সারদা দেবী | হিন্দু আধ্যাত্মিক রামকৃষ্ণ পরমহংসের স্ত্রী ও সাধনসঙ্গিনী

সারদা দেবী | হিন্দু আধ্যাত্মিক রামকৃষ্ণ পরমহংসের স্ত্রী ও সাধনসঙ্গিনী

সারদা দেবী (Sarada Devi) একজন ভারতীয় হিন্দু Hindu আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব যিনি   রামকৃষ্ণ পরমহংসের স্ত্রী ও সাধনসঙ্গিনী এবং রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সংঘজননী হিসেবে পরিচিত। তাঁর ভক্তেরা তাঁকে ‘শ্রীশ্রীমা’ নামেই অভিহিত করে থাকেন। নিজের সম্পর্কে তিনি বলতেন- “আমি সতেরও মা, অসতেরও মা।“ রামকৃষ্ণ পরমহংস তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন- “ও সারদা, সাক্ষাৎ সরস্বতী!” ১৮৫৩ সালের ২২ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমার অন্তর্গত প্রত্যন্ত গ্রাম জয়রামবাটীর এক দরিদ্র ধর্মপরায়ণ ব্রাহ্মণ পরিবারে সারদা দেবীর জন্ম হয়। তাঁর সম্পূর্ণ নাম – সারদামণি মুখোপাধ্যায়। জন্মের পর প্রথমে তাঁর নাম রাখা হয় ‘ক্ষেমঙ্করী’।

পরে এটি পরিবর্তন করে রাশি অনুসারে তাঁর নাম রাখা হয় ‘ঠাকুরমণি’। কিন্তু সদ্য নিজের সারদা নামের কন্যাসন্তানের মৃত্যুশোকে আকুল তাঁর এক মাসির অনুরোধে সেই নাম শেষে সারদামণি দেবী হয়ে যায়। তাঁর পিতৃকূল অর্থাৎ মুখোপাধ্যায়-বংশ মূলত রামের উপাসক ছিল।বাবা রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় দরিদ্র হলেও পরোপকারী ও দানশীল ব্যক্তি ছিলেন। তিনি কৃষিকাজ ও পুরোহিতবৃত্তি করে জীবিকানির্বাহ করতেন এবং তিন ভাইকে প্রতিপালন করতেন। সারদা দেবীর মায়ের নাম শ্যামাসুন্দরী দেবী। সারদামণি দেবী বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান ছিলেন। নিজের জন্ম প্রসঙ্গে তিনি বলতেন, “আমার মা শিওড়ে ঠাকুর দেখতে গিয়েছিলেন।

ফেরবার সময় হঠাৎ শৌচে যাবার ইচ্ছা হওয়ায় দেবালয়ের কাছে এক গাছতলায় যান। শৌচের কিছুই হলো না, কিন্তু বোধ করলেন, একটা বায়ু যেন তাঁর উদরমধ্যে ঢোকায় উদর ভয়ানক ভারী হয়ে উঠল। বসেই আছেন। তখন মা দেখেন লাল চেলি পরা একটি পাঁচ-ছ বছরের অতি সুন্দরী মেয়ে গাছ থেকে নেমে তাঁর কাছে এসে কোমল বাহু দুটি পিঠের দিক থেকে তাঁর গলায় জড়িয়ে ধরে বলল, আমি তোমার ঘরে এলাম মা।

তখন মা অচৈতন্য হয়ে পড়েন। সকলে গিয়ে তাঁকে ধরাধরি করে নিয়ে এল। সেই মেয়েই মায়ের উদরে প্রবেশ করে; তা থেকেই আমার জন্ম।” এর কিছুদিন আগেই অর্থাভাবে ক্লিষ্ট রামচন্দ্র স্বপ্নে সোনার অলঙ্কারে ভূষিতা এক বালিকার দর্শন পান। তিনি তাঁর পরিচয় জানতে চাইলে সে উত্তরে জানায় “এই আমি তোমার কাছে এলাম।” সারদা দেবীর জন্মের পর মুখোপাধ্যায় দম্পতির কাদম্বিনী, প্রসন্নকুমার, উমেশচন্দ্র, কালীকুমার, বরদাপ্রসাদ ও অভয়াচরণ নামক আরো ছয় সন্তানের জন্ম হয়েছিল।

১৮৫৯ সালের মে মাসে, সেকালে প্রচলিত গ্রাম্য প্রথা অনুসারে মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই তেইশ বছরের গদাধর চট্টোপাধ্যায়ের (শ্রীরামকৃষ্ণের) Ramakrishna সঙ্গে তাঁর বিবাহসম্পন্ন হয়। এই সময় শ্রীরামকৃষ্ণ কঠোর ব্রহ্মচর্য অনুশীলন করছিলেন। তাই তাঁর মা ও দাদারা সাংসারিকক্ষেত্রে তাঁর মন স্থিত করতে এই বিবাহকে মাধ্যম করেন।কথিত আছে, শ্রীরামকৃষ্ণই গোপনে পাত্রীর সন্ধানরত মা চন্দ্রমণি দেবীকে পাত্রীর সন্ধান দিয়ে বলেছিলেন – “তোমরা বৃথাই পাত্রী খুঁজে বেড়াচ্ছ। জয়রামবাটীর রামচন্দ্র মুখুজ্যের বাড়িতে দেখগে বিয়ের কনে সেখানে কুটোবাঁধা আছে।” সারদা দেবীর প্রথাগত বিদ্যালয় শিক্ষা একেবারেই ছিল না। ছেলেবেলায় মাঝে মাঝে ভাইদের সঙ্গে পাঠশালায় গিয়ে তাঁর কিছু অক্ষরজ্ঞান হয়েছিল।

পরবর্তী জীবনে কামারপুকুরে শ্রীরামকৃষ্ণের ভ্রাতুষ্পুত্রী লক্ষ্মী দেবী ও শ্যামপুকুরে একটি মেয়ের কাছে ভাল করে লেখাপড়া শেখেন। ছেলেবেলায় গ্রামে আয়োজিত যাত্রা ও কথকতার আসর থেকেও তিনি অনেক পৌরাণিক আখ্যান ও শ্লোক শিখেছিলেন। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তাঁকে আধ্যাত্মিক জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় জপ ও ধ্যানের নির্দেশিকা দেন।সারদা দেবী প্রতিদিন রাত তিনটের সময় ঘুম থেকে উঠে সূর্যোদয়ের আগেই নির্জনে গঙ্গাস্নানসম্পন্ন করতেন। বেলা একটার আগে তিনি বাইরে বের হতেন না। শোনা যায়, শ্রীরামকৃষ্ণ দিব্যদৃষ্টিতে সারদাদেবীকে তাঁর অবর্তমানে আধ্যাত্মিক প্রচারকার্য চালিয়ে নিয়ে যেতে দেখে তাঁকে মন্ত্রশিক্ষা ও মানুষকে আধ্যাত্মিক পথে পরিচালিত করার শিক্ষাদান করেন। তাই সারদাদেবীকেই শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম শিষ্য বলে মনে করা হয়।

চোদ্দো বছর বয়সে প্রথম স্বামীকে দেখতে এসে তিনমাস কামারপুকুরে থাকার সময়ে সারদাদেবী তাঁর স্বামীর থেকে ধ্যান ও আধ্যাত্মিক জীবনের প্রয়োজনীয় নির্দেশ পান। এরপর আঠারো বছর বয়সে ১৮৭২ সালে দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণকে এক মহান আধ্যাত্মিক গুরুরূপে আবিষ্কার করেন। তখন থেকে ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের নহবতের একতলার একটি ছোটো ঘরে তিনি বাস করতেন।

এইসময় সারদাদেবী ও দিব্যমাতৃকাকে অভিন্ন জ্ঞান করে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে কালীর আসনে বসিয়ে পুষ্প ও উপাচার দিয়ে ষোড়শী পূজা করেন। তাঁদের বৈবাহিক জীবনও ছিল আধ্যাত্মিক ভাবে পূর্ণ। শেষজীবনে গলার ক্যানসারে আক্রান্ত শ্রীরামকৃষ্ণের সেবা এবং স্বামী ও তাঁর শিষ্যদের জন্য রন্ধনকার্য সারদা দেবী নিজেই করতেন।১৮৮৬ সালের আগস্ট মাসে শ্রীরামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর বিধবার বেশ ধারণ করতে গেলে দিব্যদর্শনে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে নিরস্ত করে বলেন, “তিনি মারা যাননি, কেবল এক ঘর থেকে আর এক ঘরে গেছেন।” শ্রীরামকৃষ্ণের প্রয়াণের দুই সপ্তাহ পর লক্ষ্মী দেবী, গোপাল মা প্রমুখ শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহস্থ ও সন্ন্যাসী শিষ্যদের সঙ্গে নিয়ে সারদা দেবী অযোধ্যা, কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরসহ কৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র বৃন্দাবনে তীর্থযাত্রা করেন।

জনশ্রুতি আছে, এই বৃন্দাবনেই সারদাদেবীর নির্বিকল্প সমাধি লাভ হয় এবং গুরু জীবনের সূত্রপাত হয়। এরপর কয়েকমাস কামারপুকুরে দুঃখকষ্টের জীবন অতিবাহিত করার পর ১৮৮৮ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যরা তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। স্বামী সারদানন্দ বাগবাজারে তাঁর জন্য স্থায়ী বাসভবন নির্মাণ করান। ‘মায়ের বাটী’ নামে পরিচিত বাড়িটিতেই জয়রামবাটীর পর সারদাদেবী জীবনের দীর্ঘতম সময় অতিবাহিত করেছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, যোগেন মহারাজ প্রমুখদের তিনি মন্ত্রদীক্ষা দান করেন। সন্তানহীন হলেও তিনি শিষ্য ও ভক্তদের তাঁর আধ্যাত্মিক সন্তান বলে মনে করতেন। প্রতিদিন অগণিত ভক্ত বাগবাজারে তাঁর দর্শন, উপদেশ ও দীক্ষালাভের আশায় ভিড় জমাতেন। তাঁর মাতৃসমা মূর্তি ও মাতৃসুলভ ব্যবহার সকলকে মানসিক শান্তি দিত। অপরদিকে, মা শ্যামাসুন্দরীদেবীর মৃত্যুর পর বিধবা ভাতৃ জায়া সুরবালা ও তাঁর রাধারানি বা রাধু নামক একগুঁয়ে এবং মানসিক বিকারগ্রস্থ সন্তানের ভারগ্রহণ করেন সারদা দেবী।

মায়ের মতোই ধৈর্যসহ রাধুর যত্ন করতেন সারদা দেবী । বলা হয়, কয়েকজন শিষ্য তাঁর দর্শনলাভের পর আধ্যাত্মিক অনুভূতিপ্রাপ্ত হন, অনেকে তাঁর সাক্ষাৎ দর্শনে দেবীরূপে তাঁর দর্শনলাভ করেন আবার কেউ স্বপ্নে তাঁর থেকে দীক্ষালাভ করেন। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রয়াণের পর তাঁর শিষ্যেরা সারদা দেবীকে নিজেদের জননীর আসনে বসিয়েছিলেন। তাঁর উপদেশ ও উৎসাহ লাভের আশায় তাঁরা বারবার ছুটে আসতেন। তাঁদের উদ্দেশ্যে সারদা দেবীর কিছু উপদেশ ছিল- “যারা এসেছে, যারা আসেনি, যারা আসবে, আমার সকল সন্তানকে জানিয়ে দিও, মা, আমার ভালবাসা, আমার আশীর্বাদ সকলের ওপর আছে।”

স্বামী নিখিলানন্দ, স্বামী অশেষানন্দ, স্বামী বিরেশ্বরানন্দ এবং স্বামী বিরজানন্দ ছিলেন তাঁর প্রধান শিষ্য। এছাড়া রামকৃষ্ণের মতাদর্শ অনুসরণকারী ভগিনী নিবেদিতা, ভগিনী দেবমাতার মত বিদেশিনীদের সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। নারীশিক্ষায় বিশেষভাবে আগ্রহী সারদা দেবী, ভগিনী দেবমাতাকে তাঁর নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন।

সারদা দেবী সারদা দেবী রামকৃষ্ণ সংঘ ও ভক্তসমাজে সর্বাধিক শ্রদ্ধার আসনটি লাভ করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং তাঁকে নিজের প্রয়াণের পর রামকৃষ্ণ আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভক্তদের বলেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ ও সারদা দেবীর সত্তায় কোনো পার্থক্য আরোপ না করতে। সারদা দেবীর জন্মের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ১৯৫৪ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের আদর্শ অনুসরণকারী সাধিকা ও ব্রহ্মচারিণীদের প্রশিক্ষণের জন্য গঙ্গার তীরে সারদা মঠ এবং সারদা রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের সূচনা হয়।

আজও প্রতিবছর তাঁর জন্মতিথিতে বাঁকুড়ার জয়রামবাটির সারদা মন্দিরে ভোর ৪টে ৩০ মিনিটে মঙ্গলারতির মধ্য দিয়ে সূচিত হয় উৎসব। ভোর ৪টে ৩৫ মিনিটে মাতৃমন্দিরে বেদ পাঠ ও স্তবগান করা হয়। সকাল ৭টায় বিশেষ পুজো। সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে মন্দিরের সন্ন্যাসী, স্থানীয় গ্রামবাসী, ভক্ত ও বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা শুরু হয়।জয়রামবাটি গ্রাম পরিক্রমা শেষে যজ্ঞ, আরতি, ভক্তিগীতি, কথা পাঠ, ধর্মসভা, সানাই ও বাউল গানের মত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি প্রসাদ বিতরণের মতো নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালিত হয় উৎসব।বেলুড় মঠেও বিভিন্ন স্কুল, কলেজ থেকে শোভাযাত্রা করে আসেন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। মূল মন্দিরের পাশে অস্থায়ী মণ্ডপে দিনভর গান, শ্রুতি নাটক, সারদা কথামৃত পাঠ-সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসে সারদা দেবী জয়রামবাটী যাত্রা করেন এবং একবছর কাটান। শেষ তিনমাসে তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে। ১৯২০ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি অশক্ত অবস্থায় তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। এরপর প্রায় পাঁচমাস রোগযন্ত্রণা ভোগ করে ১৯২০ সালের ২০ জুলাই রাত দেড়টায় কলকাতার উদ্বোধন ভবনে সারদা দেবীর মৃত্যু হয়।বেলুড় মঠে গঙ্গার তীরে যে স্থানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল, সেখানেই বর্তমানে গড়ে উঠেছে শ্রীমা সারদা দেবীর সমাধিমন্দির। মৃত্যুর আগে এক শোকাতুরা শিষ্যাকে তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন, “যদি শান্তি চাও, মা, কারও দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপন করে নিতে শেখ। কেউ পর নয়, মা, জগৎ তোমার।