স্বপরিবারে ঘুরে আসুন ইটাচুনার রাজবাড়ি থেকে

শহর কলকাতা ও বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে নাম জানা ও না-জানা স্বীকৃতি | পাওয়া ও না-পাওয়া অনেক ঐতিহ্য | সেই রকমই বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে পুরোনো দিনের রাজবাড়ি | আজকাল জমিদার ও রাজবাড়ীগুলো অধিকাংশই তত্ত্বাবধানের অভাবে বিলুপ্তির পথে | অন্যদিকে আবার অনেক পরিবারই ধরে রেখেছেন তাদের বাড়ির ঐতিহ্য | আজ সেই রকমই এক রাজবাড়ির সম্মন্ধে আজ বলবো |
ইটাচুনা রাজবাড়ির দিকে এগোতে এগোতে সংক্ষেপে এই রাজবাড়ির ইতিহাস জেনে নেওয়া যেতে পারে। ‘খোকা ঘুমলো পাড়া জুড়লো, বর্গী এল দেশে’— মনে পড়ে শৈশবের গন্ধমাখা ঘুমপাড়ানি ছড়া? মরাঠা থেকে দুর্দান্ত বর্গীর দল চৌথ আদায়ের জন্য তখন বার বার হানা দিচ্ছে এ রাজ্যে। সেই সময়েই বর্গী বাহিনীর কেউ কেউ প্রচুর ধনসম্পত্তি অর্জন করে স্থায়ী ভাবে বঙ্গদেশে থেকে যান।
ইটাচুনা রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা কুন্দ্রারা ছিলেন তারই উদাহরণ। এই কুন্দ্রা থেকেই পরে হয় কুণ্ডু। সাফল্য নারায়ণ কুণ্ডুর বংশধররা ১৭৬৬ সালে এই রাজবাড়ি তৈরি করেন। বর্গীদের বাড়ি বলে স্থানীয়। মানুষ একে বর্গীডাঙাও বলেন। শহরের সীমানা ছাড়িয়ে গাছগাছালি মেঠো পথ, মাইলের পর মাইল সবুজে মোড়া চাষের জমি, কলোচ্ছ্বাসরত শিশুর দল চোখ জুড়িয়ে অদ্ভূত প্রশান্তি দেয় হৃদয়কে।
পথ শেষ হয় রাজবাড়ির বিশাল ফটকে। গেট ছাড়িয়ে ভিতরে পা দিলে কেমন যেন গা ছমছম করে ওঠে। লোকলস্কর পাইক বরকন্দাজ— কালের নিয়মে সেই অতীত জৌলুসের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই এখন। তাও পুরনো দেওয়ালের প্রাচীন গন্ধ, উঁচু কড়িবরগার ছাদ, আল্পনা দেওয়া বিরাট নাটমন্দির, প্রাঙ্গন জুড়ে বিরাট বিরাট বাতিস্তম্ভ, প্রকাণ্ড ঝাড়বাতি দিয়ে সাজান ইতিহাসের গন্ধমাখা সুবিশাল বৈঠকখানা মুহূর্তে অন্য এক জগতের দরজা খুলে দেয় চোখের সামনে।
এই বাড়িতে কানাকানি করে ইতিহাস। পুরনো প্রথা মেনে এই বাড়ির অন্দরমহল, বার মহলও সম্পূর্ণ আলাদা। কাছারি বাড়ি, হিসাবের ঘর, বাজার সরকারের ঘর পেরিয়ে তবে অন্দরমহলে পা। সেই যে বাবার এক আদরের মেয়ে, কৌতূহলী মায়াময় চোখে ভিতরমহলের বারান্দার একটা ছোট্ট জানালা খুলে চোখ রেখেছিল জমিদার বাবার কাছে চাকুরিপ্রার্থী পুরুষটির দিকে।
প্রথম দর্শনেই প্রেম। সোনাক্ষী সিংহ আর রণবীর সিংহের ‘লুটেরা’ ছবির শুটিং এই বাড়িতেই হয়েছিল। বাড়ির মেয়েরা যাতে অন্দরের জানলা খুলে বাইরেটা দেখতে পান, অথচ তাঁদের কেউ দেখতে না পায় সেই ব্যবস্থা করা ছিল অলিন্দে ছোট ছোট জানলা করে। বাড়ির সবই সাবেক প্রথার। বড়কর্তা মেজোকর্তার সারিবদ্ধ ঘর, বিবর্ণ বহু পুরনো আসবাবপত্র, বিরাট সিন্দুক,কারুকার্যমণ্ডিত পালঙ্ক সবই। বাড়ির লম্বা নিঃঝুম অলিন্দ, জানলা দিয়ে ডিঙি মেরে দেখা বাইরের সবুজের সমারোহ, খিড়কির পুকুরে নুয়ে পড়া গাছ— সবই বড় মায়াবী, মনকেমন করা।
হুগলি জেলার পাণ্ডুয়া ব্লকের ইটাচুনা রাজবাড়ি অনেকেরই চেনা | কলকাতা থেকে ৯০ কিমি দূরে অবস্থিত ইটাচুনার রাজবাড়ী | বিশাল লোহার গেট পার হলেই চোখে পড়বে ইংরাজীর ‘ইউ(U)’ আকৃতির প্রকাণ্ড দোতলা রাজবাড়ী | ইটাচুনার রাজবাড়ী এখন হুগলি জেলার পাণ্ডুয়া ব্লকের ইটাচুনা খন্যান গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে | রাজবাড়ীটি সাবেকী আনায় ভরপুর |
একটি উঠানকে ঘিরে নানা মহলে তৈরী এই ইটাচুনা রাজবাড়ী | ঢুকেই বিশাল সবুজ চত্বর, তার পরের উঠানে রয়েছে নাটমন্দির, তারও পরে অন্দরমহল | ইটাচুনার রাজবাড়ীটি ইটঁ আর চুন সুরকির তৈরী স্থাপত্য | বাড়িটিতে রয়েছে উচুঁ উচুঁ ধাপের সিঁড়ি, চারদিকে বিশাল আকারের বারান্দা, রয়েছে প্রকাণ্ড আয়তনের ঘর, খড়খড়ির জানলা, দেওয়ালে হরিণের শিং রয়েছে, রয়েছে কচ্ছপের খোলস দিয়ে তৈরী যুদ্ধের ঢাল |
রাজবাড়ীর একেবারে পেছনে রয়েছে খিড়কি পুকুর | প্রবেশপথের খিলানের উপর লেখা শ্রীমদভাগবতগীতার বাণী | প্রাসাদের মাঝের অংশে ঠাকুরদালান| রাজবাড়িতে বিখ্যাত মদনমোহনের মন্দির ছাড়াও দেখার জন্য রয়েছে অনেক কিছুই | রাজবাড়ীর রাস্তার অপর পাড়েও রয়েছে রাজবাড়ীর প্রতিষ্ঠিত শিব মন্দির | এই মন্দিরে শিবের মুর্তির বিশেষত্ব নজর কাড়ে |
ওই মন্দিরে শিবমূর্তিটি জটাধারী, গোঁফওয়ালা | এধরনের মূর্তি সাধারণত কোথাও দেখা যায় না | এক সময় ইটাচুনার রাজবাড়িতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অফিসও ছিল | এই রাজবাড়িতে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী ঘড়ি | প্রহরে প্রহরে ঢং ঢং ঘন্টার নিনাদ জানান দেয় বর্তমান যুগেও | বেশ কিছু সিনেমা ও অজস্র বিজ্ঞাপনী ছবির শুটিং হয়েছে এখানে | বিগ্রহ যেখানে অধিষ্ঠিত তার সামনে গোলাকৃতি বারান্দা, তাকে ধরে রেখেছে তিনটি থাম |
গ্রামের মধ্যের রাস্তা ধরে এগোলে ২০০ বছরেরও পুরনো মহানদ কালীবাড়ি। সরল সাধাসিধে গ্রামের মানুষগুলি সাদরে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন ছায়ায় মোড়া মন্দিরটিতে। প্রশস্ত চাতাল, পাখির কলকাকলি প্রশান্তি দেয় হৃদয়কে। জনশ্রুতি, রানি রাসমণি এখানে নিয়মিত পুজো দিতে আসতেন। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের অনুপ্রেরণা নাকি এই মন্দির থেকেই পান তিনি।
অন্দরমহলে রয়েছে বড় বারান্দা,সিঁড়ি আর ছাত যা দিয়ে অন্দরমহলের সব ঘরগুলিই সংযুক্ত | পর্যটকদের থাকবার জন্য ১৪টি ঘরের বন্দোবস্ত রয়েছে এখানে | সঙ্গে থাকছে রাজকীয় বাঙালী খাবারের ব্যবস্থা | স্বপরিবারে, অফিস কলিগ, বন্ধুদের সাথে ঘুরে আসুন ইতাছুনা রাজবাড়ী থেকে | আশা করি রাজবাড়িতে থাকতে মন্দ লাগবে না | রাজবাড়িতে আছে বিভিন্ন রকমের প্যাকেজ |
ডে আউট প্যাকেজ 1500/- ( ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ইভিনিং স্ন্যাকস), সাথে রাজবাড়ি ঘুরে দেখা এবং মন্দিরে সন্ধ্যা আরতি দেখা | অতিথিদের মাটির পাত্রে শরবত দিয়ে বরণ করা হয় এই রাজবাড়িতে | খাবার পরিবেশিত হয় কাঁসার পাত্রে | এমনকি রসুইঘর আজও তাঁরাই সামলান, যারা বংশপরম্পরায় জমিদার বাড়ির রান্নার দায়িত্বে ছিলেন |
বাঁশুরিয়া বাঁশি বাজিয়ে ফেরে অতিথিদের ঘরের দ্বারে দ্বারে | খাওয়া মাত্র ১০০০/- ( ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার) | এছাড়াও রাতে থাকার ব্যবস্থা আছে | বিভিন্ন নামে বিভিন্ন রকম রুম আছে রাজবাড়িতে | বড়ো বৌদি- ৪৮০০/- ছোট বৌদি- ৪৫০০/- ঠাকুরমা- ৪৫০০/- বড়ো পিসি- ৪৫০০/- গিন্নি মা- ৩৬০০/- (3জন) বড়ো মা- ৩০০/- মেজ মা- ৩০০০/- বিলাস, মঞ্জরী- ৮৯০০/- ( 6জন) কাকাবাবু- ৩০০০/- পিসেমশাই- ৩০০০ /- ছোট পিসি- ৪১০০/- জ্যাঠা মশাই- ২৪৯৯/- বড়দা- ২৯০০/-