শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী মৃত্যু রহস্য এর ইতিহাস

ভারত ছাড় আন্দোলন শুরু হলে ব্রিটিশরা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে এবং কংগ্রেসের প্রায় সকল নেতাকে জেলে আবদ্ধ করে। বস্ত্তত, জাতীয় স্বার্থ তুলে ধরার মতো নেতা তখন কেউ ছিলেন না। সরকারের একজন সদস্য হওয়া সত্ত্বেও শ্যামাপ্রসাদ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জাতীয় দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কেন্দ্রীয় সরকারকে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে সম্মত করাতে ব্যর্থ হয়ে তিনি বাংলার মন্ত্রিসভা ত্যাগ করার এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জাতীয় শক্তিসমূহকে নেতৃত্ব দানের সিদ্ধান্ত নেন বাংলার বীর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী Syama Prasad Mukherjee। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে নানান জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু নানা সময়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
একইরকমভাবে রহস্যজনক মৃত্যু ঘটেছিল ভারতীয় জনতা পার্টির অন্যতম পরিচিত ও প্রভাবশালী নেতা শ্যামাপ্রাসাদ মুখার্জীরও। তাঁর দলের বহু সদস্যেরই বক্তব্য ছিল এর পিছনে নিশ্চিতভাবে বিপক্ষীয় কংগ্রেসিদের চক্রান্ত ছিল। কিন্তু এই মন্তব্য আজও প্রমাণিত হয়নি। শুধু তাই নয়, তাঁর মৃত্যুর সঠিক কারণ হিসেবে আজ পর্যন্ত কোনও তথ্যকেই সঠিক প্রমাণ করা যায়নি। দীর্ঘ ৬৯ বছর ধরে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী মৃত্যু রহস্য তাহলে কোন সত্যকে আড়াল করে রেখেছে? চলুন, তা বিশদে জেনে নেওয়া যাক।
১৯০১ সালের ৬ জুলাই কলকাতায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর জন্ম হলেও মাত্র ৫২ বছর বয়সেই তাঁর মৃত্যু হয় কাশ্মীরের শ্রীনগরে। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় পুত্র শ্যামাপ্রসাদ শিক্ষাবিদ ও একজন আইনজীবি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে দুবার তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদেও মনোনীত হয়েছিলেন। রাজনীতির জগতে পা রেখে সাভারকরের নির্দেশে হিন্দু মহাসভার নেতৃত্বে আসীন হন শ্যামাপ্রসাদ। ১৯৪১ সালে তাঁর নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভার সঙ্গে কৃষক প্রজা পার্টি এবং কংগ্রেস একত্রে সরকার গঠন করে।
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী মন্ত্রীসভার সদস্যও হন। দেশভাগের সময় তাঁর ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত এবং নিজস্ব আদর্শে অবস্থান আজও নানা সময় বিতর্কের জন্ম দেয়। আবার তাঁর অনুরাগীরা অনেকেই মনে করেন যে তাঁর এই সিদ্ধান্তের জন্যেই মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান রাষ্ট্রের থেকে বাংলার পক্ষে অনেক বৃহৎ একটি মানচিত্রকে স্বাধীন রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। সর্বভারতীয় রাজনৈতিক পরিসরে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী অত্যন্ত প্রভাবশালী এক নেতৃত্ব ছিলেন সেই সময়। কিন্তু আজ থেকে ৬৯ বছর আগে রহস্যজনকভাবেই কাশ্মীরে তাঁর মৃত্যু হয়।
অবিভক্ত বাংলার প্রাক্তন মন্ত্রী এবং পরে নেহেরুর মন্ত্রীসভার অন্যতম মন্ত্রী হিসেবেও তাঁর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। অথচ তিনি সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নেহরুর সবথেকে বড়ো বিরোধী ছিলেন এবং নেহরুর সব কাজেরই যথেষ্ট সমালোচনা করতেন। জওহরলালের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক আদর্শেরও তীব্র নিন্দা করতেন তিনি। তিনিই ভারতীয় জন সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা পরে ভারতীয় জনতা পার্টিতে পরিণত হয় এবং ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদের জাগরণে শ্যামাপ্রসাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
শ্যামাপ্রসাদই প্রথম জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতীয় ভূখণ্ডের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে একীভূত করার দাবি জানান। ১৯৫০ সালের শুরুর দিকেই তাঁর নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল ‘এক বিধান, এক প্রধান, এক নিশান’ আন্দোলন। তৎকালীন জওহরলাল নেহরুর সরকার জম্মু ও কাশ্মীরকে যে বিশেষ স্বীকৃতি দিয়েছিল তার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। ১৯৫৩ সালের ১১ মে শেখ আবদুল্লাহের সরকারের নির্দেশে পুলিশ ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে বে-আইনিভাবে গ্রেপ্তার করে এবং এই ঘটনার এক মাস পরেই ১৯৫৩ সালের জুন মাসে শ্রীনগরে একটি কারাগারে বন্দি থাকাকালীনই তাঁর মৃত্যু হয়।
অনেকেই সন্দেহ করেন যে তাঁর এই মৃত্যু রহস্যজনক এবং এর পিছনে নিশ্চিতভাবে কোনও ষড়যন্ত্র কাজ করেছিল। তাঁর মৃত্যুর পরে ক্ষমতাসীন দল এই রহস্যজনক মৃত্যুর কোনওরকম নিরপেক্ষ তদন্ত করেনি। ১৯৫৩ সালের ৮ মে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী এবং তাঁর অনুগামীরা সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে দিল্লি রেলওয়ে স্টেশন থেকে জম্মুর উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন। শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে ছিলেন গুরু দত্ত বৈদ, অটলবিহারী বাজপেয়ী, টেক চাঁদ, বলরাজ মাধোক প্রমুখরা। তাঁদের অনুসরণ করে কয়েকজন সাংবাদিকও জম্মু-কাশ্মীরে গিয়েছিলেন।
তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল জম্মু ও কাশ্মীরে ভারতীয় নাগরিকদের বসতি নিষিদ্ধ ঘোষণার বিরোধিতা করে অনশন পরিচালনা করা। জওহরলাল নেহরু কাশ্মীরকে যে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিলেন তাতে ভারতের রাষ্ট্রপতি সহ যে কেউ কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি ছাড়া কাশ্মীরে প্রবেশ করতে পারবে না। জম্মু ও কাশ্মীরে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হয়েছিল ভারতীয়দের। জম্মু ও কাশ্মীরে বাধ্যতামূলক অনুমতি ছাড়াই প্রবেশ করে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন।
‘এক দেশ মে দো বিধান, দো প্রধান অউর দো নিশান নেহি চলেঙ্গে’ এই স্লোগানে আন্দোলনে বসেন শ্যামাপ্রসাদ। জম্মু-কাশ্মীরে প্রবেশ করা মাত্রই কাশ্মীরের শেখ আবদুল্লাহ্-র সরকার ১১ মে কোনও প্রকার ওয়ারেন্ট ছাড়াই তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং একটি পোড়ো বাড়িতে তাঁকে বন্দি করে রাখা হয়। শ্রীনগর শহর থেকে বহু বহু দূরে নিশাত বাগে একটি শুনশান জায়গায় ছোট্ট কুটিরে আটকে রাখা হয়েছিল শ্যামাপ্রাসাদকে। ডাল হ্রদের পার্শ্ববর্তী পর্বতমালার ঢালে অবস্থিত ছিল এই বাড়িটি। সেই সময় শ্যামাপ্রাসাদ মুখার্জী ফুসফুসের প্রদাহ এবং আরও নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন।
এইসব ব্যাধিকে অগ্রাহ্য করেই জম্মু ও কাশ্মীর সরকার তাঁকে একজন অপরাধীর মত বিবেচনা করে এবং একটা বদ্ধ ঘরে আটকে রাখে। কিন্তু তাঁকে যেখানে আটকে রাখা হয়েছিল, সেই স্থানে সচরাচর অন্য কারও পৌঁছাবার অবকাশ ছিল না। সেই কুটির-সম কারাগারে পৌঁছানোর জন্য বহু সিঁড়ি ভাঙতে হত। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই প্রশ্নের কোনও উত্তর মেলেনি যে পায়ে গুরুতর চোট লাগার পরেও তাঁকে কেন এভাবে বন্দি করে রাখা হল? ভারতীয় জনতা পার্টির অন্যতম প্রধান সদস্য তথাগত রায়ের লেখা ‘শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী : হিজ লাইফ অ্যান্ড টাইমস’ বইতে তিনি লিখছেন যে জুন মাসের শুরুর দিকে শ্যামাপ্রাসাদের শারীরিক অবস্থার যথেষ্ট অবনতি হয়।
২০ জুন তারিখে বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ ডাক্তারদের নিষেধ সত্ত্বেও তাঁকে স্ট্রেপ্টোমাইসিন জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয় যাতে তাঁর অ্যালার্জি ছিল। সেই সময় তাঁর পরিচর্যাকারী ডাক্তার মহম্মদ জানিয়েছিলেন যে এই অ্যালার্জি সংক্রান্ত নির্দেশনামা বহু বহু দিন আগে শ্যামাপ্রসাদকে জানানো হয়েছিল, কিন্তু তার পর এই জাতীয় ওষুধের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ধারণাও অনেক পাল্টেছে। এই ওষুধ সম্পূর্ণ নিরাপদ এই আশ্বাস দিয়েই শ্যামাপ্রসাদকে স্ট্রেপ্টোমাইসিন দিয়েছিলেন চিকিৎসক মহম্মদ।
এর সঙ্গে তাঁকে বেদনা-নাশক (Pain-Killer) হিসেবে কিছু গুঁড়ো ওষুধও দেওয়া হয়েছিল। যতক্ষণ না পর্যন্ত ব্যথা কমে, ততদিন ডাক্তার তাঁকে এই গুঁড়ো ওষুধ দিনে দুবার করে খেতে বলেছিলেন। গুরু দত্ত বৈদের মতে, জেল সুপারিনটেন্ডেন্টের কাছে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী অনুরোধ করেছিলেন যাতে তাঁর শারীরিক অসুস্থতার সংবাদ তাঁর পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই সংবাদ তো পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া দুরস্ত, তাঁর মৃত্যুর পরে কাশ্মীর সরকার কোনও বুলেটিন পর্যন্ত প্রকাশ করেনি।
পরদিন জেলের চিকিৎসক তাঁকে দেখতে আসেন কেবল, তাঁর চিকিৎসা যিনি করেছিলেন তাঁর কোনও দেখা মেলে না। জেলের চিকিৎসক পুনরায় তাঁকে ১ গ্রাম স্ট্রেপ্টোমাইসিন খাওয়ান যার ফলে সারাদিন ধরে শ্যামাপ্রাসাদের গায়ের তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকেন তিনি। ২২ জুন বৈদকে জানানো হয় যে শ্যামাপ্রাসাদ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান। বৈদ যখন দেখা করতে যান, তখন তিনি লক্ষ্য করেন যে শ্যামাপ্রসাদের শারীরিক অবস্থা ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে। সকাল সাড়ে সাতটার সময় যখন ড. মহম্মদ আলি আসেন, তিনি শ্যামাপ্রাসাদের জটিল অবস্থা দেখে নার্সিং হোমে স্থানান্তরিত করার পরামর্শ দেন।
শ্যামাপ্রসাদকে সেই সময় নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়ার বদলে ১০ মাইল দূরের একটি সরকারি হাসপাতালের স্ত্রী-রোগ বিভাগে ভর্তি করানো হয়। ১৯৫৩ সালের ২৩ জুন সুপারিনটেন্ডেন্ট শ্যামাপ্রসাদের সহায়ক গুরু দত্ত ও টেকচাঁদকে জানান যে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর অবস্থা মোটেও ভাল নয়। পরে তাঁদের জানানো হয় যে ঐ দিনই বিকেল ৩টে ৪০ মিনিটে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর মৃত্যু হয়। তাঁর এই সন্দেহজনক মৃত্যুর পর ভারত সরকার তাঁর মৃতদেহের কোনও ময়না তদন্ত করেনি, এমনকি নেহেরুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী মৌলানা আজাদ দিল্লিতে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর মৃতদেহ নিয়ে আসারও অনুমতি দেননি। তার বদলে তাঁর মৃতদেহ সরাসরি কলকাতায় নিয়ে আসা হয়।
হেফাজতে থাকাকালীন তাঁর মৃত্যু নিয়ে জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা যায়। তাঁর মা যোগমায়া দেবী তদন্তের আর্জিও জানান। তবে জওহরলাল নেহরু বা আবদুল্লা কেউই সেই তদন্তের নির্দেশ দেননি। তাই একজন অসুস্থ নেতার চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ ওঠে তাঁদের বিরুদ্ধে। নিরপেক্ষ তদন্তের আর্জিও তাঁরা খারিজ করেন। অফুরান প্রাণশক্তির অধীশ্বর শ্যামাপ্রসাদ মারা যান মাত্র ৫২ বছর বয়সে।
তাঁর মৃত্যুর কয়েক দশক পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী দাবি করেন যে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী সাধারণ স্বাস্থ্যগত জটিলতার কারণে মারা যাননি, বরং তাঁর মৃত্যুর পিছনে নেহেরু এবং কাশ্মীর সরকারের মধ্যে কোনও ষড়যন্ত্র ছিল এবং তিনি প্রকাশ্যে শ্যামাপ্রসাদ হত্যার প্রসঙ্গ তুলে আনেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী মৃত্যু রহস্য কী তাহলে এক গুপ্ত হত্যার আখ্যান? ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সমর্থিত সরকারের সঙ্গে কোন গোপন বোঝাপড়ায় শেখ আবদুল্লাহ শাসিত জম্মু ও কাশ্মীর সরকার শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর মৃত্যুর জন্য দায়ী ? এ প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি।
আরো পড়ুন জীবনী মন্দির দর্শন ইতিহাস ধর্ম জেলা শহর শেয়ার বাজার কালীপূজা যোগ ব্যায়াম আজকের রাশিফল পুজা পাঠ দুর্গাপুজো ব্রত কথা মিউচুয়াল ফান্ড বিনিয়োগ জ্যোতিষশাস্ত্র টোটকা লক্ষ্মী পূজা ভ্রমণ বার্ষিক রাশিফল মাসিক রাশিফল সাপ্তাহিক রাশিফল আজ বিশেষ রান্নাঘর প্রাপ্তবয়স্ক বাংলা পঞ্জিকা