জাগ্রত পাতালভেদী দক্ষিণাকালী এর মন্দির

আজবাংলা শিয়ালদহ স্টেশন থেকে লক্ষ্মীকান্তপুর লোকালে বহড়ু স্টেশন। ভ্যানরিকশায় মাত্র তিন কিলোমিটার গেলে ময়দা গ্রাম। 'ময়দা' নামের উত্পত্তি নিয়ে দু'টি কাহিনি প্রচলিত। রাবণরাজার শ্বশুরমশাই তথা ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত স্থপতি ময়দানবের বাস ছিল নাকি এখানেই। তাঁর নামেই এই অঞ্চলের নাম ময়দা। স্টেশন থেকে মন্দিরের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার।
দেবী কালিকা এখানে ময়দাকালী নামে প্রসিদ্ধ হলেও আসলে তিনি পাতালভেদী কালী।৫০০ বছর আগে এখান দিয়েই বয়ে যেত ভাগীরথী। এখন সবই স্মৃতি। সেই মজে যাওয়া নদীর পাড়েই বর্তমানের ময়দা গ্রাম। অথচ একসময় এখানেই গড়ে উঠেছিল সমৃদ্ধশালি এক জনপদ। ময়দার পাতালভেদী কালীমন্দির বড়িষার সাবর্ণ রায়চৌধুরীরা নির্মাণ করেন ১১৭৬ বঙ্গাব্দে এবং রাঢ়ীয় বন্দ্যোপাধ্যায়দের মন্দিরের পুরোহিত ও সেবায়েত নিযুক্ত করেন।
হঠাত্ এখানে এই মন্দিরের কী ভাবে প্রতিষ্ঠা হল তা নিয়েও কাহিনি আছে। যশোহররাজ প্রতাপাদিত্যের রাজত্বকালে ময়দার আদিগঙ্গায় জাহাজ চলাচল করত। তখন ময়দা ছিল এক বন্দর। কথিত আছে, জাহাজের কাঠ দিয়েই নাকি ময়দা কালীমন্দিরের দরজা বানানো হয়েছে। দেবীর গর্ভমন্দিরটি মাটি থেকে বেশ কিছুটা নীচে। একটি চতুষ্কোণ গহ্বরে বেদির উপরে দেবীর প্রতীক স্বরূপ স্থাপিত আছে একটি সিঁদুরে রাঙানো শিলা।
এই শিলাতেই ত্রিনয়ন বসিয়ে দক্ষিণাকালীর ধ্যানে প্রত্যহ পূজা করা হয়।বলা হয়ে থাকে, শিলারূপী এই কালী স্বয়ম্ভু। পাতাল থেকে উত্থিত।তাই দেবীর নাম পাতালভেদী কালী। দেবীর প্রস্তরীভূত অঙ্গে এবং দেবীযন্ত্রে অশোক চক্র বিদ্যমান। দেবীর মাহাত্ম্য নিয়ে বহু কিংবদন্তী আছে। যেমন কালীমন্দিরের পূর্বদিকে কালীকুণ্ড নামে যে প্রাচীন দিঘি আছে সেখানে স্নান করলে মৃতবৎসা মহিলার সন্তান রক্ষা পায়।এছাড়াও রয়েছে ফুলকাড়ানো বা মায়ের আদেশ প্রাপ্ত হওয়া।
ভক্ত তাঁর মনের কথা কায়মনোবাক্যে মায়ের সামনে বলে একাগ্র চিত্তে স্মরণ করতে থাকেন। সেই সময় পুরোহিত মায়ের মাথায় একটি ফুল দেন। সেই ফুল যদি স্বতঃই মায়ের মাথা থেকে দেবীগহ্বরে পড়ে যায় তাহলে নাকি ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ হয়। এমনটাই দাবি করেন স্থানীয় মানুষজন। বহু লোক মন্দিরে হত্যে দিয়ে মায়ের ওযুধ পেয়ে দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
পাতালভেদী কালীক্ষেত্রকে ঘিরে অনেক কাহিনী ও কিংবদন্তি লোকমুখে ফেরে। কলকাতার বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরীর বংশের গঙ্গাধর চৌধুরী ১১৭৬ বঙ্গাব্দের ময়দায় এই কালীমন্দিরটি নির্মাণ করেন। এখানে মা 'দক্ষিণা কালিকা'। ময়দা কালীমন্দিরে পূজিত কালীমাতা কোনও প্রতিষ্ঠিত মূর্তি নয়। দক্ষিণমুখী আটচালা মন্দিরের গর্ভগৃহে কালীমাতার মূর্তি এখানে অনুপস্থিত।
এখানে নদীগর্ভ থেকে পাওয়া বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এক শিলামূর্তি পূজিতা হন। শোনা যায় এই মূর্তির গায়ে আছে একটি খোদিত অশোকচক্র। তবে এখন সে সব বোঝার উপায় নেই। তেল ও সিঁদুরের গাঢ় প্রলেপে সব ঢাকা পড়েছে।জয়নগর-মজিলপুর গ্রামের বাংলার লৌকিক গ্রন্থের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কারপ্রাপ্ত লোকসংস্কৃতি গবেষক গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু লেখায় রয়েছে, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার তাড়দহ ও মেদিনীপুর জেলার গেঁওখালির মতো অনেক জায়গায় পর্তুগিজদের জমিদারি ছিল।
তাড়দহ থেকে পর্তুগিজদের একটি অংশ ময়দায় আসে এবং গঙ্গাতীরে একটি ব্যবসা ও বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করে। তাই সেই যুগে ময়দা ছিল বিশেষ উন্নত ও সমৃদ্ধ। পর্তুগিজ 'মাদিয়া' শব্দ থেকে ময়দার উৎপত্তি হয়েছে। 'মাদিয়া' শব্দের অর্থ বন্দর বা পোতাশ্রয়। সুন্দরবনের অরণ্যসম্পদ মধু, কাঠ, মোমে বিরাট ব্যবসা ছিল এই ময়দায়।
পর্তুগিজরা ময়দা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর স্থানীয় বাসিন্দারা মধু, মোমের ব্যবসা চালিয়ে যান। বন্দরতীর্থ এই ময়দার কালীবাড়িতে এখনও জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমায়, শারদীয়া নবমী তিথিতে ও কার্তিক মাসের অমাবস্যায় দেবীর উৎসব উপলক্ষে সাবর্ণ চৌধুরীদের নামে সংকল্প করে জোড়া পাঁঠা বলি দেওয়া হয়।
মানসদেবীর কাছে মানতকারী ভক্তগণ রোগ-ব্যাধি নিরাময়ের পর মানত চোকাতে ঢাক, ঢোল, করতাল বাজিয়ে মায়ের মন্দিরে পুজো নৈবেদ্য নিবেদন করেন। তা ছাড়া মাঘ মাসের বিভিন্ন দিনে গ্রামবাসীদের উদ্যোগে মন্দিরে অন্নভোগ উৎসব পালিত হয়। মন্দিরের পুবদিকে কালীকুণ্ড নামে একটি পুরোনো পুকুর আছে। এই পুকুরে মৃতবৎসা মায়েরা সন্তানের কল্যাণ কামনায় স্নান করেন।
একসময় এই কালীকুণ্ডের মালিকানা ছিল হালদার পরিবারের। বর্তমানে এই পুকুরের স্বত্বাধিকারী হলেন ময়দা গ্রামের ছাঁটুইরা। প্রতিদিন মন্দিরে সন্ধ্যারতি হয়। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার মানসিককারী ভক্তদের সমাগম হয়। জ্যৈষ্ঠ পূর্নিমায়, শারদীয়া নবমী তিথিতে ও বর্তমান কার্তিক মাসের অমাবস্যা উৎসব ব্যতীত বৈশাখ মাসের প্রথম তারিখে গোষ্ঠ উৎসব,আষাঢ় মাসে অম্বুবাচী, ভাদ্র মাসে তার নবমী ও মাঘ মাসের এক তারিখে গঙ্গাস্নান উপলক্ষে কালীমন্দিরের পুকুরে দশ-পনেরো হাজার পুণ্যার্থী স্নান করেন। এই উপলক্ষে বিশাল মেলা বসে ময়দার পাতালভেদী দক্ষিণা কালী মন্দির প্রাঙ্গণে।