শিবচন্দ্র নন্দী এর জীবনী

প্রথম বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পদ্মা নদীর নীচ দিয়ে টেলিগ্রাফের তার পেতেছিলেন শিবচন্দ্র নন্দী (Sheeb Chunder Nandy)। তিনিই ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম ইলেক্ট্রিক্যাল ও টেলিকম অফিসার। ব্যয়সংকোচ করে প্রথম ডায়মণ্ড হারবার থেকে কলকাতার মধ্যে টেলিগ্রাফের তার বসাতে সাহায্য করেছিলেন শিবচন্দ্র নন্দী। পেশায় কলকাতার টাঁকশালের রিফাইনারি বিভাগের কেরানি ছিলেন তিনি।
সেই কাজ করতে করতেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির টেলিগ্রাফ লাইন পাতার কাজে ‘ইনচার্জ অফ দ্য ওয়ার্ক’ হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। তাঁর তত্ত্বাবধানেই পূর্ব বরাকর থেকে এলাহাবাদ, বেনারস থেকে মির্জাপুর, মির্জাপুর থেকে সিওনি এবং কলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত টেলিগ্রাফ লাইন স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। এছাড়াও শিয়ালদায় আদালতের এজলাসে অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও কাজ করেছেন শিবচন্দ্র।
তিনিই হয়ে উঠেছিলেন ব্রিটিশ ভারতের ‘টেলিগ্রাফ ম্যান’। ১৮২৪ সালের জুন মাসে ব্রিটিশ শাসিত ভারতের কলকাতায় একটি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে শিবচন্দ্র নন্দীর জন্ম হয়। ১৮৪৬ সালে ছাব্বিশ বছর বয়সে কলকাতা টাঁকশালের রিফাইনারি বিভাগে উইলিয়াম ব্রুক ও’শনেসির অধীনে কেরানির কাজের মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল শিবচন্দ্র নন্দীর কর্মজীবন।
এই উইলিয়াম ব্রুক ও’শনেসির মাধ্যমেই ভারতে প্রথম টেলিগ্রাফ লাইন বসানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। ১৮৩৫ সালে ও’শনেসি কলকাতা মেডিকেল কলেজে নিযুক্ত হয়েছিলেন রসায়ন ও মেটিরিয়া মেডিকার প্রথম অধ্যাপক হিসেবে। ১৯৩৯ সালের জুন মাসে এশিয়াটিক সোসাইটির একটি বক্তৃতাসভায় এম.এড লফ বেজিন একটি প্রবন্ধে বৈদ্যুতিক প্রবাহের সাহায্যে একস্থান থেকে আরেক স্থানে বার্তা সরবরাহ করার বিষয়ে প্রথম কথা বলেন। এই প্রবন্ধের কথা শুনে ও’শনেসি ব্যবহারিক টেলিগ্রাফি সম্বন্ধে আরেকটি প্রবন্ধ লেখেন।
বোটানিক্যাল গার্ডেনে ২১ মাইল দীর্ঘ তার খাটিয়ে একটি সীমাবদ্ধ স্থানের মধ্যে চারটি খুঁটির গায়ে বারবার তার জড়িয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন ব্রুক ও’শনেসি। তিনি সেই তারের দুই প্রান্তের মধ্যে সঙ্কেত আদান-প্রদানে সফল হন। কিন্তু এর পরেই তিনি ভারতে সামগ্রিকভাবে টেলিগ্রাফের লাইন বসাতে সফল হননি, কারণ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে এর জন্য বরাদ্দ অর্থ আসতে সময় লেগে গিয়েছিল প্রায় দশ বছর।
ও’শনেসি প্রথম পরিকল্পনা করেছিলেন কলকাতা থেকে ডায়মণ্ড হারবার পর্যন্ত টেলিগ্রাফ লাইন বসানোর। তৎকালীন বড়লাট এই ব্যাপারে উদাসীন থাকলেও তারপরে লর্ড ডালহৌসি বড়লাট হিসেবে নিযুক্ত হয়ে ও’শনেসির টেলিগ্রাফ বসানোর ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। সেই সময় ১৮৫১ সালে ও’শনেসির নেতৃত্বে ভারতের প্রথম বৈদ্যুতিক লাইনের প্রথমার্ধের কাজ শেষ হয়।
এই সময়েই ও’শনেসি সাহেব আবিষ্কার করেন শিবচন্দ্র নন্দীকে। ও’শনেসি শিবচন্দ্র নন্দীকে তাঁর সহকারী হিসেবে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। ডায়মণ্ড হারবার থেকে কলকাতা পর্যন্ত টেলিগ্রাফ লাইন বসানোর পরে তার পরীক্ষামূলক প্রদর্শনী আয়োজন করেছিলেন ব্রুক ও’শনেসি সাহেব এবং সেই প্রদর্শনীতে শিবচন্দ্র নন্দীই ছিলেন মুখ্য পরিকল্পক। ক্রমেই শিবচন্দ্র নন্দী নির্দেশকদের প্রশিক্ষিত করার কাজে ইন্সপেক্টর ইন চার্জ নিযুক্ত হন। ১৮৬৬ সালে তিনি সহকারী সুপারিনটেণ্ডেন্টের পদে উন্নীত হন।
ভারতে ইলেকট্রিক টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরেই বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ব্যবহার এবং বৈদ্যুতিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চর্চাও বেড়ে যায়। শিবচন্দ্র নন্দীর কৃতিত্বের জন্য তাঁকেই ভারতের প্রথম বাঙালি বৈদ্যুতিন প্রকৌশলী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেই সময় কলকাতায় ‘সেমাফোর যন্ত্র’-এর সাহায্যে বার্তা বা সংবাদ প্রেরণের কাজ চলত। এটি যেহেতু শৃঙ্খলের মতো ব্যবস্থায় চলত, তাই সময় লাগত অনেক এবং এর খরচও ছিল বিস্তর। এরপরে কলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত মোট ৯০০ মাইল টেলিগ্রাফ বসানোর কাজের দায়িত্বভার বর্তেছিল শিবচন্দ্র নন্দীর উপর।
এর আগে টেলিগ্রাফ বসানোর যে লোহার খুঁটি তা আনা হত সুদূর ইংল্যাণ্ড থেকে যা খুবই ব্যয়বহুল ছিল। ব্যয়সংকোচের জন্য বুদ্ধি করে শিবচন্দ্র লম্বা লম্বা তালগাছের গুঁড়িকে খুঁটি হিসেবে কাজে লাগাতে শুরু করেন। কিন্তু এই কলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত টেলিগ্রাফ বসানোর সময় মূল রোমাঞ্চকর কাজটি ছিল পদ্মা নদীর তলা দিয়ে ‘সাবমেরিন কেব্ল’ পাঠানো।
এই কাজের জন্য বেশিরভাগ স্টিমার কোম্পানিই দশ হাজার টাকা চাইছিল। ফলে সব মিলিয়ে খরচ পড়ে যাচ্ছিল অনেক। সেই সময় শিবচন্দ্র নন্দী মাছ ধরার জেলে ডিঙি ভাড়া করে উত্তাল পদ্মার জলের নীচেই সাত মাইল দীর্ঘ সাবমেরিন কেবল বসানোর কাজে সাফল্য অর্জন করেন। কাজটা খুব একটা সহজ ছিল না, তখনকার উত্তাল পদ্মায় ডিঙি নৌকায় চড়ে এই কাজ করা মানে জীবন বিপন্ন করার সামিল ছিল।
শোনা যায়, তার লাগানোর জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজতে খুঁজতে একসময় চোরাবালিতে পা ঢুকে যায় শিবচন্দ্রের, তৎক্ষণাৎ তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে টেনে তোলেন। একবার নাকি আস্ত একটা অজগর সাপের মুখে পড়ে প্রাণসংশয় ঘটেছিল তাঁর। ১৮৪৯-৫০ সাল নাগাদ তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির কোষাধ্যক্ষ হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। তাঁর তত্ত্বাবধানেই পূর্ব বরাকর থেকে এলাহাবাদ, বেনারস থেকে মির্জাপুর, মির্জাপুর থেকে সিওনি এবং কলকাতা থেকে ঢাকা পর্যন্ত টেলিগ্রাফ লাইন স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়েছিল।
এছাড়াও শিয়ালদায় আদালতের এজলাসে অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও কাজ করেছেন শিবচন্দ্র। ১৮৫৭ সালের পরে ব্রুক ও’শনেসি বিলেতে ফিরে যাওয়ার কারণে তাঁর জায়গায় কর্নেল স্টুয়ার্ট কাজে আসেন, কিন্তু তিনিও বিশেষ কারণে কাজে অনুপস্থিত ছিলেন। ফলে শিবচন্দ্র নন্দীই টেলিগ্রাফ বিভাগের দায়িত্বভার সামলান। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি তাঁর এই অবদানকে স্মরণ করেই অবসর নেওয়ার এক বছর আগেই তাঁকে ‘রায়বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯০৩ সালের ৯ এপ্রিল বিউবনিক প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে শিবচন্দ্র নন্দীর মৃত্যু হয়। ১৯০৪ সালে শিবচন্দ্র নন্দীর কৃতিত্বকে স্মরণে রেখে কলকাতার বৌবাজারের কাছে একটি রাস্তার নাম রাখা হয় শিবচন্দ্র নন্দী লেন।