তাওস হাম

হ্যামলেট নাটকে শেক্সপীয়ারের এই অমর উক্তি ‘তাওস হাম’- রহস্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই পৃথিবীতে রোজ এমন কত ঘটনা ঘটে যার ব্যাখ্যা আমাদের জানা যুক্তি দিয়ে সর্বদা করা যায় না। যেখানে যুক্তি বিজ্ঞানের জারিজুরি খাটেনা। এরকমই একটি অমীমাংসিত রহস্য ‘তাওস হাম’ (Taos Hum)। ১৯৯০ সালের একদিনের ঘটনা। আমেরিকার নিউ মেক্সিকোর পাহাড়ে ঘেরা ছোট একটি জনপদ তাওস।
অন্যান্য আর পাঁচটা দিনের সেই দিনটাও প্রায় শেষের দিকে। রাত ৯টা নাগাদ হঠাৎ শহরের সকল অধিবাসী অবাক হয়ে যায় একটি ঘটনায়। আকাশ বাতাস মথিত করে অদ্ভুত এক গুঞ্জন শোনা যেতে থাকে। অনেকটা একটা বাইক স্ট্যান্ড থাকা অবস্থায় চালু রাখলে যেমন গুনগুন আওয়াজ হয় অনেকটা সেরকম। টানা হয়ে চলেছে শব্দটা।
পৃথিবীর ইতিহাসে এই গুঞ্জনই তাওস হাম নামে পরিচিত। মজার ব্যাপার যেটা সেটা এই গুনগুন আওয়াজ কিন্তু স্থানীয়দের মধ্যে সবাই শুনতে পায়নি। যারা শুনেছেন তাঁদের বেশিরভাগের বয়স ৩০-৫৯ বছরের মধ্যে। সর্বদা শোনা যায়না এই শব্দ, কেবল মাত্র রাত আটটা থেকে ন’টা অবধি শোনা যায়। শুরু হল পৃথিবীজুড়ে এই রহস্যের সমাধানের জন্য তদন্ত।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে তাওস হাম সম্পর্কে একটি গবেষণায় দেখা যায় মাত্র তাওসের দুই শতাংশ মানুষ এটি শুনতে পায়; আবার যারা শুনেছেন তাঁদের মধ্যে কেউ ৩২ হার্জ থেকে ৮০ হার্জ-এর কেউ আবার ০.৫ হার্জ থেকে ২ হার্জ কম্পাংকের গুনগুন আওয়াজ শুনেছেন। যারা শুনতে পায় এই শব্দ তাদের কাছে এই অভিজ্ঞতা যথেষ্ট কষ্টের।
কারণ এই গুঞ্জন তাঁরা সর্বদা শুনতে থাকেন। ঘুমের মধ্যেও শুনতে পান, কানে আঙুল দিয়ে থাকলে কিংবা কানে ইয়ার প্লাগ গুঁজেও এই শব্দ এড়াতে পারেননা তাঁরা। ২০০৪ সালে কানাডার ভ্যাংকুভার, ২০০৬ সালের ১৫ নভেম্বর নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড এবং ২০০৯ সালে অস্ট্রেলিয়ায় এরকমই রহস্যময় হাম বা গুঞ্জন শোনা গেছে।
গবেষকদের অনেকেই অবশ্য তাওস হামের সমগ্র ঘটনাটিকে ‘অডিটরি হ্যালুসিনেশন’ বা শ্রবণ বিভ্রান্তি বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের মতে এই ঘটনার মধ্যে কোন অতিপ্রাকৃত রহস্য নেই। এটি একটি সাধারণ শারীরিক সমস্যা। এমন ঘটনাও শোনা গেছে তাওস হাম যাঁরা শুনেছেন তাঁদের কয়েকজন তাওস শহরের বাইরেও এই শব্দটি শুনতে পেয়েছেন। আবার আরেকদল গবেষকের মতে তাওস হাম আসলে স্পনটেনাস ওটোঅ্যাকিউস্টিক এমিশন (Spontaneous otoacoustic emissions)এর কারসাজি।
মানুষের কান নিজস্ব শব্দ উত্পন্ন করে যাকে স্পনটেনাস ওটোঅ্যাকিউস্টিক এমিশন(এস.ও.ই) বলে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে স্বাভাবিক শ্রবণশক্তি সম্পন্ন প্রাপ্ত বয়স্কদের ৩৮-৬০ শতাংশের মধ্যে এস.ও.ই দেখা যায় যদিও তাঁদের বেশিরভাগের এই শব্দ সম্পর্কে কোন ধারণা থাকে না। এস.ও.ই শুনতে পেয়েছেন এমন ব্যক্তিরা বলেছেন তাঁরা সর্বদা কানে একধরনের হিস হিস আওয়াজ শুনতে থাকেন অনেকটা তাওস হামের মত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এক সাথে নির্দিষ্ট একটি জায়গার এত সংখ্যক মানুষ কীভাবে একসাথে একইরকম হ্যালুসিনেশন বা শ্রবণ সংক্রান্ত জটিলতার শিকার হলেন? এ প্রশ্নের কোনো ব্যাখ্যা আজও অবশ্য মেলেনি।