ভগিনী নিবেদিতা : আইরিশ ন্যাশনালিজমের মধ্যে বড় হওয়া ভারতের আগন্তুক ভগিনী নিবেদিতা

ভগিনী নিবেদিতা : আইরিশ ন্যাশনালিজমের মধ্যে বড় হওয়া ভারতের আগন্তুক  ভগিনী নিবেদিতা

ভগিনী নিবেদিতা Sister Nivedita তিনি ভারতে আগন্তুক। কিন্তু তাঁর চাইতে বড় ভারতবাসী কে? মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল সম্পর্কে ভাবতে বসলে এ কথাই সবার আগে মাথায় ঘুরপাক খায়। কোনও গিমিকের বশবর্তী হয়ে নয়, কোনও প্রাপ্তির আশায় নয়, ঠিক কেন যে এক সাতাশ-আঠাশ বছরের তরুণী লন্ডনের মতো এক আধুনিক শহর ছেড়ে কাহিনি, কিংবদন্তি আর কুসংস্কারে মোড়া (সেই সময়ে ইউরোপে ভারত সম্পর্কে এমন ধারণাই প্রচলিত ছিল) ভারতবর্ষে চলে এলেন, উনি চারিদিকে ভারতের আদর্শ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।

সত্যি বলতে কি, আমরা ভগিনী নিবেদিতার মাধ্যমেই স্বামী বিবেকনন্দকে আরও ভাল করে জানতে পারি। নিবেদিতার জন্যেই, আমরা স্বামীজিকে ও ভারতবর্ষকে আরও ভাল করে বুঝতে পারি। মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল (ইংরেজি: Margaret Elizabeth Noble); ২৮ অক্টোবর, ১৮৬৭ – ১৩ অক্টোবর, ১৯১১) ছিলেন একজন অ্যাংলো-আইরিশ বংশোদ্ভুত সমাজকর্মী, লেখিকা, শিক্ষিকা এবং স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা।১৮৯৫ সালে লন্ডন শহরে তিনি স্বামী বিবেকানন্দের সাক্ষাৎ পান এবং ১৮৯৮ সালে ভারতে চলে আসেন।

একই বছর ২৫ মার্চ তিনি ব্রহ্মচর্য গ্রহণ করলে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর নামকরণ করেন "নিবেদিতা"। ভগিনী নিবেদিতার জন্ম হয় উত্তর আয়ারল্যান্ডে। তিনি তাঁর পিতা স্যামুয়েল রিচমন্ড নোবেলের নিকট এই শিক্ষা পান যে মানব সেবাই ঈশ্বর সেবা। পিতার কথা তাঁর পরবর্তী জীবনেও গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল।

তিনি সঙ্গীত ও শিল্পকলার বোদ্ধা ছিলেন। পড়াশোনা শেষ করে ১৮৮৪ সাল থেকে ১৮৯৪ সাল পর্যন্ত দশ বছর তিনি শিক্ষকতা করেন। শিক্ষিকা হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। শিক্ষকতা করতে করতেই তিনি বুদ্ধের শিক্ষা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এই সময়ই স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। বিবেকানন্দের বাণী তাঁর জীবনে এতটাই গভীর প্রভাব বিস্তার করে যে তিনি ভারতকে তাঁর কর্মক্ষেত্ররূপে বেছে নেন। তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য নারী যিনি ভারতীয় সন্ন্যাসিনীর ব্রত গ্রহণ করেছিলেন।

১৮৬৭ সালের ২৮ অক্টোবর উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডানগ্যানন শহরে মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবা স্যামুয়েল রিচমন্ড নোবেল ছিলেন ধর্মযাজক। মায়ের নাম ছিল মেরি ইসাবেলা। মাত্র দশ বছর বয়সে মার্গারেটের বাবা মারা যান। তারপর তাঁর দাদামশাই তথা আয়ারল্যান্ডের বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী হ্যামিলটন তাঁকে লালনপালন করেন। লন্ডনের স্কুলে মার্গারেটের বিদ্যাশিক্ষা।

সতেরো বছর বয়সে শিক্ষাজীবন শেষ করে মার্গারেট শিক্ষিকার পেশা গ্রহণ করেন। কিছুদিন পরে উইম্বলডনে নিজের একটি স্কুল খোলেন। পাশাপাশি নানা পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতে ও চার্চের হয়ে নানা সেবামূলক কাজও শুরু করেন। ১৮৯৫ সালের নভেম্বর মাসে লন্ডনের এক পরিবারের পারিবারিক আসরে মার্গারেট স্বামী বিবেকানন্দের বেদান্ত দর্শন ব্যাখ্যা শোনেন। বিবেকানন্দের ধর্মব্যাখ্যা ও ব্যক্তিত্বে তিনি মুগ্ধ হন।

তাঁর প্রতিটি বক্তৃতা ও প্রশ্নোত্তরের ক্লাসে উপস্থিত থাকেন। তারপর বিবেকানন্দকেই নিজের গুরু বলে বরণ করে নেন। ১৮৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারি স্বদেশ ও পরিবার-পরিজন ত্যাগ করে মার্গারেট চলে আসেন ভারতে। এই সময় বিবেকানন্দের কাছে ভারতের ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, জনজীবন, সমাজতত্ত্ব, প্রাচীন ও আধুনিক মহাপুরুষদের জীবনকথা শুনে মার্গারেট ভারতকে চিনে নেন। ভারতে আসার কয়েক দিন পর রামকৃষ্ণ পরমহংসের স্ত্রী সারদা দেবীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। এর কিছুদিন পর স্বামী বিবেকানন্দ তাঁকে ব্রহ্মচর্য ব্রতে দীক্ষা দেন। তিনিই মার্গারেটের নতুন নাম রাখেন ‘নিবেদিতা’।

 ভগিনী নিবেদিতা বেদান্ত দর্শনকে নিজের মধ্যে উপলব্ধি করেছিলেন, এবং বেদান্তকেই ব্যবহারিক আধ্যাত্মিকতার মূল করে ভারতীয় সমাজের সকল ক্ষেত্রে সেবার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৮-এর মে থেকে অক্টোবর আলমোড়া ও কাশ্মীর প্রবাসে যান, ভগিনী নিবেদিতাও ওঁর সঙ্গে যান। ভগিনী নিবেদিতার জন্যে এ যেন এক সারা জীবনকালের অভিজ্ঞতা, ভারতের বিশালতা ও তার ওপরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজত্বের প্রকোপ।

 ভগিনী নিবেদিতা বুঝেছিলেন যে ভারতীয়রা কখনই এক আদর্শ মানুষ হয়ে জীবন অতিবাহিত করতে পারবে না, যতদিন না ব্রিটিশ সাম্রাজ্য শেষ হয়। ভগিনী নিবেদিতা মেয়েদের জন্যে একটা বিদ্যালয় শুরু করেন কোলকাতার বাগবাজারে। যার উদ্বোধন করেন শ্রীমা সারদাদেবী ১৮৯৮-এর ১৩ নভেম্বর। ১৮৯৯-এর মার্চে কোলকাতায় ভগিনী নিবেদিতা যুবকদের সংগঠিত করে একটা স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠন করেছিলেন এবং তাদের সঙ্গে সেবার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নিজের বিদ্যালয়ের জন্যে টাকা যোগাতে নিবেদিতা ১৮৯৯-এর মাঝামাঝি একটা লেকচারে অংশগ্রহণ করতে ইংল্যান্ড ও আমেরিকা যান । বোস্টনে থাকার সময়, তাঁর সঙ্গে বিখ্যাত দেশপ্রেমী বিপিন চন্দ্র পালের পরিচয় হয়।

১৯০২ সালের ৪ জুলাই নিবেদিতার গুরু স্বামী বিবেকানন্দের মৃত্যু হয়। এরপর ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কিন্তু রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের নিয়মানুসারে ধর্ম ও রাজনীতির সংস্রব ঠেকাতে সংঘের কেউ রাজনীতিতে জড়াতে পারত না। তাই মিশনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক পরিত্যাগ করতে হয় নিবেদিতাকে। যদিও সারদা দেবী ও রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীদের সঙ্গে তাঁর আমৃত্যু সুসম্পর্ক বজায় ছিল। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময় গোপনে বিপ্লবীদের সাহায্য করতে শুরু করেন নিবেদিতা।

এই সময় অরবিন্দ ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু প্রমুখ বিশিষ্ট ভারতীয় ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। এসবের পাশাপাশি নিবেদিতা মডার্ন রিভিউ, দ্য স্টেটসম্যান, অমৃতবাজার পত্রিকা, ডন, প্রবুদ্ধ ভারত, বালভারতী প্রভৃতি পত্রিকায় ধর্ম, সাহিত্য, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, শিল্প ইত্যাদি বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতেন।

তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য বইগুলি হল কালী দ্য মাদার, ওয়েব অফ ইন্ডিয়ান লাইফ, ক্রেডল টেলস অফ হিন্দুইজম, দ্য মাস্টার অ্যাজ আই শ হিম ইত্যাদি। কিন্তু ভারতের গ্রীষ্মপ্রধান আবহাওয়ায় অতিরিক্ত পরিশ্রম করার ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন নিবেদিতা। ১৯১১ সালে হাওয়া বদলের জন্য জগদীশচন্দ্র বসু ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দার্জিলিঙে বেড়াতে গিয়ে ১৩ অক্টোবর সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন নিবেদিতা। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৪ বছর।