মহাভারতের শকুনি মামা আজ পূজিত হন যে মন্দিরে

মহাভারতের শকুনি মামা আজ পূজিত হন  যে মন্দিরে

জগতে ভালো-মন্দ, দু’টি দিকই আছে। এক দিক না থাকলে অন্য দিকের বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট হয় না। যেমন অন্ধকার না থাকলে বোঝা যায় না, আলো কাকে বলে। তাই ভালোও যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি মন্দও। মহাভারতে তেমনই একটি মন্দ ও খল চরিত্র হলেন শকুনি। মাতুল শকুনি। অথচ, শুনলে আশ্চর্য হবেন, এ হেন খলনায়ককে দেবতারূপে পুজো করা হয় দক্ষিণ ভারতে। কেরালার কোল্লাম জেলার মায়ামকোট্টুর পবিত্রেশ্বরমে মামা শকুনির মন্দির আছে। এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ করেন কুরুবার সম্প্রদায়।

জনশ্রুতি, তাঁরা নাকি কৌরবদের বংশধর। এই পবিত্রেশ্বরম হল সেই স্থান যেখানে কৌরবদের মধ্যে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে অস্ত্র ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। ভক্তরা নিয়মিত শকুনিকে পুজো করেন। নারকেল ও রেশমের টুকরো ও তাড়ি দিয়ে পুজো করা হয় তাঁর। উল্লেখ্য, এই মন্দিরের কাছাকাছি রয়েছে দুর্যোধনের মন্দিরও।  এখানে শকুনির কোন মূর্তি বা প্রতিকৃতিতে পুজো হয়না, পুজো হয় একটি মুকুটের। স্থানীয় লোকবিশ্বাস মতে এই মুকুটটি ছিল গান্ধার রাজ শকুনির।

মহাভারতের কাহিনী থেকে জানা যায়, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরুর আগে মামা শকুনি কৌরব ভাগ্নদের নিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষ পরিক্রমণ করেছিলেন। কেরালার কোল্লামের এই স্থানে এসে শকুনি মামা শিবের পূজা করে বর লাভ করেছিলেন। এরই প্রেক্ষিতে এই স্থানে শকুনির মন্দির গড়ে ওঠে। শকুনি মামা মহাভারতের কুটিলতম চরিত্র শকুনি। তিনি ভালো করে জানতেন দুর্যোধনসহ অন্যান্য কৌরবরা পাণ্ডবদের সাথে কখনো জয়ী হতে পারবেন না। তবু তিনি কৌরবদের এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দিকে ধাবিত করেছিলেন। শকুনি ও তার পরিবারের প্রতি হওয়া অবিচারের প্রতিশোধ নিতেই তিনি এই কুট কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। শকুনি না থাকলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধই হতোনা।   

শকুনিকে যতটা শঠ এবং মন্দ চরিত্রের মানুষ বলে মহাভারতে দেখানো হোক না কেন, তিনি তাঁর নিজের কাজের প্রতি ছিলেন সৎ এবং প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। শেষদিন পর্যন্ত তিনি তাঁর এই প্রতিজ্ঞাতেই অটল ছিলেন। এটা তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তার কথাই বলে। বল নয়, কৌশল ছিল তাঁর হাতিয়ার। তিনি নিজে কখনও রাজ্যসুখ ভোগ করেননি। এটাও একটা ত্যাগ বলে মানতেই হয়। অপমানের প্রতিশোধ নেওয়া ছাড়া আর কোনও কিছুর দিকে শকুনি কখনও তাকাননি।

অথচ দুর্যোধনের সৌজন্যে অশেষ ধনদৌলত নিয়ে ভোগীর জীবন কাটানোর সুযোগ ছিল তাঁর। কিন্তু তিনি হেলায় ত্যাগ করেছেন তা, কাজই ছিল তাঁর একমাত্র উপাস্য। কর্মফল, বা কাজের প্রতিদানে কী পাবেন, সে কথা না ভেবেই। তাঁর বোন গান্ধারী ছিলেন কৃষ্ণভক্ত। শকুনি নিজে ছিলেন শিবসাধক। তাঁর চরিত্রের ‘মন্দ’ দিকগুলি যেমন ছিল, তেমনই ছিল রাজসিক কিছু গুণও।



শকুনির সেই দৃঢ়তা, কর্মপ্রেম আর ‘ত্যাগ’-কে সম্মান জানান কুরুবার সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁদের বিশ্বাস, শকুনি স্বয়ং দ্বাপর যুগের প্রতীক। আর দুর্যোধন হলেন কলি যুগেও। ভারতের ইতিহাসেও শকুনির উল্লেখ আছে। গান্ধারের রাজা অম্ভিকুমার ছিলেন রামায়ণের ভরত এবং মহাভারতের শকুনির বংশধর। তক্ষশীলায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময়াময়িক ছিলেন অম্ভি। আলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমণ করেন তখন তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে রাজা অম্ভি পরাজিত হন ও আলেকজান্ডারের বশ্যতা স্বীকার করে নেন।


ভক্তরা মনে করেন, শকুনি না থাকলে যেমন কুরুবংশ ধ্বংস হত না, তেমন শকুনি না থাকলে পাণ্ডবদেরও জয় হত না। শকুনি না থাকলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধই হত না। বস্তুত শকুনি না থাকলে ভগবদ্গীতারও সৃষ্টি হত না। সবচেয়ে বড় কথা, শকুনি না থাকলে মহাভারতই থাকত না।আসলে, পাণ্ডবদের প্রতি তো কোনও অসূয়াই ছিল না শকুনির। তাঁর সব ক্রোধই ছিল ভীষ্মের প্রতি। একজন অন্ধ মানুষকে তাঁর বোন বিয়ে করবেন, এটা শকুনি ভাবতেও পারেননি। বিবাহবাসর থেকে গান্ধারীকে তুলে নিয়ে আসতেই, তাঁর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে ভীষ্মের ওপর। তখনই শকুনি প্রতিজ্ঞা করলেন, কুরুবংশ ধ্বংস করবেন তিনি।