সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়

রাজনীতি, কূটনীতি, প্রশাসন, ক্রীড়াঙ্গন, এমনকি বংশগৌরব—সব ক্ষেত্রেই তাঁর ওজন ও প্রভাব তাঁকে স্বাতন্ত্র্যে বিশিষ্ট পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, স্বনামধন্য আইনজীবি এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় Siddhartha Shankar Roy। ১৯২০ সালের ২০ অক্টোবর কলকাতার এক অভিজাত পরিবারে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জন্ম হয়। তাঁর ডাক নাম ছিল মানু। কলকাতার এক অভিজাত পরিবারে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জন্ম হয়।
তাঁর বাবা সুধীর কুমার রায় ছিলেন কলকাতা উচ্চ আদালতের একজন নামকরা ব্যারিস্টার এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন সদস্য। তাঁর মা অপর্ণা দেবী ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের বোন কলকাতা উচ্চ আদালতের প্রথম মহিলা বিচারপতি জাস্টিস মঞ্জুমালা বসু। ভারতের প্রাক্তন মুখ্য বিচারপতি সুধীরঞ্জন দাশ এবং ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের আইন-সদস্য সতীশ রঞ্জন দাশ ছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আত্মীয়স্থানীয়।
সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের স্ত্রীয়ের নাম মায়া রায়। কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনের ভবানীপুর শাখায় প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ করেছেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ল’ কলেজেও পড়াশোনা করেন তিনি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সক্রিয়ভাবে খেলাধুলো আর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। ১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ইন্সটিটিউট নির্বাচনে ছাত্র-সম্পাদক নির্বাচিত হন সিদ্ধার্থশঙ্কর।
তাঁর হাতেই সময়ে সময়ে ছাত্রদের পঠন-সহায়ক তহবিল, বিতর্কসভা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং সোশ্যাল আয়োজনের ভার ন্যস্ত হয়। একইসঙ্গে তিনি বিতর্কসভার সম্পাদকও ছিলেন। পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ কলেজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। খেলাধুলোর জগতে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালীন সেই কলেজের ক্রিকেট দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।১৯৪৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের যে দল আন্তঃকলেজ ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপে জয়লাভ করে, সেই দলের নেতৃত্ব দেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়।
পরপর তিনটি মরশুম মিলিয়ে মোট তিনটি ডবল সেঞ্চুরি এবং ১০০০ রান করেন তিনি। তাছাড়া কালীঘাট ক্লাবের হয়ে ফুটবলও খেলেছেন তিনি। ১৯৩৯ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ ফুটবল দলের অধিনায়কত্ব করেছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এবং সেই দলটিই এলিয়ট ও হার্ডিঞ্জ জন্মবার্ষিকী শিল্ড জয় করে। লন টেনিস ও টেবিল টেনিস খেলাতেও তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজে পড়া শেষ করে বিলেতে ইনার টেম্পলে ব্যারিস্টার। সিদ্ধার্থশঙ্করের জীবনপথের ভিত গড়ে উঠেছিল এই ভাবে।
পরবর্তীকালে ১৯৪৭ সালে লণ্ডনের ইনার টেম্পল-এর সম্মানীয় সোসাইটির তরফ থেকে তাঁকে বার কাউন্সিলে আহ্বান জানানো হয়। লণ্ডনে থাকাকালীন ইণ্ডিয়ান জিমখানা ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট ম্যাচে অংশ নেন তিনি। ইংল্যাণ্ড থেকে ফেরার পরে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় বিচারপতি রামপ্রসাদ মুখার্জীর অধীনস্থ জুনিয়র হিসেবে কলকাতা বারে যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে কলকাতায় তিনজন জুনিয়র সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট কাউন্সেলের মধ্যে অন্যতম একজন হয়ে ওঠেন তিনি।
১৯৫৭ সালে ভবানীপুর বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন তিনি।১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হিসেবেও কর্মরত ছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। তাছাড়া পাঞ্জাবের রাজ্যপালের পদেও তিনি বেশ কিছুদিন কর্মরত ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল খুবই মধুর। মনে করা হয়, তাঁরই পরামর্শে পশ্চিমবঙ্গে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।
একসময় কংগ্রেসের ভিতরেও মতানৈক্য চরমে ওঠায় দল ছেড়ে নবকংগ্রেস তৈরি করেন তিনি। এক বলিষ্ঠ, সাহসী ও নির্ভীক এবং একইসঙ্গে এক বিতর্কিত প্রশাসক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয়। ডা. বিধান রায়ের নেতৃত্বে গঠিত পশ্চিমবঙ্গের ক্যাবিনেটের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন তিনিই। পশ্চিমবঙ্গের উপজাতি উন্নয়ন এবং আইন বিভাগের মন্ত্রী নির্বাচিত হন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। ১৯৬২ সালে স্বাধীন ক্যান্ডিডেট হিসেবে রাজ্য বিধানসভায় তিনি পুনর্নির্বাচিত হন।
১৯৬৬ সালে ইউনিয়ন ক্যাবিনেট অফ এডুকেশন এবং ইয়ুথ সার্ভিসেস বিভাগে মন্ত্রীত্বের পদে অভিষিক্ত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৭১ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় সংসদের সদস্য ছিলেন।১৯৭২ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নির্বাচনে জয়লাভ করার পরে ১৯৭২ সালের ৯ মার্চ তারিখ থেকে পশ্চিমবঙ্গের ষষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রীর পদে অভিষেক ঘটে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের। ১৯৭৭ সালের ২১ জুন তারিখ পর্যন্ত তিনি এই পদে আসীন ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরেই তিনি মুখ্যমন্ত্রীর পদে কাজ শুরু করেন।
একদিকে নকশাল আন্দোলনের প্রতিঘাত আর অন্যদিকে অজস্র শরণার্থীর ভিড় সামলাতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে উদ্বাস্তু সমস্যা এক বিরাট আকার ধারণ করে এবং সেই সময় লক্ষাধিক শরণার্থীর পুনর্বাসনের ব্যবস্থায় তিনি বেশ উদ্যোগী ছিলেন। তাঁর সময়কালেই ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয় সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে। তিনিই ইন্দিরা গান্ধীকে জরুরি অবস্থার পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়।
মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকাকালীন তাঁর সবথেকে বড়ো দুটি কাজের মধ্যে প্রথমটি শরণার্থীদের পুনর্বাসন সমস্যা নিরসন এবং দ্বিতীয়টি হল কলকাতায় মেট্রো রেলের পরিষেবা চালু করা। ১৯৭০ সালের নকশাল আন্দোলন দমনে তাঁর নির্মম ভূমিকা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আজও বিতর্ক ছড়িয়ে আছে। তাঁর আমলেই সংঘটিত হয়েছিল কুখ্যাত বরানগর গণহত্যা। নকশাল আন্দোলনের নামে যে হত্যার রাজনীতি ছড়িয়ে পড়েছিল পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে তার কট্টর নিন্দা করতেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়।
রাজনীতির পাশাপাশি ক্রিকেটের প্রশাসনিক পদে অর্থাৎ সিএবি-র সভাপতি পদেও কর্মরত ছিলেন তিনি ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত পাঞ্জাবের ২২তম রাজ্যপালের পদে আসীন থাকার সময় খালিস্তানি সন্ত্রাসবাদী হামলা মোকাবিলা করেছেন তিনি দক্ষ হাতে। ১৯৯১ সালে পুনরায় দিল্লিতে কংগ্রেস নির্বাচনে জিতলে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠানো হয়। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদেই কর্মরত ছিলেন।
তার আগে ১৯৯১ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা হন। মন্ত্রীসভার কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে সন্দেহবশে দুর্নীতির তদন্ত করার জন্য বিচারপতি ওয়াংচুর নেতৃত্বে তিনি গড়ে তোলেন একটি কমিশন যা কংগ্রেস দলের মধ্যেই একটি পারস্পরিক মতবিরোধের জন্ম দেয়। ১৯৬৯ সালে কংগ্রেসের সমর্থনে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা থেকে বিধান পরিষদের অবলুপ্তিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি।
তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পশ্চিমবঙ্গে বাম-বিরোধী জনমত গড়ে তোলার শক্ত হাতিয়ার মনে করতেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় আর তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি অকুণ্ঠ স্নেহ ছিল তাঁর মনে। পশ্চিমবঙ্গের আরেক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে তাঁর একাধারে পারস্পরিক সখ্যতার এবং রাজনৈতিক বিবাদেরও সম্পর্ক ছিল। কট্টর বামবিরোধী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় জ্যোতি বসুর নানা পদক্ষেপ বিষয়ে তীব্র কটাক্ষ করতে ভুলতেন না। জরুরি অবস্থার সময়ে পশ্চিমবঙ্গে এক স্বৈরতন্ত্রী শাসন চালানোর অপবাদের কালিমা তাঁর গায়ে লেগেছিল।
সরকারবিরোধী কোনোরকম বক্তব্য প্রকাশের জন্য সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এবং সেই জরুরি অবস্থার সময়ে তাঁরই নির্দেশে গৌরকিশোর ঘোষ, বরুণ সেনগুপ্তদের মতো বিখ্যাত সম্পাদক ও সাংবাদিককে অন্তরীন করা হয়। জরুরি অবস্থার সময়ে তাঁর আচরণ এতটাই উদ্ধত হয়েছিল যে শোনা যায় , মহাকরণে তাঁর ঘরে ডেকে টেবিলের উপর পা তুলে ফল খেতে খেতে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে বলতেন। কটা চালু ধারণা আছে, ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারির জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী তখনকার রাষ্ট্রপতি সঞ্জীব রেড্ডিকে যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, তার খসড়া সিদ্ধার্থবাবুর তৈরি।
শুধু তা-ই নয়, ইন্দিরাকে তিনিই নাকি পরামর্শ দিয়েছিলেন ওই পদক্ষেপ করার। এর তথ্যভিত্তিক প্রমাণ কত দূর কী আছে, জানি না। যদিও সাংবাদিক কুমি কপূরের ‘দি ইমার্জেন্সি’ বইতে সিদ্ধার্থবাবুর হাতে লেখা একটি নোটের উল্লেখ আছে। যেখানে ইন্দিরাকে তিনি ‘পরিকল্পনা’ দ্রুত কার্যকর করার পরামর্শ দিয়ে করণীয় ব্যাখ্যা করেছেন। আর নোটটি লেখা হয়েছে জরুরি অবস্থা জারির মাস ছয়েক আগেই। তবে ইন্দিরা গাঁধী অন্য কারও কথায় এত বড় একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাত্রী ছিলেন বলে, ওয়াকিবহাল অনেকেই মনে করেন না।
পরবর্তী কালে এই সংক্রান্ত প্রশ্নে সিদ্ধার্থশঙ্করের কাছেও কোনও দিন খুব স্পষ্ট জবাব মেলেনি। ফলে বোঝা- না-বোঝার ফাঁকে সেই কলঙ্কের দাগটি তাঁর নামের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে। আবার সাতাত্তরের ভোটে ইন্দিরার নেতৃত্বে কংগ্রেস পর্যুদস্ত হওয়ার পরে দলে অনিবার্য ভাঙনের সময় সিদ্ধার্থ রায় ‘গা বাঁচাতে’ ইন্দিরার বিরুদ্ধে সভাপতি পদে প্রার্থী হয়েছিলেন কি না, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। সঞ্জয় গাঁধীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভাল ছিল না। পরবর্তী কালে সঞ্জয়কে তিনি জরুরি অবস্থার বাড়াবাড়ির জন্য দায়ীও করেছিলেন।
কিন্তু যে কথা আগেই বলেছি, জরুরি অবস্থার সময়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সিদ্ধার্থশঙ্করও তো কিছু কম বাড়াবাড়ি করেননি। তাই তিনি দমনমূলক জরুরি অবস্থার পক্ষে ছিলেন, এটাই যুক্তিগ্রাহ্য। নকশাল-দমনের ক্ষেত্রেও তাঁর মনোভাব ছিল আপসহীন। এ সবের বাইরে অবশ্য আর একজন সিদ্ধার্থশঙ্কর আছেন, যিনি চরম বন্ধু-বৎসল, পরম স্নেহশীল, আন্তরিক, মজলিশি, রুচিসম্পন্ন, অভিজাত এক ব্যক্তি, যাঁর কাছে ইতিহাসের অনেক অধ্যায় ছিল বাঙ্ময়। তাঁর ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি চেহারার সামনে অনেক কিছুই আক্ষরিক অর্থে ছোট মনে হত! নিজের বর্ণময় ব্যক্তিত্বের উচ্চতা দিয়ে তিনিও প্রতি মুহূর্তে সেটা বুঝিয়ে দিতেন, তা সে ক্ষমতায় না থেকেও।
লেজে পড়ার সময় থেকেই নানা যোগ্যতার প্রকাশ দেখা গিয়েছিল তাঁর মধ্যে। খেলার মাঠ, বিতর্কসভা, ছাত্র ইউনিয়ন সবেতেই সিদ্ধার্থশঙ্কর ছিলেন অগ্রণী ভূমিকায়। কলেজের ক্রিকেট টিমে তিনিই ছিলেন ‘তারকা’। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে খেলায় তিনি ছিলেন ‘ইউনিভার্সিটি ব্লু।’ ফুটবল খেলেছেন কালীঘাট ক্লাবে। আর টেনিস, ব্যাডমিন্টন খেলার অভ্যেস ধরে রেখেছিলেন সত্তর-আশি বছর বয়সেও। তাঁদের বেলতলা রোডের বাড়ির লনে শীতের সন্ধেয় খেলতে দেখেছি তাঁকে। মজা করে বলতেন, ‘‘তোমরা আমাকে যতই গালি দাও, আমি আসলে জেন্টল্ম্যান। কারণ আ স্পোর্টসম্যান ইজ় অলওয়েজ় আ জেন্টল্ম্যান!’’ লন্ডন থেকে ব্যারিস্টার হয়ে সিদ্ধার্থশঙ্কর দেশে ফেরেন ১৯৪৬-এ।
বয়স তখন ছাব্বিশ। জ্যোতিবাবু যেমন রাজনীতি করতেই দেশে ফিরেছিলেন, সিদ্ধার্থবাবুর ক্ষেত্রে তা নয়। প্রথম বছর দশেক ওকালতিই ছিল তাঁর একমাত্র কাজ। প্রথম নির্বাচনে লড়েন ১৯৫৭ সালে। জিতে বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রিসভায় আইন ও আদিবাসী উন্নয়ন দফতরের দায়িত্ব পান। ১৯৬২-তে পরবর্তী নির্বাচনেও জয়ী হন। তবে সে বার কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব হয়ে গিয়েছিল তাঁর। জেতেন নির্দল হিসেবে। সিদ্ধার্থশঙ্করের পুরনো বন্ধু ইন্দিরা গাঁধী তাঁকে ১৯৬৭-তে কেন্দ্রে নিয়ে যান শিক্ষামন্ত্রী করে।
এই পর্বেই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হল, রাজনৈতিক টালমাটালের পশ্চিমবঙ্গে, তাঁর হাতে এ রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পণ। অন্তত এক বছর সেই দায়িত্ব পালনের সুবাদে সিদ্ধার্থশঙ্কর রাজ্যে নিজের ‘ক্ষমতা’ কায়েম করার রাস্তা সুগম করতে কসুর করেননি। নকশাল আন্দোলন, খুনের রাজনীতি তখন রীতিমতো ত্রাস ছড়িয়েছে। জনজীবন সন্ত্রস্ত। তখনই ঘটে বরাহনগর গণহত্যার মতো কলঙ্কিত ঘটনাও। এর পরে ১৯৭২ সালে ভোট হল বাংলায়। ব্যাপক রিগিংয়ের অভিযোগ তুলে জ্যোতি বসু-সহ বামেরা ভোট চলাকালীন সরে দাঁড়ালেন।
কংগ্রেস বিপুল ভোটে জিতে সরকার গড়ল। সিদ্ধার্থ রায় এ বার মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রিত্বের পাঁচ বছর সিদ্ধার্থ রায় রাজ্যের উন্নয়নে বিশেষ কিছু করেননি। হয়তো সেই উদ্যোগও তাঁর ছিল না। তাঁর কার্যকালের অনেকটাই কেটেছে নকশাল-মোকাবিলা এবং জরুরি অবস্থা নিয়ে। নকশাল আন্দোলনকে ‘মুক্তির পথ’ বলে বিশ্বাস করে যাঁরা তাতে শামিল হয়েছিলেন, তাঁদের একটি বড় অংশ কৃতী, মেধাবী ছাত্রদল। তাঁদের মতাদর্শের ঠিক-ভুল বা বিচ্যুতি নিয়ে বিশ্লেষণের পরিসর এটা নয়।
তবে নকশাল আন্দোলনের নামে প্রাণঘাতী পরিস্থিতি যে সুস্থ সমাজের পরিপন্থী হয়ে উঠেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর তাকে দমন করতে পেরেছিলেন। কারণ এ কাজে রাষ্ট্রশক্তি অর্থাৎ পুলিশ ছিল তাঁর প্রধানতম হাতিয়ার। তাতে বাড়াবাড়ি অবশ্যই হয়েছিল। ছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার উগ্র চেষ্টাও। সেই বিতর্ক আজও সজীব। কিন্তু তাঁর প্রশাসনিক দৃঢ়তায় রক্তস্রোত যে বন্ধ হয়েছিল, এটাও অস্বীকার করার নয়। দেড় দশক পরে পঞ্জাবে রাজ্যপাল হয়ে সিদ্ধার্থশঙ্কর সেখানকার তৎকালীন পুলিশ কর্তাকে দিয়ে উগ্রপন্থী খলিস্তানিদের দমন করেছিলেন। তখনও পশ্চিমবঙ্গের নকশাল-অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই তাঁর কাজে সহায়ক হয়।
যদিও তিনি নিজে প্রকাশ্য এ কথা মানতেন না। বরং বলতেন, নকশাল এবং খলিস্তানিদের মধ্যে কোনও তুলনাই চলে না। দুই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, লক্ষ্য ও প্রতিরোধের ধরন সম্পূর্ণ আলাদা। কলকাতার অধুনালুপ্ত চৌরঙ্গি কেন্দ্র থেকে উপনির্বাচনে জিতে বিধানসভায় বিরোধী নেতা হন সিদ্ধার্থবাবু। আর মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। পরিষদীয় রাজনীতির সে এক চমকপ্রদ অধ্যায়। রীতিমতো হোমওয়র্ক করে তথ্যপঞ্জি হাতে নিয়ে শাণিত বক্তৃতা করতেন সিদ্ধার্থশঙ্কর। যা বলতেন, যে সব পরিসংখ্যান পেশ করতেন, তার সব গুছিয়ে তুলে দেওয়া হত সাংবাদিকদের হাতে।
তার চেয়েও বড় কথা, সিদ্ধার্থ রায়ের বক্তৃতার সময়ে সারাক্ষণ সভাকক্ষে বসে থাকতেন জ্যোতিবাবু। মাঝে মাঝেই জমে উঠত চাপানউতোর। আসলে তাঁদের দু’জনের বন্ধুত্ব চল্লিশের দশকের শেষ থেকে। স্মৃতির অফুরান ভাণ্ডার হাতড়ে টুকরো টুকরো মণিমাণিক্য ছড়িয়ে দিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর। কখনও আবেগ, কখনও বুদ্ধিদীপ্ত কটাক্ষের মিশেলে সেগুলি প্রাণবন্ত হয়ে উঠত। যেমন, রাজ্যের শিক্ষানীতি নিয়ে বলার সময়ে সিদ্ধার্থবাবু সরকারি চাকুরেদের ‘সরকারি চাকর’ বলায় প্রতিবাদ করেন জ্যোতিবাবু।
তিনি বলেন, শব্দটি অপমানজনক। মুচকি হেসে সিদ্ধার্থশঙ্কর স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিমের উদ্দেশে জানতে চান, ‘‘গভর্নমেন্ট সারভেন্ট কথাটি নিশ্চয় গ্রহণযোগ্য? অভিধানে সারভেন্ট শব্দের বাংলা অনুবাদে চাকর শব্দটি আছে। জ্যোতি তো ইংরেজি শিক্ষাটাই তুলে দিয়েছে। তা হলে বাংলা বলতে আপত্তি হবে কেন?’’ সরকারপক্ষ চুপ। মনে আছে, রাজনৈতিক আক্রমণ করতে গিয়ে সিদ্ধার্থবাবুকে একবার ‘ট্রেটর’ বলেছিলেন জ্যোতিবাবু। কথা কেড়ে নিয়ে সিদ্ধার্থবাবু উদাহরণ টেনে বলতে শুরু করলেন।
যার মোদ্দা কথা ছিল, তাঁকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলার আগে জ্যোতিবাবুর ভেবে দেখা উচিত, তাঁর জন্য এই সিদ্ধার্থশঙ্কর কী কী করেছেন! রাজীবের মৃত্যুর পরে নরসিংহ রাও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই ফের রাজনীতি থেকে সরে যেতে হয় সিদ্ধার্থশঙ্করকে। এ বার তিনি আমেরিকায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত। ১৯৯৬ পর্যন্ত প্রায় চার বছর আমেরিকায় কাটিয়ে দেশে ফিরলেও প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে তাঁর দূরত্ব থেকেই যায়। তার আগেই অবশ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তাঁর।
বিধানসভায় বিরোধী নেতা থাকাকালীন রাজ্যে মমতার সিপিএম-বিরোধী ভূমিকার তিনি ছিলেন অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। এমনকি, ১৯৯২ সালে কংগ্রেসের সাংগঠনিক নির্বাচনে সোমেন মিত্রের কাছে মমতার পরাজয় তিনি মানতে পারেননি। সিদ্ধার্থবাবু বিশ্বাস করতেন, মমতাই রাজ্যে বাম-শাসনের অবসান ঘটাতে পারবেন। একবার গড়িয়াহাটে মমতার একটি আন্দোলনে পুলিশ মারমুখী হল। মমতার সঙ্গে ছিলেন সিদ্ধার্থবাবুও। কিছুটা দেরিতে শুরু হলেও আমৃত্যু মমতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তাঁর।
যদিও তৃণমূলের ক্ষমতা লাভ সিদ্ধার্থশঙ্কর দেখে যেতে পারেননি। তবে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম আন্দোলন দেখেছিলেন। ২০০৮-এর পঞ্চায়েত এবং ২০০৯-এর লোকসভা ভোটে তৃণমূলের অগ্রগতি দেখে মমতা যে মহাকরণের দিকে এগিয়ে চলেছেন, সেটা তিনি বুঝে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর মাসখানেক আগে রোটারি সদনে মোহনবাগান ক্লাবের একদা প্রাণপুরুষ ধীরেন দে-র শতবার্ষিকী সভায় যোগ দিতে গিয়ে মঞ্চের উপর থেকে সটান নীচে পড়ে গিয়েছিলেন দীর্ঘদেহী মানুষটি।
সভাকক্ষের সবাই সমূহ বিপদের আশঙ্কায় আঁতকে উঠেছিলেন। সকলকে আশ্বস্ত করে সিদ্ধার্থশঙ্কর মুহূর্তে উঠে দাঁড়ালেন। তার পরে মঞ্চে মাইক ধরে বক্তৃতায় বললেন, ‘‘বিলেতে সাহেবদের কাছে ঘোড়ায় চড়া শিখেছিলাম। ওঁরা বলতেন, পড়তে না জানলে কিন্তু চড়তে পারবে না। পতন শেখাটা তাই খুব জরুরি।’’ ২০১০ সালের ৬ নভেম্বর ৯০ বছর বয়সে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মৃত্যু হয়।