সতীশ ধাওয়ান : ইসরোর প্রাক্তন চেয়ারম্যান সতীশ ধবন

সতীশ ধাওয়ান : ইসরোর প্রাক্তন চেয়ারম্যান সতীশ ধবন

সতীশ ধাওয়ান (Satish Dhawan) ভারতের একজন বিখ্যাত মহাকাশ ইঞ্জিনিয়ার এবং গণিতবিদ সমগ্র বিশ্বে পরীক্ষামূলক তরল গতিবিদ্যা( experimental fluid dynamics) বিষয়ে গবেষণার জনক হিসেবে বিখ্যাত। ভারতের মহাকাশ গবেষণার পথপ্রদর্শক ছিলেন তিনি।

ভারতের অন্যতম প্রধান মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র এবং রকেট-উৎক্ষেপন কেন্দ্র ‘ইসরো’ অর্থাৎ ইণ্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনের তৃতীয় চেয়ারম্যান ছিলেন সতীশ ধাওয়ান। তাঁর মৃত্যুর পরে অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীহরিকোটায় অবস্থিত স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ কেন্দ্রটির নাম ‘সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার’ করা হয়েছে।

১৯২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত ভারতের জম্মু-কাশ্মীর প্রদেশের শ্রীনগরে এক পাঞ্জাবি পরিবারে সতীশ ধাওয়ানের জন্ম হয়। তাঁর বাবা ছিলেন একজন সিভিল সার্ভিস অফিসার। সতীশ ধাওয়ানের আদি নিবাস ছিল অধুনা পাকিস্তানের দেরা ইসমাইল খান নামক স্থানে।

পাকিস্তানের লাহোরে সতীশ ধাওয়ানের জীবনের বেশ কিছু মূল্যবান বছর অতিবাহিত হয়েছে। সতীশ ধাওয়ান লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনটি বিষয়ে স্নাতক হন। একাধারে তিনি পদার্থবিদ্যা এবং গণিতে বি.এস.সি ডিগ্রি লাভ করেন, আবার মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (Mechanical Engineering)-এও স্নাতক হন এবং সর্বোপরি ইংরাজি ভাষা-সাহিত্যে স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হন।

উচ্চশিক্ষার জন্য সতীশ ধাওয়ান এরপরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন। সেখানে তিনি ১৯৪৭ সালে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এম.এস.সি ডিগ্রি লাভ করেন মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর একই সঙ্গে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও এম.এস.সি ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৫১ সালে হান্স.ডব্লিউ.লিপম্যানের অধীনে গণিত এবং এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যুগ্ম ডক্টরেট সম্পন্ন করেন সতীশ ধাওয়ান। ১৯৫১ সালে সতীশ ধাওয়ান ‘ইণ্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স’ (আই.আই.এস.সি)-এ সাধারণ সদস্য হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬২ সালে তিনি এই সংস্থার ডিরেক্টর পদে উন্নীত হন।

এই ইণ্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সে তিনি ভারতের প্রথম সুপারসনিক উইণ্ড টানেল স্থাপন করেন। পৃথক সীমানা স্তর প্রবাহ (Seperated Boundary Layer Flows), ত্রিমাত্রিক সীমানা স্তর ( Three Dimensional Boundary Layer) এবং ট্রাইসনিক প্রবাহ (Trisonic Flow) বিষয়ে গবেষণায় পথপ্রদর্শক ছিলেন সতীশ ধাওয়ান।

ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহের মতে সতীশ ধাওয়ান সমগ্র এশিয়াতে বৈজ্ঞানিক গবেষণার শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র হিসেবে ইণ্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সকে উন্নীত করতে পেরেছিলেন। এখানে থাকাকালীন তিনি কম্পিউটার সায়েন্স, আণবিক জৈবপদার্থবিদ্যা (Molecular Biophysics), পরিবেশবিদ্যা, মহাকাশ বিজ্ঞান ইত্যাদি নানা বিষয়ের গবেষণায় নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের উৎসাহিত করেন।

১৯৭১ সাল নাগাদ সতীশ ধাওয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স থেকে ছুটি নিয়ে কিছু গবেষণার কারণে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে গিয়েছিলেন। সেই সময়েই মাত্র ৫২ বছর বয়সে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার প্রধান বিক্রম সারাভাইয়ের অকালমৃত্যু হয়।

তাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ক্যালিফোর্নিয়ায় সতীশ ধাওয়ানকে টেলিগ্রাম করে জানান যে বিক্রম সারাভাইয়ের পরে ইণ্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন অর্থাৎ ইসরো-র চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার তাঁকে নিতে হবে। তিনি সম্মত হলেও তাঁর দুটি শর্ত ছিল। প্রথমত তিনি ইণ্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের ডিরেক্টরের পদে আসীন থাকবেন এবং দ্বিতীয়ত মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের হেডকোয়ার্টার আমেদাবাদ থেকে ব্যাঙ্গালোরে স্থানান্তরিত করা হোক।

ইন্দিরা গান্ধী দুটি শর্তেই রাজি হন। সেইমত ইসরো-র তৃতীয় চেয়ারম্যান হন সতীশ ধাওয়ান। সেসময়কার ইসরোর এক বিজ্ঞানী আরাভামুদনের মতে সতীশ ধাওয়ান একজন অত্যন্ত সম্মানীয় ব্যক্তি যার মধ্যে সূক্ষ্ম বৌদ্ধিক সততা লক্ষ করা যায়। বিক্রম সারাভাইয়ের পরে তাঁকেই চেয়ারম্যান পদে যোগ্য বলে বিবেচনা করেছেন আরাভামুদন।

ইসরো-তে থাকাকালীন সতীশ ধাওয়ান আবহাওয়ার পূর্বাভাস, প্রাকৃতিক সংস্থান ম্যাপিং এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে কৃত্রিম উপগ্রহগুলি কিভাবে সাহায্য করতে পারে, সে ব্যাপারে মনোনিবেশ করেন। এই সংস্থার হেডকোয়ার্টার দিল্লি থেকে সরিয়ে নেওয়া কিংবা নিজে কখনোই রাজ্যসভার টিকিট না গ্রহণ করার মাধ্যমে মূলত সতীশ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন এই সংস্থাটিকে।

বলা ভালো, আই.আই.এস.সি এবং ইসরো দুটি সংগঠনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে সতীশ ধাওয়ানের সুযোগ্য নেতৃত্ব অপরিসীম। এও শোনা যায় যে, শ্রীহরিকোটায় ইসরোর স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রাক্কালে এই বিশাল অঞ্চলে বসবাসকারী ইয়ানাদি উপজাতিদের বাসস্থানজনিত সমস্যাটিও সতীশ সুচারুভাবে সমাধান করে দিয়েছিলেন সাধ্যমতো।

ইসরো-র চেয়ারম্যান পদের পাশাপাশি তিনি ভারতের মহাকাশ বিভাগের সম্পাদকের পদটিও সামলেছেন দক্ষ হাতে। তাঁর নেতৃত্বেই ভারতের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘আর্যভট্ট’ মহাকাশে গিয়েছিল। সতীশ প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষি, প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং দূর-শিক্ষা (Distance Education) প্রচলনের জন্য কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবহারের প্রস্তাব দেন এবং সে বিষয়ে নিজে উদ্যোগী হয়ে গবেষণা করেন। ‘

রিমোট সেন্সিং’ এবং ‘স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন’-এর বিষয়ে কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে যোগাযোগের ব্যাপারে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। তাঁর কাজ টেলিযোগাযোগের কৃত্রিম উপগ্রহ ‘ইনস্যাট’ (INSAT)-এর উন্নতিতে সহায়ক হয়। এই ইনস্যাট হল ভারতের একমাত্র রিমোট সেন্সিং স্যাটেলাইট এবং একইসঙ্গে ‘পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল’ (Polar Satelite Launch Vehicle)। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ইসরো-র চেয়ারম্যান ছিলেন সতীশ ধাওয়ান।

ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি অন্যতম বিখ্যাত বিজ্ঞানী এ.পি.জে আব্দুল কালাম তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানিয়েছেন যে ১৯৭৯ সালে এই কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের সময় প্রথমবার ব্যর্থ হন তাঁরা। কালাম নিজে উৎক্ষেপণের দায়িত্বে ছিলেন। জ্বালানিকক্ষে ছিদ্র থাকায় উপগ্রহটি মহাকাশে না গিয়ে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষিপ্ত হয়।

কিন্তু সতীশ ধাওয়ান প্রেস বিবৃতিতে উপগ্রহ উৎক্ষেপণে কালামদের অক্ষমতাকে নিজের অক্ষমতা বলে প্রকাশ করেন। এরপর দ্বিতীয়বার ১৯৮০-তে যখন কালাম ও তাঁর দল সফল হয়, তখন আব্দুল কালামকেই এই সাফল্যের মুখপাত্র হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন সতীশ। ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি ব্যাঙ্গালোরের ‘ন্যাশনাল এরোস্পেস ল্যাবরেটরি’-র গবেষণা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে আসীন ছিলেন।

এর আগে যদিও ‘ইণ্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স’-এর সভাপতিত্ব করেছেন সতীশ ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত। নতুন প্রজন্মকে উৎসাহ দিতে এবং তরুণ প্রজন্মকে গবেষণার ক্ষেত্রে অগ্রণী করতে সতীশ সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য ‘অস্ত্র’ (ASTRA) নামের একটি সংস্থা স্থাপন করতে এ.কে.এন রেড্ডিকে তিনি অনেক সহায়তা করেন।   

সারাজীবন ধরে বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন সতীশ ধাওয়ান। ১৯৬৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে তিনি ‘ডিস্টিঙ্গুইসড অ্যালাম্‌নাস অ্যাওয়ার্ড’ (Distinguished Alumnus Award) পান। ১৯৭১ সালে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কারে সম্মানিত হন তিনি।  তারপর ১৯৮১-তে ‘পদ্মবিভূষণ’ লাভ করেন সতীশ। এছাড়াও ‘ইন্দিরা গান্ধী অ্যাওয়ার্ড ফর ন্যাশনাল ইন্টিগ্রিটি’ পেয়েছেন ১৯৯৯ সালে।

আধুনিক ভারতীয়দের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন। কারিগরি শিল্পে যেমন জে.আর.ডি টাটা, সমবায় প্রকল্পে যেমন ভার্ঘিস কুরিয়েন, তেমনই বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে সতীশ ধাওয়ানের নামও উল্লেখযোগ্য। তাঁর চরিত্রের পেশাদারিত্ব, বুদ্ধিমত্তা এবং সুষ্ঠু দায়িত্ববোধ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অবশ্য শিক্ষণীয়।

তাঁর মৃত্যুর পরে দক্ষিন ভারতে চেন্নাই থেকে ১০০ কি.মি. দূরে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটায় রকেট উৎক্ষেপন কেন্দ্রটির নাম বদলে তাঁর নামে রাখা হয় ‘সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার’। তাছাড়া তাঁর নামে রয়েছে ‘সতীশ চন্দ্র ধাওয়ান গভ: কলেজ ফর বয়েজ’। আই.আই.টি রোপার-এর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বাড়িটির নামও বদলে তাঁর নামের অনুকরণে রাখা হয় সতীশ ধাওয়ান ব্লক। ২০০২ সালের ৩ জানুয়ারি ব্যাঙ্গালোরে সতীশ ধাওয়ানের মৃত্যু হয়।