সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এর জীবনী

সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এর জীবনী

পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, স্বনামধন্য আইনজীবি এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ হলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় (Siddhartha Shankar Roy)। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ইউনিয়ন মিনিস্টার অফ এডুকেশন পদে এবং ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হিসেবেও কর্মরত ছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। তাছাড়া পাঞ্জাবের রাজ্যপালের পদেও তিনি বেশ কিছুদিন কর্মরত ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল খুবই মধুর। মনে করা হয়, তাঁরই পরামর্শে পশ্চিমবঙ্গে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।

একসময় কংগ্রেসের ভিতরেও মতানৈক্য চরমে ওঠায় দল ছেড়ে নবকংগ্রেস তৈরি করেন তিনি। এক বলিষ্ঠ, সাহসী ও নির্ভীক এবং একইসঙ্গে এক বিতর্কিত প্রশাসক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয়। ১৯২০ সালের ২০ অক্টোবর কলকাতার এক অভিজাত পরিবারে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জন্ম হয়। তাঁর ডাক নাম ছিল মানু। তাঁর বাবা সুধীর কুমার রায় কলকাতা উচ্চ আদালতের একজন নামকরা ব্যারিস্টার এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন সদস্য ছিলেন।

তাঁর মা অপর্ণা দেবী ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবীর জ্যেষ্ঠা কন্যা। বিলেতেই বড়ো হয়ে হয়েছেন অপর্ণা দেবী। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের বোন কলকাতা উচ্চ আদালতের প্রথম মহিলা বিচারপতি জাস্টিস মঞ্জুমালা বসু। ভারতের প্রাক্তন মুখ্য বিচারপতি সুধীরঞ্জন দাশ এবং ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের আইন-সদস্য সতীশ রঞ্জন দাশ ছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আত্মীয়স্থানীয়।

তাঁর স্ত্রীয়ের নাম মায়া রায়। কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনের ভবানীপুর শাখায় প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ করেছেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ল’ কলেজেও পড়াশোনা করেন তিনি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সক্রিয়ভাবে খেলাধুলো আর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি।

১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ইন্সটিটিউট নির্বাচনে ছাত্র-সম্পাদক নির্বাচিত হন সিদ্ধার্থশঙ্কর। তাঁর হাতেই সময়ে সময়ে ছাত্রদের পঠন-সহায়ক তহবিল, বিতর্কসভা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং সোশ্যাল আয়োজনের ভার ন্যস্ত হয়। একইসঙ্গে তিনি বিতর্কসভার সম্পাদকও ছিলেন। পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ কলেজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়।

খেলাধুলোর জগতে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালীন সেই কলেজের ক্রিকেট দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের যে দল আন্তঃকলেজ ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপে জয়লাভ করে, সেই দলের নেতৃত্ব দেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। পরপর তিনটি মরশুম মিলিয়ে মোট তিনটি ডবল সেঞ্চুরি এবং ১০০০ রান করেন তিনি। তাছাড়া কালীঘাট ক্লাবের হয়ে ফুটবলও খেলেছেন তিনি।

১৯৩৯ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ ফুটবল দলের অধিনায়কত্ব করেছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এবং সেই দলটিই এলিয়ট ও হার্ডিঞ্জ জন্মবার্ষিকী শিল্ড জয় করে। লন টেনিস ও টেবিল টেনিস খেলাতেও তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল। পরবর্তীকালে ১৯৪৭ সালে লণ্ডনের ইনার টেম্পল-এর সম্মানীয় সোসাইটির তরফ থেকে তাঁকে বার কাউন্সিলে আহ্বান জানানো হয়।

লণ্ডনে থাকাকালীন ইণ্ডিয়ান জিমখানা ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট ম্যাচে অংশ নেন তিনি। ইংল্যাণ্ড থেকে ফেরার পরে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় বিচারপতি রামপ্রসাদ মুখার্জীর অধীনস্থ জুনিয়র হিসেবে কলকাতা বারে যোগ দেন। ১৯৫৪ সালে কলকাতায় তিনজন জুনিয়র সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট কাউন্সেলের মধ্যে অন্যতম একজন হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৫৭ সালে ভবানীপুর বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন তিনি।

ডা. বিধান রায়ের নেতৃত্বে গঠিত পশ্চিমবঙ্গের ক্যাবিনেটের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন তিনিই। পশ্চিমবঙ্গের উপজাতি উন্নয়ন এবং আইন বিভাগের মন্ত্রী নির্বাচিত হন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। ১৯৬২ সালে স্বাধীন ক্যান্ডিডেট হিসেবে রাজ্য বিধানসভায় তিনি পুনর্নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে ইউনিয়ন ক্যাবিনেট অফ এডুকেশন এবং ইয়ুথ সার্ভিসেস বিভাগে মন্ত্রীত্বের পদে অভিষিক্ত হয়েছিলেন তিনি।

১৯৭১ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় সংসদের সদস্য ছিলেন। ১৯৭২ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নির্বাচনে জয়লাভ করার পরে ১৯৭২ সালের ৯ মার্চ তারিখ থেকে পশ্চিমবঙ্গের ষষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রীর পদে অভিষেক ঘটে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের। ১৯৭৭ সালের ২১ জুন তারিখ পর্যন্ত তিনি এই পদে আসীন ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরেই তিনি মুখ্যমন্ত্রীর পদে কাজ শুরু করেন।

একদিকে নকশাল আন্দোলনের প্রতিঘাত আর অন্যদিকে অজস্র শরণার্থীর ভিড় সামলাতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে উদ্বাস্তু সমস্যা এক বিরাট আকার ধারণ করে এবং সেই সময় লক্ষাধিক শরণার্থীর পুনর্বাসনের ব্যবস্থায় তিনি বেশ উদ্যোগী ছিলেন। তাঁর সময়কালেই ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয় সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে।

তিনিই ইন্দিরা গান্ধীকে জরুরি অবস্থার পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকাকালীন তাঁর সবথেকে বড়ো দুটি কাজের মধ্যে প্রথমটি শরণার্থীদের পুনর্বাসন সমস্যা নিরসন এবং দ্বিতীয়টি হল কলকাতায় মেট্রো রেলের পরিষেবা চালু করা। ১৯৭০ সালের নকশাল আন্দোলন দমনে তাঁর নির্মম ভূমিকা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আজও বিতর্ক ছড়িয়ে আছে। তাঁর আমলেই সংঘটিত হয়েছিল কুখ্যাত বরানগর গণহত্যা। নকশাল আন্দোলনের নামে যে হত্যার রাজনীতি ছড়িয়ে পড়েছিল পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে তার কট্টর নিন্দা করতেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়।

রাজনীতির পাশাপাশি ক্রিকেটের প্রশাসনিক পদে অর্থাৎ সিএবি-র সভাপতি পদেও কর্মরত ছিলেন তিনি ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত পাঞ্জাবের ২২তম রাজ্যপালের পদে আসীন থাকার সময় খালিস্তানি সন্ত্রাসবাদী হামলা মোকাবিলা করেছেন তিনি দক্ষ হাতে। ১৯৯১ সালে পুনরায় দিল্লিতে কংগ্রেস নির্বাচনে জিতলে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠানো হয়। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদেই কর্মরত ছিলেন।

তার আগে ১৯৯১ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা হন। মন্ত্রীসভার কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে সন্দেহবশে দুর্নীতির তদন্ত করার জন্য বিচারপতি ওয়াংচুর নেতৃত্বে তিনি গড়ে তোলেন একটি কমিশন যা কংগ্রেস দলের মধ্যেই একটি পারস্পরিক মতবিরোধের জন্ম দেয়। ১৯৬৯ সালে কংগ্রেসের সমর্থনে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা থেকে বিধান পরিষদের অবলুপ্তিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি।

তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পশ্চিমবঙ্গে বাম-বিরোধী জনমত গড়ে তোলার শক্ত হাতিয়ার মনে করতেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় আর তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি অকুণ্ঠ স্নেহ ছিল তাঁর মনে। পশ্চিমবঙ্গের আরেক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে তাঁর একাধারে পারস্পরিক সখ্যতার এবং রাজনৈতিক বিবাদেরও সম্পর্ক ছিল। কট্টর বামবিরোধী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় জ্যোতি বসুর নানা পদক্ষেপ বিষয়ে তীব্র কটাক্ষ করতে ভুলতেন না।

জরুরি অবস্থার সময়ে পশ্চিমবঙ্গে এক স্বৈরতন্ত্রী শাসন চালানোর অপবাদের কালিমা তাঁর গায়ে লেগেছিল। সরকারবিরোধী কোনোরকম বক্তব্য প্রকাশের জন্য সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এবং সেই জরুরি অবস্থার সময়ে তাঁরই নির্দেশে গৌরকিশোর ঘোষ, বরুণ সেনগুপ্তদের মতো বিখ্যাত সম্পাদক ও সাংবাদিককে অন্তরীন করা হয়। জরুরি অবস্থার সময়ে তাঁর আচরণ এতটাই উদ্ধত হয়েছিল যে শোনা যায় , মহাকরণে তাঁর ঘরে ডেকে টেবিলের উপর পা তুলে ফল খেতে খেতে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে বলতেন।

১৯৯৬ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে অবসর গ্রহণকালে তিনি আবার কলকাতা উচ্চ আদালতের ব্যারিস্টার হিসেবে আইন প্র্যাকটিস শুরু করেন। ২০১০ সালের ৬ নভেম্বর ৯০ বছর বয়সে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পরে বর্তমানে তাঁর বসত বাড়িটি হেরিটেজ বাসভবন হিসেবে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। তাঁর স্ত্রী মায়া রায়ের অনুমতিক্রমে মি. রাজেশ চিরিমার গড়ে তোলেন ‘সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ফাউণ্ডেশন’ নামে একটি জনকল্যাণমূলক সংস্থা। এই সংস্থা প্রতি বছর সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের জন্মবার্ষিকী পালন এবং নানাবিধ জনকল্যাণমূলক কাজে জড়িত।