শীর্ষাসন

আসন অবস্থায় দেহের সমস্ত ভার মাথার উপরে রেখে দেহকে মাথার উপর দাঁড় করানো হয় বলে এ আসনকে শীর্ষাসন বলা হয়। যোগশাস্ত্রে বর্ণিত আসন বিশেষ। মানবদেহের শীর্ষ স্থান হলো মাথা। মাথার উপর ভর করে এই দেহভঙ্গী রচনা করা হয় বলে এর নাম শীর্ষাসন (শীর্ষ + আসন) রাখা হয়েছে। এই আসনের অর্ধরূপটি নামে পরিচিত। এই আসনের বর্ধিত প্রকরণগুলো হলো ―অর্ধ-শীর্ষাসন, একপদ শীর্ষাসন, একপদ পার্শ্ব শীর্ষাসন, নিরাবলম্ব শীর্ষাসন, পরিবৃত্ত বজ্র শীর্ষাসন, বিপরীত পরিবৃত্ত কোণাসন, শীর্ষ-পদাসন, সলম্বা শীর্ষাসন।
শীর্ষাসনে থেকে আরও কিছু আসন করার বিধান রয়েছে। এই আসনগুলি বিভিন্ন নামে যোগশাস্ত্রে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এই আসনগুলো হলো―
১: ঊর্ধ্ব-পদ্মশীর্ষাসন : শীর্ষাসন ও পদ্মাসনের সমন্বিতরূপ।
২: বদ্ধশীর্ষাসন : পদ্মাসন ও শীর্ষাসনের সমন্বিতরূপ।
পদ্ধতি প্রথমে পা মুড়ে হাঁটু গেড়ে বসুন। এবার কনুই থেকে দু’হাতের তালু ত্রিভূজের ন্যায় মাটিতে রেখে দু’হাতের আঙুলগুলো পরস্পরের মধ্যে দৃঢ়ভাবে ধরে মাথার ব্রহ্মতালু হাতের ফাঁকে হাঁটুর কাছে মাটিতে রাখুন। এখন মাথা ও কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে দম নিতে নিতে ভাঁজ করা হাঁটু দুটোর সঙ্গে কোমর উপরে তুলুন। এবার পা দুটো জোড়া অবস্থায় রেখে আস্তে আস্তে সোজা করুন এবং দম ছাড়ুন।
এ অবস্থায় মাথা, ঘাড়, পিঠ ও পা মাটি থেকে উল্বম্বভাবে এক সরলরেখায় থাকবে। দেহের ওজন মাথার ব্রহ্মতালুর উপর পড়বে এবং কোমর, হাত ও কনুইয়ের উপর দেহের ভারসাম্য থাকবে। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রেখে ২০সেঃ থেকে ৩০সেঃ এ অবস্থায় থাকুন।এরপর দম ছাড়তে ছাড়তে পা দুটো ভাঁজ করে হাঁটু বুকের কাছে এনে ধীরে ধীরে পা মাটিতে নামিয়ে আনুন। কিছুক্ষণ বসে বা বজ্রাসনে বিশ্রাম নিয়ে তারপর শবাসন করুন।
শীর্ষাসনের পর সাথে সাথে শবাসন অভ্যাস করা নিষেধ। এ আসন অবস্থায় মাথা রক্তে প্লাবিত হয়। একটু বসে বিশ্রাম নিয়ে তারপর শবাসনে বিশ্রাম নিলে সহজে রক্ত চলাচলে স্বাভাবিকতা ফিরে আসে। এ আসন অভ্যাসের পর রক্ত চলাচলে স্বাভাবিকতা ফিরে আসতে অনেক সময় লাগে বলে আসনটি সব আসন করার পর মাত্র একবার করা উচিৎ। প্রথমাবস্থায় কারো সাহায্য নিয়ে বা দেয়ালের সামনে অভ্যাস করা ভালো। এতে টাল সামলাতে সুবিধা হয়।
উপকারিতা: মস্তিষ্ক দেহের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় থাকে বলে স্বাভাবিক অবস্থায় হৃদযন্ত্র মাধ্যাকর্ষণশক্তির বিপরীতে ঐ স্থানে প্রচুর রক্ত পাঠাতে পারে না। কিন্তু এ আসন অবস্থায় মস্তিষ্ক হৃদযন্ত্রের নীচে চলে আসায় অনায়াসে এখানে প্রচুর রক্ত প্লাবিত হয়। ফলে মাথায় ও গলদেশে অবস্থিত গ্রন্থি ও স্নায়ুজাল রক্ত থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ করে সুস্থ ও সক্রিয় থাকতে পারে। মস্তিষ্ক পরিচালনার শক্তি বৃদ্ধি পায়।
চোখ, কান, নাক ও দাঁতে সহজে কোন রোগ আক্রমণ করতে পারে না। লালাগ্রন্থির (স্যালভারী গ্ল্যান্ড) নিঃসরণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় বলে খাদ্যবস্থ সহজে হজম হয়, কোষ্ঠকাঠিন্য ও পেটফাঁপা প্রভৃতি রোগ হতে পারে না। থাইরয়েড গ্রন্থির কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, ফলে দেহের সমস্ত গ্রন্থি ও স্নায়ুজাল সুস্থ ও সক্রিয় থাকে। এ আসন অভ্যাসে সাইনাস, বহুমূত্র, অর্শ, অজির্ণ ও শুক্রতারল্য প্রভৃতি রোগ সারে।
কোনদিন টনসিলের দোষ হয় না। আসন অবস্থায় হৃৎপিণ্ড কিছুক্ষণ মাধ্যাকর্ষণ থেকে অব্যাহতি পায় বলে এর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। পিনিয়াল গ্রন্থি ও পিটুইটারি গ্রন্থি সুস্থ ও সক্রিয় থাকে, ফলে মনের শক্তি, স্মৃতিশক্তি ও ইচ্ছাশক্তি বৃদ্ধি পায়। দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, কর্মবিমুখতা, মাথাধরা, লিকুরিয়া, রক্ত-স্বল্পতা, একশিরা, হাঁপানি প্রভৃতি রোগ হতে পারে না এবং কোন স্ত্রী-ব্যাধি সহজে আক্রমণ করতে পারে না। আসনটি নিয়মিত অভ্যাসে স্থানচ্যুত জরায়ু ঠিক জায়গায় ফিরে আসে। যোগশাস্ত্রমতে বৃদ্ধ বা বয়স্ক ব্যক্তিরা এই আসনটি নিয়মিত এক বৎসর অভ্যাসে রাখলে তাদের যৌবনের লক্ষণ আবার ফিরে আসে।
নিষেধ: প্রাতঃক্রিয়াদি সম্পন্ন না করে কিংবা স্নান বা প্রাণায়াম করার ঠিক পরপর অথবা শ্রমসাধ্য ব্যায়ামের পর প্রয়োজনীয় বিশ্রাম না নিয়ে শীর্ষাসন করা কখনোই উচিত নয়। যাদের স্পন্ডিলাইটিস, পিত্ত প্রধান ধাত এবং চোখে, কানে বা দাঁতে সমস্যা রয়েছে, হৃদরোগ বা রক্তচাপ বৃদ্ধি রোগ আছে, রোগ নিরাময় না হওয়া পর্য়ন্ত বিশেষজ্ঞর পরামর্শ ছাড়া তাদের এই আসন অভ্যাস করা নিষেধ। অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদেরও আসনটি করা উচিৎ নয়।