ছিল। তার ছিল সাত বৌ। ছোট বৌ খুব গরীব ঘরের মেয়ে ছিল, তাই বাকি বৌয়েরা কেউ তার সাথে ভালো করে কথা বলতো না।
একদিন সন্ধ্যাবেলায় সব বৌরা মিলে বনের পাশে এক পুকুরে স্নান করতে যায়। সেই বনে বাস করত অষ্টনাগ, বনে আগুন লেগে যাওয়ায় তারা মাছ হয়ে সেই পুকুরে লুকিয়ে ছিল। পুকুরে স্নান করতে গিয়ে ছোট বৌ পুকুরে এক ঝাঁক মাছ দেখে গামছা দিয়ে সেগুলি ধরলো। বাড়ি এসে হাঁড়িতে জল দিয়ে মাছগুলিকে জিইয়ে রাখলো। তার পরদিন সকাল বেলা মাছগুলিকে কাটতে গিয়ে ছোট বৌ দেখলো হাঁড়ির ভেতর আটটি সাপ রয়েছে। আশ্চর্য হলেও ছোট বৌ কাউকে কিছু বললো না। সে সাপগুলিকে দুধ-কলা খাইয়ে পুষতে লাগলো।
আস্তে আস্তে সাপগুলি বেশ বড় হয়ে উঠলো। সাপগুলি তখন মনে করলো ছোট বৌয়ের কোনো উপকার করতে হবে। এই ভেবে তারা স্বর্গে গিয়ে মা মনসাকে সব কথা জানালো। সব কথা শুনে মা মনসা ছোট বৌয়ের মাসির রূপ ধরে তাকে স্বর্গে নিয়ে এলেন। তাকে বলে দিলেন রোজ মনসা পুজোর আয়োজন করে রাখতে আর অষ্টনাগের জন্য দুধ গরম করে রাখতে। এছাড়াও বৌকে দক্ষিণ দিকে তাকাতে বারণ করে দিলেন। এমনভাবেই মনসার প্রাসাদে পরম সুখে ছোট বৌয়ের দিন কাটতে লাগলো।
হঠাৎ একদিন তার মনে প্রশ্ন জাগলো দক্ষিণ দিকে কী আছে। নিষেধের কথা ভুলে গিয়ে দক্ষিণ দিকে তাকাতেই দেখতে পেল মা মনসা নাচছেন। সে অবাক হয়ে সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখতে থাকলো। ভুলে গেল দুধ গরম করে রাখার কথা। নাচ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সেকথা মনে পড়ায় তাড়াতাড়ি গিয়ে দুধ গরম করে আনলো। কিন্তু ফুটন্ত দুধ খেয়ে সাপেদের মুখ পুড়ে গেল।
রাগে অস্থির হয়ে সাপেরা ছোট বৌকে কামড়াবে বলে বাড়ির চারিদিকে লুকিয়ে থাকল। সেই কথা জানতে পেরে মা মনসা বৌকে অর্ধেক শরীরে গয়না পরিয়ে পৃথিবীতে ফিরিয়ে দিয়ে এলেন। আর বলে দিলেন অষ্টনাগের সুখ্যাতি করতে। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বৌয়ের অদ্ভুত সাজের কথা জিজ্ঞাসা করলো। ছোট বৌ অষ্টনাগের প্রশংসা করে বললে আট ভাই থাকতে তার আবার গয়নার অভাব!
এদিকে বাড়ির বাইরে থাকা অষ্টনাগ সেই কথা শুনতে পেয়ে সব রাগ ভুলে গেলো। তারা আবার স্বর্গে গিয়ে মনসাকে অনুরোধ জানালো বৌয়ের সারা দেহে গয়না পড়িয়ে দেওয়ার জন্য। তাদের অনুরোধে মা মনসা আবার পৃথিবীতে এসে ছোট বৌকে অনেক গয়না দিয়ে গেলেন। আর নিজের পরিচয় দিয়ে বলে গেলেন ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিন ফণীমনসা গাছের ডাল এনে মনসার পুজো করে পান্তা ভাত ও মাছের নানা পদ ভোগ দিতে।
ছোট বৌ বাড়ি এসে সবাইকে সমস্ত কথা বললে। সবাই খুব আশ্চর্য হল আর ছোট বৌয়ের প্রশংসা করতে লাগলো। বৌও মনসা দেবীর কথামতো সমস্ত আয়োজন করে মনসা পুজো করতে লাগলো। এইভাবেই ধীরে ধীরে পৃথিবীতে মনসা পুজো তথা রান্নাপুজো র কথা প্রচার হল।